দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতিবিষয়ক লেখার ক্ষেত্রে শুধু অগ্রদূতই নন, তিনি অনন্য। তিনি বলতেন, পৃথিবী থেকে ঘাস-পাতা-ফুল—সব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বাড়ছে, তাদের চলার পথে তাদের পদভারে মরে যাচ্ছে অনেক তরুপল্লব। জনসংখ্যা কমানো না গেলে তরুপল্লবকে বাঁচানো যাবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
নিজের হাতে গড়ে তোলা প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লবের ‘গাছ দেখা গাছ চেনা’ শিরোনামের নিয়মিত আয়োজনে আজ শুক্রবার রমনা বটমূলে স্মরণ পর্বে দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তাঁর অনুসারীরা। প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বেড়াতে গিয়ে নিসর্গ সখা দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতি রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্মরণসভায় আগত প্রকৃতিপ্রেমীরা।
গত ২৯ মে ছিল নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার জন্মদিন। এবারই প্রথম তাঁকে ছাড়া জন্মদিনের আয়োজন করতে হলো তরুপল্লবকে। তাঁকে স্মরণ করে বিশিষ্টজন ও তরুপল্লবের সদস্যরা রমনা উদ্যানের মাধবী চত্বরে দ্বিজেন শর্মার নামে স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি করেছেন।
‘গাছ দেখা গাছ চেনা’ অনুষ্ঠানটি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগে ছিল দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ করে আলাপন, দ্বিতীয় ভাগে ছিল দুর্লভ গাছের চারা বিতরণ এবং তৃতীয় ধাপে ছিল রমনা উদ্যানের বিভিন্ন গাছ চেনা পর্ব। দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ করে কথা বলেন কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড নেচারাল রিসোর্সেসের (আইইউসিএন) সাবেক বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ, তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন, তরুপল্লবের সদস্য শাহানা চৌধুরী, কেকা অধিকারী, এনা সুলতানা, রাজিয়া সামাদ প্রমুখ।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা তরুপল্লবের কাছে ঋণী। কেননা মানুষের আগে তরুপল্লবের কারণেই পৃথিবী বাসযোগ্য হয়েছে। তাই প্রকৃতিকে ভালোবেসে আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে।’
দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ করে তিনি বলেন, পাখিকে স্মরণ করলে সাদাত সেলিম, তারাকে স্মরণ করলে আবদুল জব্বার আর প্রকৃতিকে স্মরণ করলে দ্বিজেন শর্মার নাম আসে। বৃক্ষের কথা যখন বলতে হয়, তখন দ্বিজেন শর্মা প্রাতঃস্মরণীয়।
পরিবেশবিদ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ বলেন, সিলেটের বরলেখা উপজেলায় দ্বিজেন শর্মার জন্মভূমি পাথারিয়ায় বন যখন উজাড় হতে চলেছে, তখন বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা জীববৈচিত্র্য নিয়ে তিনি সম্মিলিত আন্দোলনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী দ্বিজেন শর্মা সামাজিক বৈষম্য নিয়েও চিন্তিত ছিলেন।
দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ করে তিনি আরও বলেন, ‘তিনি না থাকলেও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কাছে আমরা, আমাদের সমাজ ও জাতি ঋণী। দ্বিজেন শর্মা সমাজের মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন খুঁজতেন। প্রকৃতি তাঁর শুধু ভালো লাগার জায়গা ছিল না, প্রকৃতির প্রতি তাঁর আলাদা একটা মমতা ছিল।’
মোকারম হোসেন বলেন, দ্বিজেন শর্মার হাত ধরেই ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর রমনা উদ্যানে গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তরুপল্লবের যাত্রা শুরু। এ উদ্যানের মাধবী চত্বরে দ্বিজেন শর্মার নামে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি করে তিনি বলেন, এর ফলে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করার একটি স্থান তৈরি হবে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ভাগে তরুপল্লবের সদস্য ও অনুষ্ঠানে আগত ব্যক্তিদের মধ্যে দেশীয় দুর্লভ গাছের চারা বিতরণ করা হয়। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে এ চারা বিতরণ করা হয়। বিতরণ করা চারার মধ্যে রয়েছে মাধবী, বাসক, তুলসী, ট্যাবেবুইয়া, কালোমেঘ, নীলঘণ্টা, কুম্ভিপাতা, ইদাল। এসব গাছের চারা টব ও টবের বাইরে লাগানো সম্ভব। তৃতীয় ভাগে ছিল গাছ চেনানো।
দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় মারা যান অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। ১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় দ্বিজেন শর্মার জন্ম। উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতিবিজ্ঞান আর বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে লিখে গেছেন প্রায় দেড় ডজন বই।
দ্বিজেন শর্মা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য আজীবন প্রচার চালিয়ে গেছেন তিনি।