গতকাল মারা গেছেন কথাসাহিত্যিক রাহাত খান। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।
রাহাত খানের কথা উঠলেই সবাই দেখি প্রথমেই বলে ‘দিলুর গল্প’-এর কথা। আমি ‘দিলুর গল্প’ পড়েছি অনেক পরে। যখন প্রচলিত অর্থে ‘দিলুর গল্প’ পড়ার বয়স পেরিয়ে এসেছি। যদিও কিছু বই আছে, সেসব পড়ার বয়স বলতে কিছু থাকে না। আমি তো এখনো ফেলুদা আর শঙ্কু পড়ে দারুণ মজা পাই। ‘দিলুর গল্প’ও ভালোই লেগেছিল।
কথা এটা না। যা বলব বলে এই ভূমিকা, তা হলো আমার কাছে রাহাত খান মানে ‘দিলুর গল্প’ না, রাহাত খান মানে ‘অমল ধবল চাকরি’। এই বইয়ের মাধ্যমেই রাহাত খানের সঙ্গে আমার পরিচয়। তা কত বছর আগে?
৩২-৩৩ বছর তো হবেই। তখন কেনা বইটা এখনো আমার কাছে আছে। মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। যেটি খুলে দেখছি, মার্চ ১৯৮২-তে প্রথম প্রকাশ। ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে দ্বিতীয়। তার মানে আমার কাছে দ্বিতীয়বার ছাপা হওয়া বইটাই। এত বছর আগের কথা, কিন্তু এই বইটা পড়ে খুব ভালো লাগার সেই অভিজ্ঞতা এখনো মনে করতে পারি। মনে আছে বই কেনার গল্পটাও। তখন আমি খুলনায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। বই পড়ার নেশা কৈশোর থেকেই, তখন যোগ হয়েছে কেনার। কিনতাম সারা বছরই। তবে পরীক্ষার অসহনীয় চাপ থেকে মুক্তির স্বউদ্ভাবিত উপায় হিসেবে পরীক্ষার সময় একটু বেশি বেশি। পিকচার প্যালেস সিনেমা হলের রাস্তার ওপারে তখন নিউজ কর্নার নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল (বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্রমাবনতির প্রমাণ দিয়ে সেটি যে অনেক দিনই বিলুপ্ত, তা বোধ হয় না বললেও চলে)। সপ্তাহে অন্তত দু–তিনবার এই নিউজ কর্নারে আমি যেতামই। নিয়মিত যাওয়া-আসা আর বই কেনার কারণে দোকানের মালিক ও বাকি বিক্রেতাদের সঙ্গে খুব খাতিরও হয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক দিনই হয়েছে, বই কেনার টাকা নেই। আমি গিয়ে বলতাম, আজ কোনো বই কিনব না। এক–দেড় ঘণ্টা শুধু বই নেড়েচেড়ে দেখব। ওঁরা বুঝে ফেলতেন, আমার মন খারাপ। সেই মন খারাপের ওষুধ যে বইয়ের সঙ্গে গল্প করা, সেটিও ওঁদের জানা হয়ে গেছে তত দিনে।
ওই দোকানে ক্রেতার নিজের হাতে বই নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বই ‘নেড়েচেড়ে’ দেখতে হলে ভেতরে ঢুকে বিক্রেতা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। আমাকে তাঁরা সাদরে ভেতরে ঢুকিয়ে নিতেন।
‘অমল ধবল চাকরি’ যেদিন কিনি, সেদিনও আমার কাছে টাকা নেই। একটার পর একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছি, শুরুটা পড়ছি, যেগুলো পছন্দ হচ্ছে, কিনতে পারছি না বলে সেগুলো রেখে দেওয়ার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি। এই ঘটনাপ্রবাহেরই কোনো একটা পর্যায়ে আমার হাতে এল ‘অমল ধবল চাকরি’। এত সুন্দর প্রচ্ছদ! কে করেছেন? কাভার উল্টে প্রচ্ছদশিল্পীর নামটা দেখলাম: হাশেম খান। এরপর শুরুর কয়েকটা লাইন পড়ে রীতিমতো চমকে গেলাম। এমন ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে একটা উপন্যাস শুরু হতে পারে!
কী ছিল সেই শুরু?
‘: রফিক, তোর চাকরি গেছে তুই জানিস?
রফিক ইন্টারকনের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম চিবুচ্ছিল। মুখ কালো করে বলে: খারাপ কথা বলিস না দোস্ত। মনিতেই আমার হার্টের অবস্থা ভালো না। ধুক ধুক করে।
: হ্যাঁ, হ্যাঁ। সত্যি তোর চাকরি গেছে। ইউ আর স্যাকড। গতকাল সন্ধ্যার দিকে তোর অফিসে গিয়েছিলাম, টুনু খবরটা দিল।
রফিক বাদাম চিবুনো বন্ধ করেছে। ব্যথিত মুখ। বলল: টুনু তো? মহা হারামি। তা কী বলল?’
উপন্যাস থেকে আমার আরও তুলে দিতে ইচ্ছা করছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করলাম। বইটি পড়তে পড়তে আমি সম্ভবত অস্ফুটে বলেছিলাম, ‘দারুণ তো! এই বইটা কিনতে হবে।’ দোকানের মালিক বললেন, ‘আজই নিয়ে যাও। টাকা পরে দিলেও চলবে।’ পরদিন কঠিন একটা পরীক্ষা, সেটিকে পাত্তা না দিয়ে বাকিতে কিনে আনা সেই বই সারা রাত জেগে পড়ে ফেললাম। প্রিয় লেখকের তালিকায় রাহাত খান নামটাও ঢুকে গেল।
কদিন পর নিউজ কর্নারে গিয়ে রাহাত খানের আর কী কী বই আছে খোঁজ করে ‘হে শূন্যতা’ পেলাম। এটাও ভালো লাগল, তবে ‘অমল ধবল চাকরি’র মতো নয়। তবে এই দুটি বই পড়ে রাহাত খানের লেখা নিয়ে একটা নেশা লেগে গেল। কিন্তু আর কোনো বই তো পাই না। নিউজ কর্নারে তো নেই-ই, খুলনার অন্য বইয়ের দোকানেও পেলাম না। মনে আছে এর কিছুদিন পর ঢাকায় এসে বাংলাবাজার চষে ফেলেও না।
বই না পেলেও প্রতি সপ্তাহেই রাহাত খানের সঙ্গে দেখা হতে লাগল। কিন্তু আমি তো এভাবে দেখা করতে চাই না।
রহস্য মনে হচ্ছে? আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই সম্ভবত সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায়
ধারাবাহিকভাবে ‘হে অনন্তের পাখি’ প্রকাশিত হতে শুরু করল। তবে দুই–তিন পৃষ্ঠা পড়ে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে উপন্যাস পড়া আমার কোনোকালেই পছন্দ নয়। পরে বই পড়ার সময় মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে আমি তাই কমনরুমে ‘রোববার’ পড়ার সময় ওই উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলো দ্রুত উল্টে যেতাম। পরে বই হয়ে বেরোনোর পর ‘হে অনন্তের পাখি’ পড়েছি। আশ্চর্যই বলতে হবে, ‘অমল ধবল চাকরি’ ও ‘হে শূন্যতার কাহিনি’ এত বছর পরও মোটামুটি মনে করতে পারলেও ‘হে অনন্তের পাখি’র কাহিনিটা একদমই মনে নেই। সেটি কি বেশি ভালো লাগেনি বলে? কে জানে!
মাঝখানে রাহাত খানের বেশ কয়েকটা ছোটগল্প খুব ভালো লেগেছিল। সর্বশেষ পাঠ অভিজ্ঞতাটা অবশ্য একদমই ভালো নয়। অনেক দিন রাহাত খানের কোনো উপন্যাস পড়ি না, ২০০৪ সালের বইমেলায় অনন্যার স্টলে ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ বইটা দেখে তাই একটু রোমাঞ্চিতই হলাম, রাহাত খানের নতুন উপন্যাস! কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে এমন হতাশ হলাম যে, রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেলাম। ঘটনা কী? লেখক রাহাত খানের অবনতি হয়েছে, নাকি পাঠক হিসেবে আমার ‘একটু বেশিই উন্নতি’! ‘অমল ধবল চাকরি’ নিয়েও মনে প্রশ্ন জাগল। তাহলে কি কাঁচা বয়স এবং পাঠক হিসেবে তখনো সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পা না পড়ার কারণেই এত ভালো লেগেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেক বছর পর ‘অমল ধবল চাকরি’ আবারও পড়তে শুরু করলাম। কই, এখনো তো ঠিকই ভালো লাগছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্যিটা মেনে নিলাম, পাঠক যেমন বদলায়, লেখকও। ওয়ানস আ গুড রাইটার ডাজন'ট মিন...।
বইটি পড়তে পড়তে আমি সম্ভবত অস্ফুটে বলেছিলাম, ‘দারুণ তো! এই বইটা কিনতে হবে।’ দোকানের মালিক বললেন, ‘আজই নিয়ে যাও। টাকা পরে দিলেও চলবে।’ পরদিন কঠিন একটা পরীক্ষা, সেটিকে পাত্তা না দিয়ে বাকিতে কিনে আনা সেই বই সারা রাত জেগে পড়ে ফেললাম। প্রিয় লেখকের তালিকায় রাহাত খান নামটাও ঢুকে গেল।
ঢাকায় আসার পর রাহাত খানের সঙ্গে চাইলেই দেখা করতে পারতাম। তাঁর সম্পর্কে যেসব গল্প শুনেছি, তাতে আগ্রহ না হওয়াটা অস্বাভাবিকই। মানুষটা নাকি খুব ইন্টারেস্টিং। আধুনিক, আড্ডাপ্রিয়...আরও যা শুনেছি, তাতে ‘প্লে বয়’ শব্দটাও মাথায় এসেছে। কিন্তু কোনো দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করিনি। তিনি তো আর শুধু লেখক ছিলেন না, বড় সাংবাদিকও। ছোট হলেও আমিও তো সাংবাদিক। ঘটনাচক্রে তাই কোনো অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যেতেই পারত। আমার ঘর+অফিসকুনো স্বভাবের কারণে সেটাও হয়নি। আমার ‘অসামাজিক’ স্বভাবের এমন আরও বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এই যেমন আমার এত প্রিয় ঔপন্যাসিক রশীদ করীম, যিনি ছিলেন আবার ক্রিকেটের পাগল, তাঁর সঙ্গেও কখনো দেখা হয়নি। ‘একদিন তাঁর কাছে যাব’ করতে করতে তিনিই চলে গেলেন। রশীদ করীমের মৃত্যুর পরও ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’, ‘আমার যত গ্লানি’, ‘প্রসন্ন পাষাণ’ প্রথম পড়ার স্মৃতি খুব মনে পড়ছিল। আর গতকাল রাহাত খানের মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে সেই কত বছর আগের ‘অমল ধবল চাকরি’তে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার স্মৃতি আমাকে ঘিরে ধরেছেও। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, আমার কাছে রাহাত খানের যে চারটি উপন্যাস আছে, তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে এটিকেই শুধু মেলানো যাচ্ছে না। নইলে বাকি তিনটি উপন্যাসের নাম দেখুন:
মৃত্যুর পর কী পড়ে থাকে?--‘হে শূন্যতা’।
মৃত্যুর পর সেই মানুষকে কী বলবেন--‘হে অনন্তের পাখি’...?
সেই পাখি যেখানে উড়ে যায়, সেটি কি ‘আকাশের ওপারে আকাশ’...?
আকাশের ওপারে যে আকাশ, সেখানে ভালো থাকবেন প্রিয় রাহাত খান!
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com