শাহ আবদুল করিমের শেষ দিনগুলো

বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিমের প্রয়াণের এক যুগ পূর্ণ হলো আজ। এ লেখায় ধরা আছে ২০০৯ সালে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাঁর শেষ দিনগুলোর খেরো খাতা

শাহ আবদুল করিমের আলোকচিত্র অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম
 শাহ আবদুল করিমের আলোকচিত্র অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম

ঠিক বারো বছর আগে আজকের দিনেই বাউলগানের কিংবদন্তি সাধক শাহ আবদুল করিম মারা যান। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন-রাত তাঁর কেটেছিল হাসপাতালের বিছানায়। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই ক্রমশ স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে শুরু করেছিল। একমাত্র ছেলে শাহ নূরজালালসহ হাতেগোনা কয়েকজনকে ছাড়া কাউকে চিনতেনও না ভালো করে। পরে যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন গলার স্বরও অস্পষ্ট হয়ে এসেছিল। অথচ একসময় তাঁর ভরাট কণ্ঠের গান শুনে লাখো মানুষের জনসমাগমস্থলে পিনপিতন নীরবতা তৈরি হতো। সেই তিনি কিনা জীবনের শেষ কয়েকটা দিন ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলেছেন।

শাহ আবদুল করিম ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকে নানা রকম বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধিতে ভুগছিলেন। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানধল গ্রামের বাড়িতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপরই স্থানীয় দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অক্সিজেন দিয়ে শাহ আবদুল করিমকে বিভাগীয় শহর সিলেটের নূরজাহান জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টানা চার দিন চিকিৎসার পর খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

একপর্যায়ে গান শুনতে চাইলে বাউলের শিষ্য বশিরউদ্দিন সরকার নিজের লেখা একটি গান গেয়ে শোনান। গানটি ছিল এমন, ‘কী খেলা খেলতেছেন বাবা করিম শায়/ গাড়ি চলে না চলে না বলে চালাচ্ছেন মৌলায়॥ আস্তে আস্তে কথা বলেন/ কাছের মানুষ চিনতে পারেন/ সালাম আদাব গ্রহণ করেন আগের মতো প্রায়॥’ এ গান শুনে তিনি হাসেন। পরে শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’ গানটি বশিরউদ্দিন তাঁর ওস্তাদজিকে গেয়ে শোনান। এ গান শুনে করিমের চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। করিমের চোখে পানি দেখে সবাই তখন বশিরউদ্দিনকে দোষারোপ করেন, কেন তিনি এ গান শোনালেন! করিম বিষয়টা লক্ষ করে সবাইকে ইশারায় বশিরউদ্দিনকে দোষারোপ করতে নিষেধ করেন।

৯ সেপ্টেম্বর শাহ আবদুল করিম খাওয়াদাওয়া করেন। ধীরে ধীরে কথাবার্তা বলছিলেন। একপর্যায়ে গান শুনতে চাইলে বাউলের শিষ্য বশিরউদ্দিন সরকার নিজের লেখা একটি গান গেয়ে শোনান। গানটি ছিল এমন, ‘কী খেলা খেলতেছেন বাবা করিম শায়/ গাড়ি চলে না চলে না বলে চালাচ্ছেন মৌলায়॥/ আস্তে আস্তে কথা বলেন/ কাছের মানুষ চিনতে পারেন/ সালাম আদাব গ্রহণ করেন আগের মতো প্রায়॥’ এ গান শুনে তিনি হাসেন। পরে শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’ গানটি বশিরউদ্দিন তাঁর ওস্তাদজিকে গেয়ে শোনান। এ গান শুনে করিমের চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। করিমের চোখে পানি দেখে সবাই তখন বশিরউদ্দিনকে দোষারোপ করেন, কেন তিনি এ গান শোনালেন! করিম বিষয়টা লক্ষ করে সবাইকে ইশারায় বশিরউদ্দিনকে দোষারোপ করতে নিষেধ করেন। ১৯৮৫ সালে শাহ আবদুল করিমের শিষ্যত্ব গ্রহণকারী বশিরউদ্দিন সেদিনের বর্ণনা দেন এভাবে, ‘হাসি-কান্নার পর তিনি (শাহ আবদুল করিম) নির্লিপ্ত হয়ে পড়েন। আর কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায়নি। কোনো কথাও বলেননি। কেবল ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করতেন। এক দিন পর তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দিয়ে রাখা হয়। ওই দিন গান শোনানোর একফাঁকেই বাবা (শাহ আবদুল করিম) হাত মুঠো করে প্রতীকী কিছু একটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “তোমার ঠেখন নাই (তুমি আটকাবে না)।” আমিও হাত পেতে প্রতীকী বিষয়টা গ্রহণ করে পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত বাবার দোয়ায় ঠেকিনি কোথাও।’

শাহ আবদুল করিমের নির্লিপ্ত হওয়ার পরের ঘটনার স্মৃতিচারণা পাওয়া যায় করিমের প্রধান শিষ্যদের একজন হিসেবে সুপরিচিত বাউলশিল্পী আবদুর রহমানের ভাষ্যে। আবদুর রহমান ১৯৭৭ সালে করিমের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। আদর করে করিম তাঁকে ডাকতেন ‘রহমান সাধু’। করিমের সেই রহমান সাধু বলেন, ‘বাবা (শাহ আবদুল করিম) কথা বলতে চাইতেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ অস্পষ্ট ছিল। কিছুই বোঝা যেত না। কেবল ইশারায় ডাকতেন, কথা বলতেন। আমরা ঠারেটুরে সেসব বুঝতাম। তিনি বলতেন, “কই বেটাইন, তোমরা কই? মানুষ আনো, গফ (গল্প) করি। আর দরজাটা লাগাও (বন্ধ করো)।” কেন এমন কথা তিনি বলতেন, সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।’

শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শাহ আবদুল করিম খাওয়াদাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন বাউলশিল্পী আবদুর রহমান। তিনি জানান, শাহ আবদুল করিম এমনিতেই স্বল্পাহারী ছিলেন। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খাওয়া আরও কমিয়ে দেন। কেবল মান্ডাড়ি (চাল পিষে জুসের মতো করে প্রস্তুত খাবার) ও জুসজাতীয় খাবার অল্প পরিমাণে খেতেন। শোল মাছের শুঁটকি ও রসগোল্লা তাঁর প্রিয় খাবার ছিল। অথচ তখন সেসব খাওয়ানোর কথা বললেও তিনি তা খাবেন না বলে ইশারায় জানান।

১১ সেপ্টেম্বর সকালে শাহ আবদুল করিমের অবস্থার অবনতি হয়। তিনি ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতে শুরু করেন। বাউল আবদুর রহমান ও কয়েক দশক ধরে করিমের সেবায় থাকা নারী নূরন্নেসাসহ কয়েকজনকে পাশে রেখে করিমতনয় শাহ নূরজালাল কক্ষ থেকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। তখনই হাত দিয়ে ইশারা করে আবদুর রহমানকে কাছে ডেকে নেন শাহ আবদুল করিম। আবদুর রহমান সেদিনের স্মৃতিচারণা করেন এভাবে, ‘ইশারা পেয়ে বাবার কাছে গেলাম। তাঁকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।

আমাকে কী একটা কথা বললেন! অস্পষ্ট কথা হওয়ায় বুঝিনি। তিনি ধীরে ধীরে হাত তুলে আমার মুখও বুলিয়ে দেন। অনুমান করি, তিনি আমাকে বলেছেন, “যাও, মানুষে তোমারে মায়া করবনে!” বাস্তবেও হলো তা–ই। বাবার শিষ্য হওয়ার কারণে মানুষ ঠিকই আমারে মায়া করইন!’

শাহ নূরজালালের কাছ থেকে খবর পেয়ে চিকিৎসকেরা শাহ আবদুল করিমের কক্ষে ছুটে আসেন। দ্রুত তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানান, ৭২ ঘণ্টার আগে তাঁর অবস্থার অবনতি কিংবা উন্নতি সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। তবে চিকিৎসকেরা সেই সুযোগ আর পেলেন না। চলে গেলেন গণমানুষের শিল্পী শাহ আবদুল করিম। ১০ দিন হাসপাতালের শয্যায় কাটিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে ৯৩ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় মাটি ও মানুষের কিংবদন্তিতুল্য এই বাউলশিল্পীর।

শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুর খবর সকালেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে সিলেটসহ সারা দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাউলগানপিয়াসি শোকাহত মানুষ হাসপাতালে যান তাঁকে একনজর দেখার জন্য। মুহূর্তেই শহর ছাড়া প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা হাসপাতালে এসে জড়ো হতে থাকেন। ভক্তদের কেউ কেউ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাউলের গান গেয়ে আহাজারি প্রকাশ করতে থাকেন।

হাসপাতাল থেকে মরদেহ বেলা একটায় সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। সেখানে ভক্ত বাউলেরা ‘শোকগাথা’ হিসেবে করিমের গান গেয়ে বরণ করেন বাউলের মরদেহ। শহীদ মিনার চত্বরে কালো কাপড়ে স্থাপন করা শোকমঞ্চে মরদেহ রাখার পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শোকমঞ্চের পাশে খোলা হয় শোকবই। উপস্থিত অনুরাগীরা শোকবইয়ে সই করেন।

জোহরের নামাজ শেষে হজরত শাহজালালের (রহ.) দরগাহ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শেষে শোকযাত্রাসহকারে মরদেহ নগরের পুরান লেন এলাকার ডায়াবেটিস হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়। পরদিন সকাল সাতটায় মরদেহ নিয়ে বাউলের স্বজন-অনুরাগীরা গাড়িযোগে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় দিরাইয়ে শহীদ মিনারে মরদেহ রাখা হয়। সেখানে অগণিত মানুষ মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। দুপুর ১২টায় উপজেলা সদরের বিএডিসি মাঠে শাহ আবদুল করিমের দ্বিতীয় জানাজা হয়। পরে মরদেহ নিয়ে নৌকায় কালনী নদী পাড়ি দিয়ে উজানধল গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। এ সময় শিশু, নারী-পুরুষনির্বিশেষে অগণিত ভক্ত-অনুরাগীর কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বাউলের শিষ্যদের অনেকেই মূর্ছা যান। এরই মধ্যে গ্রামের ধলশাহী জামে মসজিদে তৃতীয় ও শেষ জানাজা হয়।

তারপর প্রিয় বাউলকে বেলা সাড়ে তিনটায় দাফন করা হয় তাঁর সহধর্মিণী সরলার কবরের পাশে। ভক্ত ও শিষ্যরা কান্না আর ভালোবাসায় চিরবিদায় জানান বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমকে। ধীরে ধীরে হাওরের বুকে নেমে আসে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি।

কালনী নদীর কূল থেকে শুরু করে গোটা হাওরে যেন শোকের বান নামে। ধলআশ্রম গ্রামের সেই ছোট্ট রাখাল বালক থেকে একসময় বাউলসম্রাটে পরিণত হওয়া শাহ আবদুল করিম আর কখনো উত্তাল আফালের (ঢেউ) দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবেন না। দোতরা হাতে বাড়ির পাশের কালনী নদীর পার ধরে হেঁটে হেঁটে গাইবেন না—

আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হায়
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে॥

বাংলা মায়ের মুখের হাসি
প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি
মায়ের হাসি পূর্ণ শশী
শতœমানিক জ্বলে।
মায়ের তুলনা কি আর
ধরণীতে মিলে,
মা আমার শস্যশ্যামলা
সুশোভিত ফলে-ফুলে॥

গাছে গাছে মিষ্ট ফল
মাঠে ফলে সোনার ফসল
রয়েছে সুশীতল জল
নদী-নালা, খাল-বিলে।
কোকিল ডাকে কুহু স্বরে
বুলবুল নাচে ডালে
শুক-সারি গান গায়
মা যেন থাকেন কুশলে॥

বাউল আবদুল করিম বলে
জীবনলীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকব মায়ের কোলে
তাপ-অনুতাপ ভোলে।
মাকে ভুলে না মায়ের
খাঁটি সন্তান হলে
মা বিনে আর কী আছে তার
সুখে, দুঃখে মা-মা বলে॥