মুনীর চৌধুরী: আমার ও সকলের

মুনীর চৌধুরী: (২৭ নভেম্বর ১৯২৫—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
মুনীর চৌধুরী: (২৭ নভেম্বর ১৯২৫—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

‘ছেচল্লিশ বছর বয়সে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে নিহত একজন অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষের নাম মুনীর চৌধুরী।’ অনেক বছর আগে আমি এই বাক্যটি লিখেছিলাম, অসাধারণ প্রতিভাধর বলতে কী বোঝাতে চেয়েছি, তারও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম—আদর্শ শিক্ষক ও কুশলী বক্তা, সফল নাট্যপ্রতিভা ও ক্ষুরধার সাহিত্য-সমালোচক, জীবনের নিষ্ঠাবান রূপকার ও সমাজচেতনায় দীপ্ত পুরুষ। আমার কাছে তিনি আরও কিছু ছিলেন—শিক্ষক, বন্ধু, পথপ্রদর্শক, প্রেরণাস্থল।

তাঁকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৫০ সালে। প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৫৪ সালে, যখন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান অল্পকালের জন্য। জেল থেকে বেরিয়ে আবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, তখন তাঁর ছাত্র হই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন তাঁর সহকর্মী হয়ে গেছি। ১৯৬৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাই, ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

এর মধ্যে কখন যে তাঁর হৃদয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম, তা হিসাব করে বলা কঠিন। আমার ছাত্রজীবনেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। তারপর তো সে সম্পর্ক ক্রমেই গভীর হতে থাকে।

আমার শিক্ষকতার কাজে তিনি কত যে পরামর্শ দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। নতুন কোনো বই পড়লে জানিয়েছেন তাঁর মর্মকথা কিংবা গুণাগুণ; আমি নতুন কী পড়লাম, জানতে চেয়েছেন সাগ্রহে। নিজে নতুন বই কিনলে সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়েছেন আমাকে, আমার কেনা নতুন কোনো বই দেখে আগ্রহী হলে নিয়ে গেছেন তা আমার পড়ার আগে। শিক্ষক হয়েও তাঁর ক্লাসের পেছনে বসে থেকেছি নতুন কিছু জানতে; আবার যে ক্লাসে যে বিষয় তাঁর পড়ানোর কথা, সেখানে আমাকে দিয়ে মৌখিক বা লিখিত বক্তৃতা করিয়েছেন।

নতুন কিছু লিখলে—তা নাটক হোক বা প্রবন্ধ হোক—পড়ে শুনিয়েছেন আমাকে, জানতে চেয়েছেন আমার মতামত। আমি আমেরিকায় থাকতে চিঠিতে লিখেছেন, ‘তুমি কাছে থাকলে কথা বলেও সুখ হতো।’

দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কত না আলোচনা করেছি একসঙ্গে—সাহিত্য, রাজনীতি, স্বদেশ, আরও কত কিছু নিয়ে। রাজনীতির সঙ্গে যখন সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, এমনকি আমার কাছেও কমিউনিস্ট পার্টির জন্য চাঁদা দিতে রাজি হননি, তখনো বলেছেন মার্ক্সবাদের কাছে কত ঋণ তাঁর। নির্দ্বন্দ্ব হয়ে বলেছেন, বামপন্থার সংস্পর্শে না এলে মানুষের দৃষ্টি মুক্ত হয় না, চিত্তের সংকীর্ণতা দূর হয় না।

