তসলিমা নাসরিনের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস
তসলিমা নাসরিনের ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস

লেখকদের সঙ্গে যত ঘটনা–২৮: তসলিমা নাসরিনের সঙ্গ ও প্রসঙ্গ

কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

তসলিমা নাসরিন সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন কলামে টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়তেন (১৯৭৮-১৯৮৪)। কবিতা লিখতেন। কবিতাপত্র বের করতেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ই তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে বিয়ে করেন। সেটা ১৯৮১ বা ১৯৮২ সাল হবে। ১৯৮৬ সালে সম্ভবত তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা উৎসবে আমি প্রথম তসলিমা নাসরিনকে দেখি। তিনি সুতির পাটভাঙা শাড়ি পরে কবিতা উৎসবের টিএসসি কার্যালয়ে আসতেন। রুদ্র কবিতা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। আমি তখন একজন একনিষ্ঠ ও অখ্যাত কর্মী হিসেবে বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হল থেকে হেঁটে হেঁটে টিএসসিতে আসতাম।

১৯৮৭ সালে আমরা মোজাম্মেল বাবুর নেতৃত্বে ‘দেশবন্ধু’ পত্রিকা বের করি। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রকাশ করতে থাকি সাপ্তাহিক ‘পূর্বাভাস’।

‘পূর্বাভাস’ পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে আমরা মোজাম্মেল বাবুর গাড়ি করে মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় তসলিমা নাসরিনের বাসায় গিয়েছিলাম। হাসপাতালের উল্টো দিকে বিখ্যাত পুরান ঢাকার একটা রং না-করা ভবনের পঞ্চম বা ষষ্ঠ তলায় তসলিমা থাকতেন। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করতেন। বাসায় কোনো লিফট ছিল না। সেই সময় অবশ্য কম বাড়িতেই লিফট ছিল। নিচতলায় ছিল কাগজের গোডাউন। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছি, একেক তলায় একেক রকমের গন্ধ, কোনোটাতে সাবানের, কোনোটাতে লোবানের, কোনোটাতে বিস্কুটের, কোনোটাতে ওষুধের। সব ছিল গোডাউন। একেবারে ওপরের তলায় মানবসতি। যেসবের একটায় তসলিমা নাসরিন থাকতেন।

তসলিমা তখন নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’–এ কলাম লিখতে শুরু করেছেন। তাঁর কবিতার বই ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ প্রকাশিত হলে ‘খবরের কাগজ’–এ সেই বইয়ের বিজ্ঞাপন বেরোতে লাগল। বাংলাদেশের কোন জেলার কোন বইয়ের দোকানে বইটি পাওয়া যাচ্ছে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকাও ওই সাপ্তাহিকে বিজ্ঞাপন হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এর মধ্যে একদিন শুনতে পেলাম নাঈমুল ইসলাম খান তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করে ফেলেছেন।

তসলিমা নাসরিন ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকাতেও কলাম লিখতে শুরু করলেন। এ সময় তিনি পূর্বাভাসের নয়াপল্টন অফিসে মাঝেমধ্যেই আসতেন। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতেন। টেবিলে নিউজপ্রিন্টের প্যাড পড়ে থাকত। তিনি বলপেন বের করে তাতে ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবি আঁকার হাত ভালো ছিল। ট্রেসিংপেপারে ছবি এঁকে তিনি দুমড়ে-মুচড়ে বলতেন, ধ্রুব (এষ) এই রকম করে নানা ধরনের ছবি তৈরি করতে পারে।
একই কাগজে আমিও কলাম লিখতাম। আমারটার নাম ছিল ‘গদ্যকার্টুন’। তসলিমা নাসরিনের কলামের নাম ছিল ‘আমার মেয়েবেলা’।

সাপ্তাহিক ‘পূর্বাভাস’–এ আমরা যখন আড্ডা দিতাম, আমাদের আড্ডায় যোগ দিতে আসতেন মিনার মাহমুদ। সেখানেই তসলিমার সঙ্গে মিনার মাহমুদের পরিচয় হয়ে থাকবে বলে আমার ধারণা।

