এ বইটি যাঁরা আগাগোড়া পাঠ করবেন, তাঁরা লেখকের ভূমিকা-ভাষ্য থেকে জানবেন, ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল যদি শুধু একটি ছাত্রাবাস হতো, তাহলে তার জন্মের ইতিহাস অল্প কয়েক পৃষ্ঠাতেই লেখা যেত। কিন্তু মুসলিম হল শুধু একটি আবাসিক হল ছিল না, মুসলিম হল একটি প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠানের প্রথম দুই দশকের পাঠ্যবহির্ভূত যে কর্মযজ্ঞ, তা পরিমাপের দিক থেকে এবং গুণগত বিচারে জাতির আর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনীয় নয়।’ সত্যিই তাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা যেমন, তেমনি তার শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক স্থল মুসলিম হল, যা পরবর্তীকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নাম ধারণ করে, তার প্রতিষ্ঠা ও বাঙালি মুসলমান সমাজের আলোকিত অগ্রযাত্রায় সেটি যে ভূমিকা পালন করে, তা অবিস্মরণীয় ইতিহাস হয়ে আছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং তার প্রথম উপাচার্য ফিলিপ হার্টগকে নিয়ে আলাদা দুটি বই লিখেছেন। বই দুটি শুধু আমাদের উচ্চতর শিক্ষার দ্বার উন্মোচনের বিবরণগত বাহন হয়ে ওঠেনি, আমাদের ভৌগোলিক সীমাচিহ্নিত ভূখণ্ডের বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ঐতিহাসিক ও অগ্রচারীর ভূমিকা পালন করেছে, তারও সবিস্তার বিবরণ তুলে ধরেছে।
আমরা যাঁরা ইতিহাসবিমুখ, বিশেষত সামাজিক ইতিহাস পাঠে অনীহ, তাঁরা সৈয়দ আবুল মকসুদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শিরোনামের এ বইটি পাঠ করার পর ধারণা পাবেন যে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি আবাসিক হল কী করে তার জন্মের অব্যবহিত পর থেকে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে।
পরিশিষ্টের নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি, সাক্ষাৎকার ও নির্ঘণ্ট বাদে ৪৩টি অধ্যায়ে রচিত এ বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়গুলো হলো ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন: একটি নূতন স্পন্দন’, ‘ইসলাম ও মুসলমান’, ‘অ্যান্টি পর্দা লীগ’, ‘সমাজসেবা সমিতি’, ‘ছাত্রাবাস নয়: একটি প্রতিষ্ঠান’, ‘শহীদুল্লাহর মুসলিম হল বন্দনা’, ‘সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য আলোচনা’, ‘নাট্যচর্চা’, ‘সংগীতচর্চা’, ‘খেলাধুলা ও শরীরচর্চা’, ‘হলে বিশিষ্টজন’ ও ‘হল জীবনের স্মৃতি’ ইত্যাদি।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এ দেশের ধর্মান্ধ ও গোঁড়া মুসলমান সমাজকে মুক্তচিন্তার আলোকে আলোকিত করার ব্রত গ্রহণ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকের সেই রক্ষণশীল সময়পর্বে এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড ছিল সত্যিকার অর্থেই বৈপ্লবিক। তারা প্রকাশ করেছিল শিখা শিরোনামের একটি পত্রিকা। তাঁদের ঘোষিত স্লোগান ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই আন্দোলন ১৯২৬ থেকে শুরু হয়ে চলেছিল ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।
পর্দাপ্রথাবিরোধী আন্দোলনেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছিল অগ্রগণ্য জোরদার ভূমিকা। এখান থেকে সংঘবদ্ধ যে আন্দোলনের সূচনা, তার দূরপ্রসারী নানা প্রভাব পড়ে আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে আরও অনেককাল পর্যন্ত।
আবুল মকসুদ তাঁর প্রখর অনুসন্ধিৎসু ও তত্ত্বানুসন্ধানী সামাজিক ইতিহাসকার হিসেবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের জন্মকালীন বিবর্তন থেকে শুরু করে তার পরিণতকালের বিবরণ তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এই ভূখণ্ডের আর্থিকভাবে অসচ্ছল পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণে উল্লিখিত হলটির সঙ্গে জড়িত শিক্ষাবিদ ও ছাত্ররা যেসব কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করেছেন, তার বিস্তারিতভাবে বিবরণও দিয়েছেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অসংখ্য বিরল দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে হয়েছে, সাক্ষাৎকার নিতে নিয়েছে বহু ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের, এমনকি অনেক স্মৃতিকথারও।
এ বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সৈয়দ মকসুদ যা তুলে ধরতে কসুর করেননি, তা হলো, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাহিত্য-সংস্কৃতি, নাট্য ও শরীরচর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই পরবর্তীকালে তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশ ও সমাজবরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদেরই স্বপ্ন ও কর্মগুণের পথ অনুসরণ করে নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে বাঙালির প্রথম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা এবং তা বাস্তবে পরিণত হতেও আমরা দেখি। এ ক্ষেত্রে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের যে ভূমিকা, তা ঐতিহাসিক।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সৈয়দ আবুল মকসুদকে নিশ্চিতই এনে দেবে শ্রমপ্রবণ সেই গবেষকের মর্যাদা, আমাদের দেশে যে ধরনের গবেষকের অভাব সত্যিই প্রকট।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৯, ২৭৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৫০০ টাকা।