নিজের গলদেশে দুটি আঙুল দিয়ে আমাদের এক বন্ধু বলেছিলেন, ‘মুনীর চৌধুরীর প্রতিভা এইখানে।’ শুধু যে সেইখানে, তা নয়। তবে বক্তৃতা দেওয়ার, আবৃত্তি করার, নাটকের সংলাপ আওড়ানোর যে ক্ষমতা ছিল তাঁর, তাকে বিরল বললে ভুল হবে না। তাঁর কণ্ঠ ছিল একটু ফ্যাঁসফেঁসে, কিন্তু স্বরনিক্ষেপণ ছিল অতি উচ্চশ্রেণির। এর জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন তিনি সযত্নে। সেই স্কুলজীবন থেকেই নিরন্তর তর্ক করতেন, আনুষ্ঠানিক বিতর্কে অংশ নিতেন এবং বক্তৃতা করতেন ইংরেজি ও বাংলায়, নাটকে অভিনয় করতেন। পড়তেন যে অজস্র, তা বলা বাহুল্য। তাই কথা বলতে গেলেই শাণিত শব্দ বেরিয়ে আসত মিছিল করে, কিংবা কৌতুকাবহ অনুপ্রাস। তিনি যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে জয় করে নিয়েছিলেন প্রভোস্টস কাপ। যখন শেষ বর্ষের ছাত্র, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় লাভ করেছিলেন সর্বাধিক পুরস্কার।

পাশাপাশি চলত লেখালিখি—গল্প, একাঙ্কিকা, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে পঠিত তাঁর গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মঞ্চস্থ তাঁর নাটক দেখে প্রশংসা করেছিলেন তাঁর শিক্ষকেরা। মুগ্ধ হয়েছিলেন শিক্ষকেরা তাঁর পড়াশোনার পরিধি দেখেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, এমন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাসম্পন্ন ছাত্র তিনি বেশি পড়াননি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত মিস এ জি স্টক লিখেছেন, পাঠক্রমের খাতিরে তিনি সাহিত্য পড়তেন না—সাহিত্যে সত্যিকার আগ্রহ থেকেই তিনি বিস্তর ইংরেজি সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং পাঠ করেছেন সমালোচকের চোখ দিয়ে।

মিস স্টক পড়াননি মুনীর চৌধুরীকে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন মুনীর চৌধুরীর এমএ লিখিত পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে এবং মৌখিক পরীক্ষা হওয়ার আগে। তত দিনে নাট্যকার হিসেবে মুনীর চৌধুরীর কিছু খ্যাতি হয়েছে এবং প্রথম সাক্ষাতেই নাটকের শিল্পরূপ নিয়ে দুজনের তর্ক বেধে গিয়েছিল। স্মৃতিকথায় মিস স্টক লিখেছেন, নাট্যরচনায় মুনীরের আদর্শ কী, তা জানতে চেয়ে তিনি অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেশনিজমের পক্ষে কথা বলছিলেন, মুনীর খুব জোরের সঙ্গে তাঁর যুক্তি খণ্ডন করছিলেন। স্টক বলছিলেন, বিপ্লবী কোনো ভাব, বাস্তবে যা এখনো ঘটেনি—এমন কিছু প্রকাশের জন্য প্রতীকের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তরুণ ছাত্র বললেন, ইউরোপের জন্য তা প্রযোজ্য হতে পারে—তিনি সে বিষয়ে বলার অধিকারী নন, কিন্তু আমাদের মতো দেশে মানুষকে বাস্তবসচেতন করার জন্য সামাজিক বাস্তবতার কোনো বিকল্প নেই। তাঁদের তর্ক চলেছিল অনেকক্ষণ এবং ঢাকায় নবাগত মিস স্টকের মনে হয়েছিল, এমন ছাত্র যদি আরও পান, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সময়টা কাটবে অর্থপূর্ণভাবে।

বলা বাহুল্য, এসব কথাবার্তা যখন ঘটছিল, ১৯৪৭ সালে, তখন মুনীর চৌধুরী প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছেন বামপন্থী রাজনীতির দিকে। তাঁর বাবা ছিলেন গোঁড়া মুসলমান, ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএসসি পড়তে—কোন আশায়, তা বুঝতে পারা যায় সহজে। অগ্রজ কবীর চৌধুরীর কাছ থেকে জীবনের আধুনিকতার পাঠ নেওয়া সত্ত্বেও আলিগড়ে গিয়ে মুনীর চৌধুরী বেশ বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যান—গায়ে পাথরের বোতাম লাগানো শেরওয়ানি, পায়ে চকচকে জুতো, মুখে পান, হাতে পঞ্চাশ সিগারেটের টিন, বলায় চোস্ত উর্দু। আলিগড় থেকে ফিরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে এবং সাহচর্য পেলেন রবি গুহ, দেবপ্রসাদ, সরদার ফজলুল করিম ও মদন বসাকের মতো সেরা ছাত্র ও উৎসর্গীকৃত কমিউনিস্টদের, তখন মুনীর চৌধুরীর জীবনধারা গেল পাল্টে। বিলাসী জীবনকে মনে হলো মেকি এবং ব্যক্তির ও জনসাধারণের জীবনকে গভীরভাবে জানতে আর সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে সংকল্প করলেন তিনি।