১৯৯১ সালে নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে তসলিমা নাসরিনের বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন হলো। আর দ্রুতই তসলিমা বিয়ে করে ফেললেন মিনার মাহমুদকে।
এরপর তিনি ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকায় তাঁর কলামে লিখলেন, ‘আজ থেকে তসলিমা নাসরিন নিয়মিত ভাত রাঁধবে, ভাত বেড়ে স্বামীকে খেতে দেবে, পাখা নেড়ে তাকে বাতাস করবে।’

মিনার মাহমুদ-তসলিমা নাসরিনের সেই বিয়েও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দুজনের কারও পক্ষে সেই বিয়ে টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না, তা আমরা জানতাম।
‘পূর্বাভাস’ বন্ধ হয়ে যাবে টের পেয়ে আমি ‘খবরের কাগজ’–এ যোগ দিলাম ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে। তখনো তসলিমা নাসরিনের কলাম ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো।

১৯৯২ সালে তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘নির্বাচিত কলাম’ বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়ে গেলেন। তখন আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম তাঁর শান্তিবাগের বাসায়। গিয়ে দেখি, কবি বেলাল চৌধুরী বসে আছেন। পুরোনো সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ খুঁজলে আমার নেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।

তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিনের কলাম ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছিল। প্রায়ই তাঁর মাথার দাম ঘোষিত হতে লাগল। তাঁর প্রকাশক ছিলেন বিদ্যাপ্রকাশের মুজিবুর রহমান খোকা। প্রকাশক মুজিবুর রহমান খোকাকে তসলিমা নাসরিনের বাসায় বসে থাকতে দেখেছি। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তসলিমা ‘পূর্বাভাস’ অফিসেও আসতেন। বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে তসলিমা নাসরিন এসেছিলেন। সম্ভবত পার্ল পাবলিকেশন্স থেকেও তাঁর বই বের হয়েছিল। কোনো একটা স্টলে এসে তিনি বসেছিলেন। এত ভিড় হয়েছিল যে স্টল ভিড়ের চোটে ভেঙে গিয়েছিল এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মেলায় পুলিশ ঢুকেছিল। তসলিমাকে কর্ডন করে পুলিশ বের করে নিয়ে গিয়েছিল।

তসলিমা নাসরিন ‘লজ্জা’ বের করলেন। বইটি নিষিদ্ধ হলো। একে তো তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছে, তার ওপর বই নিষিদ্ধ হলো। তখন তিনি বোধ করি ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকাতেও লিখতেন।

ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় তসলিমার সাক্ষাৎকারে ভয়াবহ একটা কথা ছাপা হলো। তসলিমা প্রতিবাদপত্র প্রকাশ করে বললেন, তিনি এটা বলেননি। কিন্তু ততক্ষণে আগুন দাবানলের আকার ধারণ করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো।
গ্রেপ্তার এড়াতে তসলিমা আত্মগোপন করলেন। ব্যারিস্টার সারা হোসেন প্রমুখ তাঁর জামিনের জন্য লড়লেন এবং জামিন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেশ ছেড়ে সুইডেন চলে গেলে (১৯৯৪) সরকার স্বস্তিবোধ করল। সেটা খালেদা জিয়ার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের কাল।

এরপর তসলিমা নাসরিন আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেন। তাঁর প্রশংসা করে কয়েকজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন।

মিনার মাহমুদের সঙ্গে আমার দেখা হলো নিউইয়র্কে, ১৯৯৫ সালে। তিনি সেখানে তখন ট্যাক্সি চালাতেন। মিনার মাহমুদ আমাকে বললেন, আমাকে নিয়ে কী কৌতুক প্রচলিত আছে, জানেন?
আমি বললাম, কী?

