মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সাল ১৯৯৬। বইমেলা। বাংলা একাডেমি চত্বরেই বইমেলা হচ্ছে। বর্ধমান হাউসের উল্টা দিকে পুকুরের পারে দিনরাত্রি প্রকাশনীর স্টল। সেখানে পাওয়া যায় আহসান হাবীব ভাইকে। তিনি উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক। দিনরাত্রি নামের প্রকাশনা সংস্থারও সম্ভবত মালিক। আহসান হাবীব ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনাকে জাফর ইকবালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আপনি একটু দাঁড়ান।’
তার আগে তো আবার আহসান হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো কীভাবে, সেটা বলতে হয়। আমি ছোটবেলা থেকেই উন্মাদ পত্রিকার অন্ধভক্ত ছিলাম। কী মজার মজার কার্টুন-কৌতুক-কমিকই না প্রকাশিত হতো উন্মাদ পত্রিকায়! ছোটবেলায় একটা ছেলে গিটার বাজাচ্ছে, বড়রা আশা করছেন, বড় হয়ে এই ছেলে বিশাল সংগীতজ্ঞ হবে। বড় হয়ে ছেলে হলো ধুনকার। তুলা ধুনে, তুলাধুনা করে, লেপ বানায়, বালিশ বানায়। ছোটবেলায় ছেলে তবলা বাজায়, বড় হয়ে সে চাকরি নিল মিরপুর-গুলিস্তান বাসে, বাসের গায়ে চাপড় মারে আর চিৎকার করে—ডাইরেক্ট গুলিস্তান। উন্মাদের কিছু কৌতুক ছিল একেবারে চরম। আমজাদ হোসেনকে ‘অয়োময়’ নাটকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কারণ কী? ‘ছাইড়া দিলে যদি আমি গিয়া ঈদের নাটক লেইখা ফেলি।’
তো ১৯৮৯ সালে আমার নিজের কবিতার বই আমরা নিজেদের উদ্যোগে বের করে ফেললাম। রম্য রহিম ছাপা, বাইন্ডিং, প্রচ্ছদ ইত্যাদির দায়িত্ব নিলেন। তিনি বুয়েটের আর্কিটেকচারে পড়েন, আমার এক বছরের জুনিয়র। বুয়েটে আমার এক বছরের জুনিয়র আর্কিটেকচারের ছেলেদের সঙ্গেই ছিল আমার বেশি খাতির। কারণ, তাঁরা শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যেমন তৌকীর আহমেদ। তিনি থিয়েটার করেন। ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নামের ধারাবাহিক নাটক করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। রম্য রহিম ভালো ডিজাইন করেন, ছাপাখানার কাজ বোঝেন। নব্বীর সায়েন্স ম্যাগাজিন বের করেন। শাকুর মজিদ লেখালেখি করেন, ফটো তোলেন, সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত। তো আমার প্রথম বই, কবিতার—‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ বের হওয়ার পর নিজেই বইমেলায় মাদুর বিছিয়ে এবং পরে একটা ছোট টেবিল পেতে বিক্রি করতাম, সে খবর আপনারা জানেন। আমার বইটা পড়েন আর্কিটেকচারের বড় ভাই মাহফুজুর রহমান (কোনো একবার পানিশমেন্ট খেয়ে বছর দুয়েক নষ্ট করে তিনি আমাদের সমসাময়িক হয়ে গিয়েছিলেন)। মাহফুজ ভাইয়ের সবকিছু আমার ভালো লাগত। মজার মজার কথা বলে