কমিউনিস্ট ও নাস্তিক হওয়ার অভিযোগে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এই আবাসিক ছাত্রকে পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসীরা দু-চার ঘা লাগিয়ে হল থেকে বের করে দিয়েছিল। এ জি স্টকের কাছে মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, এ ঘটনায় বেশ মজা পেয়েছিলেন তিনি—শুধু মার খাওয়া ছাড়া—এবং এমন একটা প্লট নিয়ে নাটক লেখার চিন্তাও তাঁর মাথায় ঘুরছে। ওদিকে বাবা আবার লিখেছেন, তাঁদের মত ও পথ যখন এত ভিন্ন, তখন তাঁর কাছ থেকে মাসোহারা নেওয়া কি উচিত হবে মুনীরের? পিতার যুক্তি মেনে নিয়ে তিনি অঙ্গীকার করলেন, তাঁর কাছ থেকে টাকাপয়সা নেবেন না। তখন স্বনামে–বেনামে বেতারের জন্য অজস্র নাটক লিখে জীবনধারণ করতেন তিনি। একবার সংকল্প করেছিলেন পল্টনে নাম লেখাবেন, তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। রাজনীতি আর সাহিত্য অধিকার করে রইল তাঁকে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট রাজনীতি করার বিপদ তাঁকে পদে পদে গ্রাস করেছিল। ঢাকায় জনসভায় গুন্ডাদের আক্রমণ থেকে যদিওবা আত্মরক্ষা করলেন, তবে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয় শিথিল হতে শুরু করল। তার পরও রাজনৈতিক তৎপরতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন ১৯৪৯ সালে—যখন তিনি খুলনার ব্রজলাল কলেজের অধ্যাপক এবং লিলি মীর্জাকে বিয়ে করতে প্রবলভাবে আগ্রহী। আর রাজনীতি করবেন না—এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেলেন, বিয়ে করলেন, যোগ দিলেন জগন্নাথ কলেজে।

সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি—প্রধানত মিস স্টকের আনুকূল্যে। তারপর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আবার গ্রেপ্তার হলেন। ১৯৫৪ সালে ছাড়া পেলেন, কিছুদিন পর আবার যেতে হলো কারাগারে। কারাগার থেকে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। ১৯৫৫ সালে মুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন—প্রথমে ইংরেজি বিভাগে, তারপর বাংলায় এলেন বদলি হয়ে। আমার সৌভাগ্য, তাঁর কাছে কয়েক সপ্তাহ ইংরেজি এবং এক বছর বাংলা পড়লাম। তাঁর শিক্ষাদানের নৈপুণ্যে আমরা, ছাত্রেরা, মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে থাকতাম।

১৯৫৬ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন, ফিরলেন বছর তিনেক পরে ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি নিয়ে। তত দিনে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়েছে দেশে। মন্দভাগ্য মুনীর চৌধুরীর, প্রশাসকদের সংস্রব সম্পূর্ণ এড়িয়ে থাকতে পারলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি হলো, বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হলেন, রাজনীতির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। কিন্তু তার পরও ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছ থেকে লিখিত সতর্কবাণী পেলেন, তিনি যেন ভবিষ্যতে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে সংশ্লিষ্ট না থাকেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, তখন আলবদররা তাঁকে তুলে নিয়ে গেল পিতৃভবন থেকে—তিনি আর ফিরে এলেন না। তাঁর দেশপ্রেমিকতায় তাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

