শিশুদের প্রাণের মেলা

>
নিজের পছন্দের বই কিনতে ভালোবাসে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: অন্য আলো
নিজের পছন্দের বই কিনতে ভালোবাসে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: অন্য আলো
এই বইমেলাকে আরও বর্ণিল করতে শিশু-কিশোরদের ভূমিকা কম নয়। এই লেখায় আছে মেলায় তাদের উপস্থিতির টুকরো টুকরো ছবি।

সেদিন শিশুপ্রহরে বসেছিলাম স্বনামধন্য একটি প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে। বইমেলা শেষ হতে বাকি ছিল মাত্র পাঁচ দিন। একটি কন্যাশিশু তার মায়ের কোলে চড়ে এসেছে সেই প্যাভিলিয়নে। বয়স বড়জোর আড়াই হবে। সে মায়ের কোল থেকেই বেশ কষ্ট করে হাতে তুলে নিয়েছিল একটি বই। বইটি কিশোরদের উপযোগী—মলাটটি রঙিন, দামেও সস্তা। গভীর মনোযোগের সঙ্গে উল্টেপাল্টে বই দেখছে আড়াই বছর বয়সের মেয়েটি। প্যাভিলিয়ন ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে দারুণ বিপাকে পড়লেন তার মা । শিশুটি কিছুতেই তার হাতে থাকা বইটি ফেরত দেবে না। কোনোভাবেই সন্তানকে বোঝাতে সক্ষম না হয়ে একপর্যায়ে শিশুটির মা তার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে ফেরত দিলেন। মেয়েশিশুটিও কান্না শুরু করল অঝোর ধারায় । কিন্তু মা তাঁর অবস্থানে অনড়। কান্নারত শিশুটিকে কোলে নিয়েই তিনি প্যাভিলিয়নের সীমান্ত পেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু আমার মনের সীমানায় ক্রন্দনরত শিশুটির মুখটি চিরস্থায়ী হয়ে রইল। ভাবছিলাম কী এমন ক্ষতি হতো শিশুটিকে বইটি কিনে দিলে! খেলাচ্ছলে ওই অবুঝ কন্যা যে বইটি হাতে তুলে নিয়েছিল, তার কাছে আর কয়েক বছর পরেই হয়তো তা হয়ে উঠত স্মৃতিময় একটি পাঠ উপকরণ। আমরা কি শিশুদের পছন্দের ব্যাপারে আরেকটু শ্রদ্ধাশীল হতে পারি না?
এবারের বইমেলায় যে কয়টি দিন আমি কাটিয়েছি, তার অধিকাংশ সময় পার করেছি শিশুদের সান্নিধ্যে, শিশু চত্বরে। যেহেতু শিশুসাহিত্য নিয়ে আমার বিস্তর আগ্রহ, তাই শিশুরাই আমার বইয়ের প্রধান পাঠক। এ বছর সময় প্রকাশনী থেকে আমার ক্রিকেটপাগল গেছো ভূতের বাচ্চা নামে কিশোরদের উপযোগী একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া পঙ্খিরাজ প্রকাশনী থেকে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই বেরিয়েছে সবার বন্ধু নামে আরেকটি বই। এটিও শিশুদের উপযোগী।
প্রতিবারই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি বইমেলার জন্য। বইমেলা মানেই এক অনন্য সুযোগ নিজের সৃষ্টিকে যাচাই করার। একই সঙ্গে এই মেলা সুযোগ করে দেয় পাঠকের রুচি ও পছন্দকে নতুনভাবে জানার। শিশুদের সঙ্গ সব সময়ই উপভোগ করি আমি। ওদের অনুভূতির প্রকাশ একেবারেই সোজাসাপটা। কোনো কিছু ভালো লাগলে যেমন তা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে, মন্দ লাগলেও নির্ভয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। ওদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। শিশুরা বইমেলায় আসে বইমেলায় দেখবে বলেই। ওরা আসে বই কিনতে, বই ছুঁয়ে দেখতে, বইয়ের গন্ধ নিতে। বড়দের মতো জনপ্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ নিতে কিংবা সেলফি তোলার উদ্দেশ্যে মেলায় আসে না শিশুরা।
ওদের সঙ্গে বইমেলায় সময় পার করে এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হয়েছে এবারও। সবচেয়ে অবাক হয়েছি, বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিশুদের আত্মবিশ্বাস দেখে। তিন-চার বছরের শিশুকে দেখেছি ঘুরেফিরে দেখেশুনে বই নির্বাচন করতে। ছয়-সাত বছর বয়সী অনেক শিশুকে লক্ষ করেছি ভালোভাবে বইটি পড়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে। এই বয়সী শিশুরা জনপ্রিয় লেখকদের তেমন চেনে না, জনপ্রিয়তা বলতে কী বোঝায়, তাও তেমনভাবে জানে না। দেখেছি যে অনেক মা-বাবাই ব্যর্থ হয়েছেন নিজেদের পছন্দ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে। অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রে বই নির্বাচনে বিবেচ্য ছিল তাদের নিজস্ব পছন্দ। খুদে পাঠকেরা বেশ কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে বই নির্বাচন করেছে; যেমন বইয়ের বিষয়বস্তু, রং, বইয়ের পাতার গুণগত মান, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ইত্যাদি। বিষয়বস্তু হিসেবে শিশুদের পছন্দ রাজা-রানি, ভূত কিংবা পরির গল্প এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। তা ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পশুপাখির গল্পের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব। যেমন তারা খোঁজ করেছে বাঘ, সিংহ, প্রজাপতি, শেয়াল কিংবা মুরগির গল্প। তাই যে বইগুলোতে তারা এই চরিত্রগুলো খুঁজে পেয়েছে সে বইগুলোর প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় লেখকদের বই কেনার ব্যাপারে তেমন কোনো পক্ষপাতিত্ব না থাকলেও কিশোরেরা যথারীতি খোঁজ করেছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক কিংবা সুমন্ত আসলামের বইয়ের।
বরাবরের মতো এবারও শিশুদের অভিভাবকদের অভিযোগ করতে শুনেছি শিশুতোষ বইয়ের মূল্য নিয়ে। তারা প্রায়ই বড়দের বইয়ের মূল্যের সঙ্গে শিশুদের বইয়ের মূল্যের তুলনা করেন। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে শিশুদের বই বর্ণিল ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে এবং বইয়ের গুণগতমান বজায় রাখতে এ ধরনের বইয়ের উৎপাদন খরচ বড়দের বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি হয়। আবার অভিযোগকারী এসব অভিভাবকের অনেককেই লক্ষ করেছি বইয়ের মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্থ বইমেলায় অবস্থিত ফুডকোর্টে অনায়াসে খরচ করতে। তবে শিশুদের বইয়ের মূল্য আরেকটু সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য প্রকাশকদেরও চেষ্টা থাকা জরুরি।
শিশুদের বইয়ের ক্ষেত্রে এবার আরেকটি ব্যাপার বড়ই চোখে বিঁধেছে। কোনো কোনো প্রকাশনী সংস্থার শিশুদের বই পৃথক ও আকর্ষণীয়ভাবে পরিবেশনের তেমন কোনো চেষ্টা চোখে পড়েনি। ফলে বড়দের ও শিশুদের বইয়ের একত্রে উপস্থাপন বই খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে শিশুদের বিভ্রান্ত করেছে। এসব সত্ত্বেও এটি বলতেই হবে,বইমেলা শিশু-কিশোরদেরও প্রাণের মেলা।