হাসাতেন। কিন্তু নিজে হাসতেন না। খুব সুন্দর ছবি আঁকতেন। আমি তাঁর ভক্ত হয়ে তাঁর পেছন পেছন ঘুরতাম। মাহফুজ ভাই পরে বিসিএস দিয়ে ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি যখন পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত, তখন আমি ওয়ারশতে গিয়ে তাঁর বাসভবনে ছিলাম এবং ভাবিসহ ব্যাপক ঘোরাঘুরি করেছি। তো সেই মাহফুজ ভাই আমার কবিতার বই পড়ে একটা পুস্তক-সমালোচনা বা রিভিউ লিখে নিয়ে আমার শহীদ স্মৃতি হলের রুমে চলে এলেন। বললেন, ‘মিটুন, তুমি তো ভালো কবিতার বই লিখে ফেলেছ। নাও। তোমার বইয়ের রিভিউ।’ মাহফুজ ভাইয়ের লেখা আমার কবিতার বইয়ের রিভিউটা কোথাও ছাপা হয়নি। কিন্তু ভীষণ অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলাম।
এখন আমার বই বইমেলায় মাঠে বিক্রি হয়। কোনো স্টলে থাকে না। মাহফুজ ভাই বললেন, ‘চলো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোমার বই স্টলেও থাকবে।’ তিনি বইমেলায় আমাকে নিয়ে গেলেন দিনরাত্রি প্রকাশনীতে। আহসান হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আহসান হাবীব ভাই বললেন, ‘দেন, আপনার বই দেন। আমরা রাখব।’ তিনি কুড়ি কপি বই রেখেছিলেন। গোটা বারো বিক্রি হয়েছিল। বইমেলার শেষ দিনে অবিক্রিত বই আর বিক্রির টাকা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা ১৯৮৯ সাল। তখন থেকে আমি আহসান হাবীব ভাইকে চিনি। আমি উন্মাদ পত্রিকায়ও একাধিকবার রম্য রচনা লিখেছিলাম। উন্মাদ পত্রিকা অফিসেও আমি গিয়েছিলাম। অফিসটা মোহাম্মদপুর বা লালমাটিয়া এলাকায় ছিল তখন।
এর পর থেকে প্রতিবছর আমি বইমেলায় আহসান হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতাম। আমি ভোরের কাগজে ‘বইমেলা প্রতিদিন’ কলামও লিখতাম। সে জন্যও লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গে আমার খাতির ছিল। হাবীব ভাই আমাকে বললেন, তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবেন।
কারণ কী?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমেরিকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি লেখা পাঠাতেন। ঢাকায় তাঁর বই বের হতো। ‘কপোট্রনিক সুখদুঃখ’ বেরুনোর পর তিনি রীতিমতো বিখ্যাত লেখক। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের তিনি প্রবক্তা এবং সায়েন্স ফিকশনকে তিনি প্রায় একাই জনপ্রিয় করে তুলেছেন। আমি প্রতীক/ অবসর থেকে বেরুনো মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘সায়েন্স ফিকশনসমগ্র’ কিনে পড়ে ফেলেছি। এই লেখকের আমি রীতিমতো ভক্ত। এখন আমেরিকা থেকে এসে জাফর ইকবাল স্যার তাঁর ছোট ভাই আহসান হাবীবকে জিজ্ঞেস করলেন, নতুনদের মধ্যে কারা ভালো লিখছেন?