আমার সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে চার খণ্ডে মুনীর চৌধুরী রচনাবলী প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর প্রতি স্নেহশীল অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘মুনীর যে এত লিখেছে, তা আমার জানা ছিল না।’ বলা বাহুল্য, তাঁর সব লেখা আমি সংগ্রহ করতে পারিনি—বেতারের ফাইল থেকে কিছু নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে, দুষ্প্রাপ্য পত্রপত্রিকার পাতায় চাপা পড়ে আছে অনেক লেখা। তবে পরিমাণ দিয়ে নয়, রচনার বৈচিত্র্য ও মান দিয়েই পরিমাপ করতে হবে তাঁর অবদানের।

মুনীর চৌধুরীর প্রথম জীবনের লেখা—এ জি স্টকের কাছে কথিত—তাঁর সমাজ বাস্তবতাবোধের শিল্পসম্মত দলিল। সে সময় বেশ কিছু ভালো ছোটগল্প লিখেছিলেন, কিন্তু তার কোনো সংগ্রহ প্রকাশ করেননি। বড় গল্পকার হওয়ার সম্ভাবনা তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম নাটকের খাতিরে। প্রথমে ঝোঁকটা ছিল একাঙ্কিকার প্রতিই। ছোটগল্পের মতো এর অধিকাংশের বিষয়ও সমকালীন সমাজজীবনের বৈষম্য ও বিকার। এসব একাঙ্কিকার মধ্যে ১২টি সংকলিত হয়েছে কবর (১৯৬৬), দণ্ডকারণ্য (১৯৬৬) এবং পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য–এ (১৯৬৯)। এর অনেকগুলো শনাক্ত করা যায়, তাঁর ভাষায়, ‘ক্ষোভপূর্ণ, অভিযোগাশ্রয়ী ও রক্তাক্ত’ বলে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, গোপন বৈপ্লবিক আন্দোলনের পক্ষে কিংবা নিম্নবিত্ত জীবনের কারুণ্য নিয়ে তিনি লিখেছেন, তবে এ পর্যায়ের রচনার মধ্যে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত কবর তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান। রাজনৈতিক চেতনার এমন কলামণ্ডিত রূপ আমাদের সাহিত্যে খুব অল্পই পাওয়া যায়। গল্​সওয়ার্দীর নাটকের অনুবাদ রূপার কৌটাও (১৯৬৯) এ ধরনের রচনা বলতে চাই। কেননা, তাতে সমাজের শ্রেণিগত বৈষম্যের কথাটাই বিশেষ করে বলা হয়েছে। এমনকি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর–এর (১৯৫৯) মূল চেতনাও যুদ্ধবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে নরনারীর প্রেম।

মুনীর চৌধুরীর জীবনদৃষ্টিতে একধরনের কৌতুকপ্রবণতার স্থান ছিল। হল থেকে বিতাড়িত হওয়ার মধ্যে যেমন তিনি মজার খোরাক পেয়েছিলেন, তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা কিছু মানবীয় সম্পর্কের মধ্যে সন্দেহ–ভালোবাসা, অযথা সরকারি গোয়েন্দাগিরি, অগ্নিসংযোগের প্রচেষ্টায় দাঙ্গাবাজের ব্যর্থতা—এ ধরনের ক্ষেত্র নিয়ে তিনি যা লিখেছিলেন, তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘কৌতুকাবহ’, ‘অন্তরাশ্রয়ী’ এবং ‘অদ্ভুতরসাত্মক’ বলে। সব রচনায় তাঁর সিদ্ধি সন্দেহাতীত নয়, কিন্তু মনোযোগী পাঠকমাত্রেরই মনে হবে যে কমেডিই মুনীর চৌধুরীর নাট্যরচনার যথার্থ ক্ষেত্র। ঘটনার বিন্যাসে এবং বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের সমারোহে এসব রচনা খুবই উপভোগ্য। বার্নার্ড শর নাট্যানুবাদ কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৭), শেক্​সপিয়ারের অনুবাদ মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০) এবং নানা নাট্যকারের একাঙ্কিকার অনুবাদ—রামেন্দু মজুমদার সংকলিত বৈদেশী (১৯৭৭) এই পর্যায়ভুক্ত, যেমন এই পর্যায়ভুক্ত তাঁর মৌলিক নাটক চিঠি (১৯৬৬)। আন্দোলনের নামে একশ্রেণির ছাত্রের সুবিধাবাদ ও অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং তার ফাঁকে ছাত্রছাত্রীদের মন দেওয়া–নেওয়ার কাহিনি এটি—ছাত্রদের সমালোচনা থাকায় হয়তো এই উৎকৃষ্ট নাট্যকর্মটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি।

সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রেও মুনীর চৌধুরী নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। মীর-মানস–এ (১৯৬৫) আলোচ্য লেখক সম্পর্কে তিনি যে নিরাসক্ত আলোচনা করেছেন, আমাদের সমালোচনা সাহিত্যে তা একেবারেই প্রচলিত নয়। তুলনামূলক সমালোচনায় (১৯৬৯) তিনি উদ্​ঘাটন করেছিলেন নতুন দুয়ার। এ গ্রন্থে দুই ধরনের তুলনা তিনি করেছেন: দুটি ভাষার সাহিত্যকর্মের তুলনা,                               আবার একই চরিত্র—ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তিমূলক হোক—বিভিন্ন নাট্যকারের হাতে কেমন রূপলাভ করেছে, তার পরিচয় তুলে ধরে তাঁদের মানসিকতা ও সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। বাংলা গদ্যরীতির (১৯৭০) প্রধান গৌরব বাংলা গদ্যের—বিশেষত পূর্ববাংলার সমকালীন বাংলা গদ্যরীতির—বৈচিত্র্যের পরিচয় দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠিত করা যে সৃজনধর্মী রচনা চলে নিজস্ব নিয়ম ও গতিতে—ব্যক্তি, দল বা রাষ্ট্রের নির্দেশে নয়।

সমালোচনামূলক প্রবন্ধে বা পুস্তক সমালোচনায় তাঁর তীক্ষ্ণধী এবং সাহিত্যবিচারের উৎকৃষ্ট মানদণ্ড আমরা পাই। এক অর্থে, ১৯৪৭–পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে নবনাটকের তিনি ছিলেন উদ্​গাতা। অন্যদিকে, সাহিত্যক্ষেত্রে উন্নত মানের রচনা যাতে সৃষ্ট হতে পারে, তার জন্য তাঁর দৃষ্টি ছিল সদা জাগ্রত। 

মুনীর চৌধুরীর জীবনদৃষ্টির আধুনিকতা খানিকটা সাহিত্যপাঠজনিত, কিন্তু অনেকখানিই বামপন্থী রাজনৈতিক দীক্ষাজনিত। আর সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য থেকে আধুনিক কালের অ্যাবসার্ড নাটক, বাংলা অনুবাদে সংস্কৃত অলংকারের অনুশীলন, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ স্থপতিদের রচনার মনোযোগী পাঠ—এ সবই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল সামনের দিকে এগোতে। আমাদের মনোজগৎকে, আমাদের জীবনবোধকে, আমাদের সাহিত্যরুচিকে সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর মতো আর কেউ প্রভাবান্বিত করেছিলেন বলে আমার জানা নেই।

প্রেমে ব্যর্থকাম এক ছাত্র একবার গোপনে মুনীর চৌধুরীর পরামর্শ নিতে গিয়েছিল। অমন বয়সে এবং অমন আবেগাক্রান্ত হয়ে যা মনে                                                                            জাগা প্রথাসিদ্ধ, সে তা–ই বলেছিল: সে আত্মহত্যার কথা ভাবছে। মুনীর চৌধুরী তাঁকে বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমার মতো অবস্থায় আমারও একাধিকবার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু পরে দেখেছি, আত্মহত্যা না করে ভালোই করেছি—পৃথিবীটা বসবাসের যোগ্য।’ তাঁর সেই যাপনযোগ্য জীবনের অবসান হলো অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে; কমেডি যাঁর প্রিয় শিল্পমাধ্যম, তাঁর জীবনে নেমে এল মহৎ ট্র্যাজেডি—তাঁর পক্ষে শহীদের মর্যাদালাভও আমাদের এ দুঃখ ঘোচাতে পারে না। 

মতিউর রহমান সম্পাদিত আমাদের কালের নায়কেরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত