এ বছর বাংলা সংবাদ সাময়িকপত্রের দ্বিশতবর্ষ, আর প্রথম সারির দুটি সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ। ১৮১৮ সালের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম তিনটি পত্রিকা—যথাক্রমে মাসিক দিগদর্শন, সাপ্তাহিক সমাচারদর্পণও সাপ্তাহিকবাঙ্গালগেজেট। প্রথম দুটি পত্রিকার প্রকাশস্থান শ্রীরামপুর মিশন ও তৃতীয়টির কলকাতা।
অন্যদিকে ১৯১৮ সালের জুন মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক বঙ্গীয়মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা ও ডিসেম্বর মাসে মাসিক সওগাত। প্রথমটি ছিল ‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-সমিতি’র (১৯১১) মুখপত্র। দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয় সম্পূর্ণ ব্যক্তির উদ্যোগে। সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (১৮৮৮—১৯৯৪)। ওই বছর সাপ্তাহিক থেকে বার্ষিক মিলিয়ে প্রকাশিত মোট ১৮টি পত্রিকার মধ্যে বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রথম সারিতে স্থান পাওয়ার যোগ্য উল্লিখিত পত্রিকা দুটি। বর্তমান রচনায় শতবর্ষের সীমায় দাঁড়িয়ে মাসিক সওগাতকে ফিরে দেখার প্রয়াস পাওয়া হবে। সমিতি-পত্রিকাটি আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ গ্রন্থে নাসিরউদ্দীন নিজের জীবনকথা যেটুকু জানিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায়, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ও পশ্চাৎপদ স্বসম্প্রদায়ের কল্যাণচিন্তা ছিল তাঁর সহজাত। বিশ শতকের প্রথম পর্বের অনেক মুসলিম তরুণের মতো তাঁর মানসেও এ দুটো ছিল পরস্পরসাপেক্ষ। প্রতিবেশী শিক্ষিত হিন্দু জীবনের স্পন্দনশীলতা নাসিরউদ্দীনের মানস-প্রবণতায় আরও শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। কেননা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছিলেন অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি পুরো মুসলিম সমাজজীবনকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। বাল্যকালেই এ থেকে মুক্তির উপায়চিন্তা তাঁকে চঞ্চল করে তুলেছিল।
অকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় নাসিরউদ্দীনের শিক্ষা স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। কিশোর বয়সেই কাঁধে চেপেছিল সংসারের দায়ভার। স্টিমারস্টেশনে সহকারী মাস্টার থেকে মাস্টার, তারপর ব্রিটিশ বিমা কোম্পানির এজেন্ট, কিন্তু মুসলমান সমাজে বিমা করা তখন পাপকাজ বলে পরিগণিত। ফলে প্রবল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই চালাতে হয়েছে। তারপর এসেছে সাফল্য। নিজের মহকুমা শহর চাঁদপুরে অফিস নিয়েছেন। বাল্য-কৈশোরের স্বপ্নপূরণে বইয়ের দোকান দিয়েছেন। তাতে লোকসানই হয়েছে। ভেবেছেন কলকাতায় গিয়ে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে পারলে তাঁর লক্ষ্য সফল হবে। সেই উদ্দেশ্যে ১৯১৭ সালে কলকাতায় যান। খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পারেন, কাজটি মোটেও সহজ নয়। তাঁর পরিকল্পনা ছিল সচিত্র মাসিক পত্রিকা বের করা। কিন্তু মুসলমান সমাজে ছবি গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্য তাদের সচিত্র কোনো পত্রিকাও নেই। তা ছাড়া সমাজে চিত্রশিল্পীরও একান্ত অভাব। তাদের ভালো কোনো প্রেসও নেই। এতগুলো অসুবিধা সত্ত্বেও সাহস ও অদম্য ইচ্ছার ওপর ভর করে দু-একজন শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতায় ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে নাসিরউদ্দীন প্রকাশ করলেন সচিত্র মাসিকপত্র সওগাত। পত্রিকা বেরোল ১ম বর্ষ ১ম খণ্ড সংখ্যা অগ্রহায়ণ ১৩২৫ চিহ্নিত হয়ে। এটিই কোনো মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সচিত্র বাংলা পত্রিকা।
মুখ্যত মুসলমান সমাজের কল্যাণব্রত ছিল সওগাত প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্য। সে জন্য সম্পাদক পত্রিকার পক্ষে আবশ্যকীয় কয়েকটি নীতিনির্ধারণ করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তাসমৃদ্ধ রচনার জন্য লেখকদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া, সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা, নারীশিক্ষা ও নারী জাগরণমূলক রচনাদি প্রকাশ ও মেয়েদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করা, নতুন লেখক সৃষ্টিতে উৎসাহ দান, সর্বোপরি নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ।
নাসিরউদ্দীন জানিয়েছেন, সওগাত প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে কবিকে একটা কপি উপহার দিয়ে তাঁর পত্রিকার জন্য লেখা প্রার্থনা করেছিলেন। ‘পথের সাথী’ নামে একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সংখ্যার প্রথম রচনা হিসেবে সেটি ছাপা হয়। এরপরও সওগাত-এ তিনি লেখা দিয়েছিলেন। নজরুল ইসলাম লিখতে শুরু করেন ৭ম সংখ্যা থেকে। এই সংখ্যায় তাঁর ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ মুদ্রিত হয়। রোকেয়া এস হোসেন ছিলেন গোড়া থেকেই। এভাবে প্রতিষ্ঠিত ও নবীন লেখক-লেখিকাদের রচনাসম্ভার নিয়ে সওগাত বেশ জনপ্রিয় হয়। তার প্রমাণ মেলে সর্বোচ্চ দুই হাজার কপি মুদ্রণের তথ্য থেকে। পরে অবশ্য এই সংখ্যা কমতে থাকে। ৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা (এপ্রিল ১৯২২) প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
সওগাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে নাসিরউদ্দীন জানিয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধজনিত সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি, কিন্তু পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে খরচের তুলনায় দাম কম রাখা। ফলে প্রথম থেকেই লোকসান চলছিল। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সম্পাদককে ঋণগ্রস্ত হতে হয়। তখন বড় হয়ে দেখা দেয় ঋণমুক্তি এবং নিজের ও পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে আগের বিমা কোম্পানিতে নতুন করে এজেন্সি নিতে হয়। এবার কাজের অঞ্চল কলকাতা। অন্তত বছর চারেক সে কাজে যুক্ত থেকে আর্থিক সামর্থ্য লাভ করে নাসিরউদ্দীন আবার মনোনিবেশ করলেন নতুনভাবে পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনায়। প্রথম পর্বের বর্ষ গণনা করে ৪র্থ বর্ষ ১ম সংখ্যা আষাঢ় ১৩৩৩ চিহ্নিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করল নবপর্যায়ের সওগাত (জুন ১৯২৬)। এবার শুধু যাত্রা নয়, জয়যাত্রা।
বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রথম পর্বের সওগাত-এর গুরুত্ব স্বীকার করেও বলতে হবে যে সম্পাদক নাসিরউদ্দীন যা চাচ্ছিলেন—লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি—উপযুক্ত লেখকের অভাবে তা সফল হয়নি। নবপর্যায়ে সেই আকাঙ্ক্ষা সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন সম্ভাবনাময় মুসলিম তরুণ সাংবাদিকতা উপলক্ষে তখন কলকাতায় সমাগত। সওগাতসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁরা কাজ করেন। সমাজের পরিবর্তন কামনায় সবাই উন্মুখ। দূরদর্শী নাসিরউদ্দীন তাঁদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য গঠন করলেন ‘সওগাত সাহিত্য মসলিশ’। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বসত সৃষ্টিশীল তুমুল আড্ডা। কৃষ্ণনগর থেকে দুর্দশাগ্রস্ত নজরুলকে ১৩৩৪ সালের অগ্রহায়ণে সওগাত-এ নিয়ে এলেন নাসিরউদ্দীন। তিনি হলেন সাহিত্য মজলিশের মধ্যমণি। নতুন নতুন সব চিন্তা ও পরিকল্পনা দানা বেঁধে উঠত মসলিশকে ঘিরে।
সম্পাদক ও সমাজের কল্যাণকামী হিসেবে নাসিরউদ্দীন কেবল দূরদর্শী ছিলেন না, তাঁর চিন্তায় জন্ম নিত নতুন নতুন পরিকল্পনা। তারই প্রকাশ দেখি সওগাত-এর বার্ষিক সংখ্যা পরিকল্পনায়। ১৩৩৩-এর ভাদ্রে এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এটি এতটা সমাদৃত হয় যে প্রকাশের অনতি পরে দুবার পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ছবিসহ কেবল মেয়েদের লেখা নিয়ে ‘মহিলা সংখ্যা’ প্রকাশ করা। ১৩৩৬-এর ভাদ্রে ৩০ জন নারীর নানা ধরনের রচনা নিয়ে প্রকাশ পায় এই সংখ্যা। এতে ৮৩ খানা হাফটোন ছবি ছাপা হয়েছিল। সে যুগে এ যে কত বড় দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল, আজকে আমাদের পক্ষে তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এরপর দেশভাগের আগে আরও অন্তত তিনটি ‘মহিলা সংখ্যা’ বেরিয়েছিল।
সন্দেহ নেই, সওগাত ছিল মুক্তচিন্তার মাসিক। ১৯২৮ সালের ১১ মে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সওগাত ছিল আরেকটু চড়াসুরের। এ দুই মিলিয়ে রক্ষণশীল গোঁড়া শ্রেণির কাছ থেকে নাসিরউদ্দীনকে ইসলামদ্রোহী, কাফের, মুরতাদ ইত্যাকার নিন্দা শুনতে হয়েছিল। এসবের সঙ্গে আরও কিছু ঘটনার কারণে শুরু হয়েছিল দ্বন্দ্ব। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ঠিক এই সময়েই ইতিহাসের প্রায় একই রকম সংগঠন চলছে বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকাতেও। কয়েকজন ‘তরুণ তুর্কি’, সেখানে তখন শুরু করেছেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। ফলে প্রগতিশীলতার সঙ্গে রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে সেখানেও এবং ঘটে চলেছে ঘটনার পর ঘটনা। জানানো হয়তো দোষের হবে না, ওই সময়কার দুই বড় শহরের সেসব ঘটনাসংশ্লিষ্ট বহু তথ্য ও উপাদান বর্তমান আলোচক ধারণ করে রাখার চেষ্টা করেছেন তাঁর বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব নামের সন্দর্ভে (কথাপ্রকাশ, ২০১৪)।
ব্রিটিশ শাসনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাঙালি মুসলমানের জাগরণ-প্রচেষ্টার ইতিহাস সন্ধান ও অনুধাবনে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সওগাত পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক আকর। কিন্তু কেবল সে কারণে নয়, মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে আজকের প্রচুরসংখ্যক শিক্ষিত ও সম্পন্নজনের সাহিত্য পত্রিকার প্রতি অনুরাগ ও দায়িত্বশীলতা, চিন্তাচেতনার পরিমাপ ইত্যাদি মননক্ষেত্রে সেদিনের সঙ্গে তৌলন বিচার ও আত্মসমীক্ষায় পত্রিকাটিকে শতবর্ষের সীমায় দাঁড়িয়ে দেখাও দরকার। সেটিই মনে হয় বেশি জরুরি।
সওগাতনামা
সম্পাদক: মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।
ডিসেম্বর ১৯১৮ (১৩২৫ বঙ্গাব্দ), কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।
ডিসেম্বরে প্রথম প্রকাশের সময় এটি ছিল মাসিক পত্রিকা।
প্রকাশের পর থেকেই ছিল দারুণ জনপ্রিয়। তখন এটি মুদ্রিত হয়েছিল দুই হাজার কপি অবধি।
প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, কাজী আবদুল ওয়াদুদসহ বিশিষ্ট লেখকেরা লিখতে শুরু করেন।
সওগাত–এর প্রথম সংখ্যায় খ্যাতনামা পুরুষ ও নারী ১৬টি ছবি ছাপা হয়। সেই সময়ে নারীর ছবি ছাপানো এবং নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ে প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্য দিয়ে পত্রিকাটির উদার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রথম দফায় ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মার্চ-এপ্রিল (১৩২৭ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু ছিল।
৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা (এপ্রিল ১৯২২) প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
এর চার বছর পর ১৯২৬–এর জুনে দ্বিতীয় দফায় নতুনভাবে আবার বের হয় সওগাত।
১৯২৮ সালের ১১ মে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক হিসেবে।
১৯৪৭–এর দেশভাগের পর পত্রিকাটির দপ্তর কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং ঢাকা থেকে প্রকাশ পায়।
সূত্র: উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া