আহসান হাবীব বললেন, ‘একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’
আমি দিনরাত্রি প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার এলেন। হাবীব ভাই বললেন, এর নাম আনিসুল হক। এর বই ভালো চলছে।
সেবার আমার ‘খেয়া’ নামের একটা উপন্যাস বেরিয়েছিল, প্রকাশক ছিল মম প্রকাশনী। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের হাতে আমার নতুন বই এক কপি দিয়েছিলাম কি না, আজ আর মনে করতে পারছি না।
তখন আমরা কাজ করি ভোরের কাগজে। আমি সেখানে কলাম লিখি ‘গদ্যকার্টুন’। একবার বিজয় দিবসে ভোরের কাগজে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটা কলাম পড়ে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। স্যারের বাবা একাত্তরে শহীদ হয়েছেন। আবার স্যার ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের এক শিশুর কথা লিখেছেন, যার বাবা ছিল বিহারি, শিশুটি মৃত বাবার লাশের পাশে বসে কাঁদছিল। আমি স্যারের লেখার চিরকালের ভক্ত হয়ে গেলাম। রাজনীতির চেয়ে মানবিকতা বড়, এই বোধ আামাকে মোহিত করেছিল। আমি আমার লেখা কলামে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখাটি পাঠ করার জন্য সুপারিশ করেছিলাম।
পরে মুহম্মদ জাফর ইকবালের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়ে গেল। কী কলামলেখক হিসেবে, কী ‘আমি তপু’ কিংবা ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ বা ‘দীপু নম্বর টু’র লেখক হিসেবে, কী সায়েন্স ফিকশনের লেখক হিসেবে স্যার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। প্রথম আলোয় যখন তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো, তখন একেকটা কলাম বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশ নড়ে উঠত। একবার সরকার দেশে শীতকালীন সময় আর গ্রীষ্মকালীন সময় আলাদা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। শীতের দেশের মতো দিনের আলো বাঁচানোর উদ্যোগ, স্যার প্রথম আলোয় এক কলাম লিখে তা বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও স্যার অনেক সাহসী লেখা লিখেছিলেন।
জাফর ইকবাল স্যার একবার গল্প করেছিলেন—আমেরিকায় এক প্রবীণ লেখিকা তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘ডোন্ট রুইন ইয়োর স্টোরিজ উইথ ফ্যাক্টস (সত্য ঘটনা বলে গল্প নষ্ট কোরো না)।’ আমার সঙ্গে স্যারের চেহারার বাহ্যিক কিছু মিল আছে। স্যারের চুলও পাকা, আগে ছিল সাদাপাকা, গোঁফ আছে, আমারও তা–ই, সাদাপাকা চুল বা পাকা চুল এবং সাদাপাকা গোঁফ। তবে স্যার অনেক স্লিম। অনেক সুদর্শন। চোখ দুটো স্যারের অনেক বেশি উজ্জ্বল। তা সত্ত্বেও লোকে ভুল করে আমার কাছে আসেন, এসে অটোগ্রাফ চান। তারপর বলেন, ‘আপনার “আমি পরামানব” বইটা খুব ভালো।”
আমাকে তিনি প্রথম প্রথম বলতেন, ‘আপনি আমাকে স্যার বলে ডাকেন কেন?’ আমি তারপরও ‘স্যার’ বলি দেখে তিনি আশা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে স্যারই বলবেন?’
স্যারের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি।
মজার কিছু ঘটনা আগে বলে নিই।
অধ্যাপক ইয়াসমিন হক একবার একটা মজার গল্প করেছিলেন। হুমায়ুন ফরীদি ভাই একবার তাঁর সঙ্গে একই ফ্লাইটে পাশাপাশি বসে ফ্লাই করেছিলেন। জাফর ইকবাল স্যার সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে গল্প করেছেন, কিন্তু তিনি জানতেন না যে হুমায়ুন ফরীদি কে!