একদিন আমি ট্যাক্সি চালাচ্ছি। এক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার দেশ কী? আমি বললাম, বাংলাদেশ। সে বলল, তসলিমা নাসরিনকে চেনো? আমি বললাম, চিনব কী, সে তো আমার বিবাহিত বউ ছিল। লোকটা তক্ষুনি বলল, গাড়ি থামাও। আমি নেমে যাব। তুমি একটা আস্ত মাতাল। মাতাল না হলে একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার দাবি করতে পারে যে সে তসলিমার স্বামী ছিল!
আমি বললাম, ঘটনা কি সত্য?
মিনার ভাই বললেন, না সত্য না।

২০০৮ সালে আমি সুইডেনের স্টকহোমে বিশ্ব লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে যাই। সেখানে তসলিমা নাসরিন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বক্তৃতা শুরুর আগে তাঁর সঙ্গে হলের বাইরে দেখা হলো। আমাকে দেখে তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠল । বললেন, ‘আমি দেশে যেতে পারছি না। ভারতে থেকেও আমাকে চলে আসতে হয়েছে। আমি দেশে যেতে চাই। এখন তো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা কি আমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে পারে না?’

এরপর তিনি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতায় নতুন কোনো কথা নেই। যা আছে, তাতে দেশে ফেরার আকুতি ফুটে উঠল না, দেশে ফেরার রাস্তাটা আরও কঠিন হয়েই উঠলমাত্র। এই বক্তৃতার পর বাংলাদেশের কোনো সরকারই তাঁকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে সাহস পাবে না।

কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন:
‘আমি কখনোই মনে করি না মানুষ এমন কোনো অপরাধ করতে পারে, যার শাস্তি তার কাছ থেকে দেশ কেড়ে নেওয়া। মানুষ মানুষকে ত্যাগ করে। দেশ কখনো তার সন্তানকে ত্যাগ করে না। যাঁরা তসলিমা নাসরিনের রচনা পছন্দ করেন না তাঁরা পড়বেন না। তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তাঁর বিভ্রান্তি নিয়ে, আমরা কেন তাঁকে দেশ ছাড়া করব? ভয়ংকর সব যুদ্ধাপরাধী তো ঠিকই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

‘পূর্বাভাস’ পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে আমরা মোজাম্মেল বাবুর গাড়ি করে মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় তসলিমা নাসরিনের বাসায় গিয়েছিলাম। হাসপাতালের উল্টো দিকে বিখ্যাত পুরান ঢাকার একটা রং না-করা ভবনের পঞ্চম বা ষষ্ঠ তলায় তসলিমা থাকতেন। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করতেন। বাসায় কোনো লিফট ছিল না। সেই সময় অবশ্য কম বাড়িতেই লিফট ছিল। নিচতলায় ছিল কাগজের গোডাউন। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছি, একেক তলায় একেক রকমের গন্ধ, কোনোটাতে সাবানের, কোনোটাতে লোবানের, কোনোটাতে বিস্কুটের, কোনোটাতে ওষুধের। সব ছিল গোডাউন। একেবারে ওপরের তলায় মানবসতি। যেসবের একটায় তসলিমা নাসরিন থাকতেন।

আমরা তো তাদের দেশান্তরি করিনি।’
তসলিমা নাসরিন ‘এ প্রেম নয়’ নামে মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখেছেন। যেমন:
‘কিছুক্ষণ থাকো
সারাক্ষণ তোমাকে মনে পড়ে
তোমাকে সারাক্ষণ মনে পড়ে
মনে পড়ে সারাক্ষণ।
তুমি বলবে আমি ভালোবাসি তোমাকে, তাই।
কিন্তু এর নাম কি ভালোবাসা?
নিতান্তই ভালোবাসা? যে ভালোবাসা হাটে–মাঠে না চাইতেই মেলে!
ভালো তো আমি বাসিই কত কাউকে, এ রকম তো মরে যাই মরে যাই লাগে না!
এ নিশ্চয় ভালোবাসার চেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু।
তোমার কথাগুলো, হাসিগুলো আমাকে এত উষ্ণ করে তোলে যেন
হিমাগারে শুয়ে থাকা আমি চোখ খুলছি, শ্বাস নিচ্ছি।
বলবে, আমি প্রেমে পড়েছি তোমার।
কিন্তু প্রেমে তো জীবনে আমি কতই পড়েছি,
কই কখনো তো মনে হয়নি কারও শুধু কথা শুনেই, হাসি শুনেই
বাকি জীবন সুখে কাটিয়ে দেব, আর কিছুর দরকার নেই!
এ নিশ্চয়ই প্রেম নয়, এ প্রেম নয়, এ প্রেমের চেয়ে বড় কিছু, বেশি কিছু।’
মাকে নিয়ে ‘মায়ের কাছে চিঠি’ শিরোনামে তসলিমার মর্মস্পর্শী কবিতা আছে:
‘কেমন আছ তুমি? কত দিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা, কত সহস্র দিন তোমার কণ্ঠ শুনি না, কত সহস্র দিন কোনো স্পর্শ নেই তোমার। তুমি ছিলে, কখনো বুঝিনি ছিলে। যেন তুমি থাকবেই, যত দিন আমি থাকি তত দিন তুমি—যেন এ রকমই কথা ছিল।

আমার সব ইচ্ছে মেটাতে জাদুকরের মতো। কখন আমার ক্ষিদে পাচ্ছে, কখন তেষ্টা পাচ্ছে, কী পড়তে চাই, কী পরতে চাই, কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই, মেলতে চাই হৃদয়,

আমি বোঝার আগেই বুঝতে তুমি। সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে। থাকতে নেপথ্যে। তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে যত সুখ আছে সব নিয়েছি নিজের জন্য।

তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালোবাসেনি, আমিও দিইনি, বাসিনি। তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ। তুমি কি মানুষ ছিলে? মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনো দিন, দাসী ছিলে, দাসীর মতো সুখের জোগান দিতে। জাদুকরের মতো হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই দিতে।

একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে, ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা। তুমি কি মানুষ ছিলে! তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি,
দাবার ঘুঁটি, মানুষ ছিলে না।

তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে, ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে, তোমার বেদনার ভার একাই বইতে তুমি, তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছ। কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।

জাদুকরের মতো সারিয়ে তুলতে অন্যের অসুখ-বিসুখ, তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ, আমি তো নইই, বরং তোমাকে, তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়েমাংসেমজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই। যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে। যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি। তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে চাপা পড়ে আছে আমার দম্ভ।

যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি, সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি। কী করে পারব বল! আমি তো তোমার মতো অত নিঃস্বার্থ নই, আমি তো তোমার মতো অত বড় মানুষ নই।’

তসলিমা নাসরিনের লেখা এখন ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে ‘প্রথম আলো’য় আমাদের সহকর্মী রোজিনা ইসলামকে কারাগারে নেওয়া হলে আমি আদালতের বাইরে রাস্তায় বসে কেঁদেছিলাম। তার ভিডিও দেখে তসলিমা নাসরিন স্ট্যাটাস লিখেছেন:

‘কে বলেছে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ করতে জানে না? খুব জানে। এই যে রোজিনা নামের এক সাংবাদিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকেরা হেনস্তা করল, এর প্রতিবাদ করতে তো ঝাঁপিয়ে পড়েছে শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, যদু মধু রাম শ্যাম সকলে। লেখক আনিসুল হককে হাপুস নয়নে কাঁদতেও দেখা গেল। সহকর্মীর জন্য কেঁদেছেন। এক কাগজে রোজিনা ইসলাম আর আনিসুল হক—দুজনই লেখেন কিনা।
আনিসুল হক আর আমিও কিন্তু একসময় এক কাগজে লিখতাম। সাপ্তাহিক ‘পূর্বাভাস’–এ। পত্রিকা অফিসে আমাদের দেখাও হতো, আড্ডাও হতো। আমার ওপর যখন অন্যায়ভাবে অত্যাচার করল সরকার, আমাকে দেশ থেকে তাড়াল, ২৭ বছর আমাকে দেশে ফিরতে দিল না, তখন কী করেছিলেন তিনি? এমন অবিশ্বাস্য ভয়াবহ অত্যাচারের কথা জেনেও তিনি কিন্তু আমার জন্য চোখের জল ফেলেননি। হয়তো আমার সঙ্গে সেই হৃদ্যতা ছিল না, যে হৃদ্যতা রোজিনার সঙ্গে আছে।

তসলিমা নাসরিন

কিন্তু আমার নামটিও একবার কোথাও উচ্চারণ করেছেন বলে শুনিনি। শুষ্ক চোখেও তো কোনো দিন কোথাও দায়সারাভাবেও বলেননি যে, একজন লেখকের ওপর সরকার অন্যায় করছে। তাহলে আনিসুল হকের চোখের জলের পেছনে ব্যক্তিগত হৃদ্যতা আছে, মানবতা নেই। মানবতা থাকলে সব অত্যাচারিতের জন্য কাঁদতেন, অথবা নিদেনপক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন।

শুধু আনিসুল হক কেন, বাংলাদেশের কোনো শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী তো প্রশ্ন করেন না, সরকার কেন আমাকে দেশে প্রবেশ করতে দেয় না। প্রতিবাদ যে তাঁরা করতে জানেন না অথবা করতে ভয় পান, এমন তো নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন, দেশ নষ্ট হয়ে গেছে, ওই দেশে গেলে অত্যাচার করবে, না যাওয়াই ভালো।
ঠিক এভাবে রোজিনাকে কিন্তু কেউ বলেননি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নষ্ট হয়ে গেছে, ওখানে গেলে অত্যাচার করবে, না যাওয়াই ভালো। বরং তারা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার, এবং অত্যাচারিত না হওয়ার অধিকার দাবি করছেন। প্রতিবাদে কাজও হয়েছে, অন্যায় যাঁরা করেছেন, তাঁদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে।

মাঝে মাঝে আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে দেশের একটি ভয়াবহ অন্যায় নিয়ে ২৭ বছর মানুষ কী করে চুপ করে আছে। অথচ ক্ষুদ্র কিছু অন্যায় নিয়ে চিৎকার করে বেশ গলা ফাটায়। আসলে সরকার আমাকে নির্ভাবনায় নির্যাতন করছে, কারণ জানে দেশের বুদ্ধিজীবীরা অন্য যেকোনো নির্যাতন নিয়ে মুখ খুললেও এই নির্যাতনটি নিয়ে মুখ খুলবে না। বেছে বেছে প্রতিবাদ যারা করে, তাদের ধিক্কার জানাই।’

রোজিনার সঙ্গে আমার কোনো স্পেশাল হৃদ্যতা নাই। সহকর্মী হিসেবে কর্তব্যবোধ আছে। রোজিনার মেয়েটা, আলভিনা, আমাকে মামা মামা বলে ডাকে। একজন নারী কর্মব্যপদেশে ঘরের বাইরে কর্মস্থলে (সচিবালয় রোজিনা ইসলামের ‘বিট’ ছিল) এসে আর শিশুকন্যার কাছে ফিরতে পারবেন না, জামিনযোগ্য মামলাতেও জামিন দিতে দেরি করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে, এটা ভাবতে গিয়ে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম।

তসলিমাকে নিয়ে আমি সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’–এ লিখেছিলাম। তিনি তখন গ্রেপ্তার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। সম্ভবত তাই লেখাটি তিনি পড়ে ওঠার সময় করে উঠতে পারেননি। আমি লিখেছিলাম, স্টেটসম্যান ভুল ছেপেছে, তসলিমা এই কথা বলতে পারেন না, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই এ কথা বলতে পারেন না, তাই তসলিমার প্রতিবাদটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর লিখেছিলাম, তসলিমার উচিত দেশে থাকা। যা কিছু করার দেশে থেকেই করতে পারতে হবে। তাতে দেশের মানুষের উপকার হতে পারে। আমার লেখার সুরটা ছিল এমন। অনেক দিন আগের কথা। স্মৃতি প্রতারণা করতে পারে।

বিদেশে বসে যাঁরা দেশকে ঠিকপথে চলার জন্য উপদেশ দেন, দেশের সমালোচনা করেন, তাঁদের দেশপ্রেম বা উপদেশের যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু তাঁদের বাস্তবতা-বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়।

একটা কৌতুক বলে লেখাটা শেষ করি:
একজন রুশ আর একজন আমেরিকান তর্ক করছে। আমেরিকানটা বলল, আমাদের দেশে এত বাকস্বাধীনতা আছে যে আমি হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারব, মিস্টার বাইডেন, আমি আপনার শাসন পছন্দ করি না।
রুশ বলল, আমাদেরও এই বাকস্বাধীনতা আছে। আমিও হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারব, মিস্টার বাইডেন, আমি আপনার শাসন পছন্দ করি না।