জাফর ইকবাল স্যার একবার গল্প করেছিলেন—আমেরিকায় এক প্রবীণ লেখিকা তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘ডোন্ট রুইন ইয়োর স্টোরিজ উইথ ফ্যাক্টস (সত্য ঘটনা বলে গল্প নষ্ট কোরো না)।’
আমার সঙ্গে স্যারের চেহারার বাহ্যিক কিছু মিল আছে। স্যারের চুলও পাকা, আগে ছিল সাদাপাকা, গোঁফ আছে, আমারও তা–ই, সাদাপাকা চুল বা পাকা চুল এবং সাদাপাকা গোঁফ। তবে স্যার অনেক স্লিম। অনেক সুদর্শন। চোখ দুটো স্যারের অনেক বেশি উজ্জ্বল। তা সত্ত্বেও লোকে ভুল করে আমার কাছে আসেন, এসে অটোগ্রাফ চান। তারপর বলেন, ‘আপনার “আমি পরামানব” বইটা খুব ভালো।” আমি বলি, ‘আপনি আমাকে জাফর ইকবাল ভেবেছেন, অসুবিধা নেই, উনি আমার ভাই।’ তাতে যিনি অটোগ্রাফ বা সেলফি নিতে আসেন, তিনি আরও বেশি দ্বিধায় পড়ে যান। তবে স্যার আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেন, তাঁকেও লোকে আনিসুল হক বলে এক-আধবার ভুল করেছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে আমার সবচেয়ে মজার স্মৃতি হলো, আমি স্যারের সঙ্গে একবার দৌড়ের পাল্লা দিয়েছিলাম। সেটা ঘটেছিল ময়মনসিংহের এক বাজার এলাকায়। আমরা শেরপুর গিয়েছিলাম। স্যারের এক ছাত্র আমাদের শেরপুরের একটা অনুষ্ঠানে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় আমরা ময়মনসিংহ হয়ে ফিরছি। আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আমি মালাইকারি কিনব।’ মালাইকারি ময়মনসিংহের বিখ্যাত মিষ্টি। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। মালাইকারির দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াতে লাগলাম। স্যারও আমার সঙ্গে দৌড়াতে লাগলেন। মালাইকারি আমাদের কিনতেই হবে। ময়মনসিংহের বাজারের লোকেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে, দুইজন সাদাপাকা চুলের গোঁফওয়ালা লোক দৌড়াচ্ছেন। ব্যাপার কী!
আমি মিষ্টির ভক্ত। স্যার কোনো খাওয়াদাওয়াই পছন্দ করেন বলে জানা যায় না। গণিত অলিম্পিয়াড করতে আমরা বহু জায়গায় একসঙ্গে গেছি। দুপুর হলে আমি স্কুলের হেডমাস্টারের রুমে গিয়ে ঢুকি, মোরগ-পোলাও আসবে বলে আর স্যার সারা দুপুর না খেয়ে ছেলেমেয়েদের অটোগ্রাফ দেন। বছর দুয়েক আগে আমরা চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম একসঙ্গে, বইমেলা করতে। বাদল সৈয়দ ভাই লেখক এবং সমাজসেবক। তাঁর বাড়িতে আমাদের দাওয়াত করলেন রাতের খাবার খেতে। প্রখ্যাত লেখক হাসনাত আবদুল হাইও ছিলেন। আমি তো খাবার দেখে খুশিতে আটখানা। স্যার যথারীতি সামান্যই খেলেন।
স্যারদের মা আয়েশা ফয়েজও আমাকে খুব আদর করতেন। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের মৃত্যুর পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মরণসভায় আমরা একসঙ্গে ঢাকা থেকে গিয়ে যোগ দিয়েছিলাম। জাফর ইকবাল স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। ইয়াসমিন ভাবি শক্তহাতে সবকিছু সামলান। ওই সময় খালাম্মা—আয়েশা ফয়েজ আমাকে আলাদা করে একটা ঘরে ডেকে নিয়েছিলেন। কিছু কথা তিনি শুধু আমাকে বলতে চান। বলেছিলেন, ‘আমাদের সোনার সংসার ছিল...’(বাকিটা আমি এখন বলব না। আরও দশ বছর পর বলব।)
মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তচিন্তার পক্ষে স্যারের অনড় অবস্থান সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। স্যারকে সে জন্য হামলার শিকার হতে হয়েছে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় কলাম লিখেছিলাম। স্যার তখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। স্যারকে দেখতে যাব। ক্যান্টনমেন্টে ঢোকা গেল, সিএমএইচে যাব বললেই হয়ে যায়। কিন্তু এরপর? হাসপাতালের ভেতর ঢুকব কী করে? সাদাপাকা চুল অনেক সাহায্য করে। হাসপাতালের চিকিৎসক–পরিচালকেরা আমাকে স্যারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আরেকবার স্যার মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। দেশজুড়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গিয়েছিল। তবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা কায়কোবাদ স্যারের মতো গুরুত্বপূর্ণ লোকদের নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড শেষে রাত দুইটায় একটা আধা ভাঙা মাইক্রোবাস যেভাবে খুলনা কিংবা কুমিল্লা থেকে ফিরত, তাতে তাঁরা যেকোনো দিন দুর্ঘটনায় পড়তে পারতেন।
গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রথম আলো অফিসে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার ও কায়কোবাদ স্যার এসেছেন। সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছে তাঁরা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এক—গণিতের জন্য সপ্তাহে একটা পাতা দিতে হবে। দুই—গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে থাকতে হবে। দেশের প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়েছিল। এর পেছনে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের অবদান আছে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে গণিত জনপ্রিয় করায় এবং পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে গণিত অলিম্পিয়াডের অবদান অপরিসীম।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমার ‘মা’ বইয়ের আলোচনা লিখে দিয়েছেন। ‘যারা ভোর এনেছিল’ বইয়ের শেষ মলাটে একটা ছোট্ট প্রশংসাবাণী আছে, সেটা জাফর ইকবাল স্যারের লেখা। স্যার এবং ইয়াসমিন ভাবি ‘যারা ভোর এনেছিল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। এ বছর বইমেলায় মুজিব গ্রাফিক নভেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তিনি বক্তৃতা করতে গিয়ে ‘যারা ভোর এনেছিল’ সিরিজের কথা পাড়লেন। আমি নানাভাবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কাছে ঋণী।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কাছ থেকে শোনা একটা কৌতুক বলি।
একবার এক লোক এসেছেন সিলেটে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে দেখা করবেন। স্যারের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। দর্শনার্থী বলতে লাগলেন, ‘আমি বহু দূর থেকে এসেছি। আসতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আমি কি আপনার হাত ধরতে পারি?’
‘জি পারেন।’ স্যার হাত ধরলেন।
দর্শনার্থী বললেন, ‘এটা কি সত্যি যে আপনি হুমায়ূন আহমেদের ভাই?’
জি। সত্যি।
আমার জীবন আজ সার্থক। আমি হুমায়ূন আহমেদের ভাইয়ের হাত স্পর্শ করতে পেরেছি।
আমার মেয়ে পদ্যকে তার ছোটবেলায় আমি তিনটা বই দিয়েছিলাম। ছোটদের তিনটা বই। একটা আমার লেখা। একটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা। আরেকটা মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা। তিনটা পড়ে পদ্য বলল, জাফর ইকবালেরটা ভালো। ওই বইয়ে একটা লাইন ছিল। ‘তোমার গোসল আনন্দময় হোক।’ মাত্র ১০ এপ্রিল ২০২২ পদ্য নিউইয়র্ক থেকে ফোন করল। আমি আর মেরিনা লেকের ধারে হাঁটব বলে রাত্রি আটটায় বাসা থেকে বের হচ্ছি। তখনই পদ্যর ফোন এলে। পদ্য বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ আমি বললাম, হাঁটতে। পদ্য বলল, ‘তোমাদের হাঁটা আনন্দময় হোক।’ প্রায় কুড়ি বছর আগে পড়া মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইয়ের সংলাপ পদ্য ব্যবহার করল। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা জাদুকরি ক্ষমতা আছে। তিনি ছোটদের মন বুঝতে পারেন। এই ক্ষমতা খুব অল্প লেখকেরই থাকে।
স্যার একদিন ফোন করলেন, ‘বলেন তো এই বিষয়ে ভালো বই কী কী আছে?’ আমার যা জানা ছিল, বললাম। বুঝতে পারলাম, স্যার এবার একটা বড় উপন্যাস লিখতে যাচ্ছেন।
কোন বিষয় নিয়ে, সেটা আর বললাম না। আমরা দু–এক বছর পর নিশ্চয়ই মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা একটা বড় উপন্যাস পেতে যাচ্ছি।