ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে আছে মিশুকের অগণন স্মৃতি। শামসুন নাহার হলের সামনে স্থাপন করা হয়েছে সেই নিঃসঙ্গ ভাস্কর্য- দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত মাইক্রোবাস, যা শিকার হয়েছিল মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনার। এ দুর্ঘটনায় কীর্তিমান ক্যামেরা শিল্পী আশফাক মুনীর (মিশুক) ও কৃতী চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রাণ ঝরে যায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। মিশুকের জন্ম ১৯৫৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। ভাস্কর্য দেখলে মন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে ওঠার কথা, কিন্তু এই শিল্পকর্মটি দেখলে হয় উল্টো অনুভূতি। বুকে ভারী হয় দীর্ঘশ্বাসের পাথর। মন হাহাকার করে ওঠে।
এক আশ্চর্য যোগসূত্র আবিষ্কৃত হয় কয়েকটি অনুষঙ্গের কথা ভাবলে। মিশুকের বাবা শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ মেধাবী, ছাত্রবান্ধব, বাগ্মী, এ দেশের আধুনিক নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। একাত্তরে তাঁকে প্রাণ দিতে হয় পাক হানাদার বাহিনীর দেশীয় দোসরদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারটি নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়। তরুণ মিশুক খ্যাতিমান হয়ে আছে কলাভবনের সামনের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠ নিবিড় সম্পৃক্তির কারণে। ওই ভাস্কর্যের নির্মাণকালীন শত শত ছবি সে তুলেছে বছরের পর বছর ধরে। সেও তো একালের মুক্তিযুদ্ধই। সত্যের বিবর্তন যেমন সত্য, মুক্তিযুদ্ধের বিবর্তনকেও বলতে পারি জ্জ্বাল্যমান আরেক সত্য।
ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র নির্মাতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। সেটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়াত খালিদ এর বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছি সাংবাদিক হিসেবে। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারিনি। তাই এ ভাস্কর্য নির্মাণের কাজে হাত রক্তাক্ত করে মাতৃভূমির প্রতি ঋণ শোধ করলাম।’ ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। ডাকসুর যে স্যুভেনিরটি বের করে তখন, সেই সংকলনের সবগুলো ছবি ছিল মিশুকের তোলা। অন্য কারও তোলা ছবি ছাপা হয়নি। ভাস্কর্য বিষয়ক একমাত্র লেখাটি ছিল আমার। আমি তখন দৈনিক বাংলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। মিশুক সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্স ফার্স্ট ব্যাচের ছাত্র, পরে একই বিভাগে শিক্ষকতাও করেছে অনেক দিন। ও আমার জুনিয়র হলেও ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে সেটা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সাংবাদিকতা বিভাগে সে সময় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল বেশ কম। ফলে পারস্পরিক মেলামেশা, অন্তরঙ্গতার সুযোগ ছিল অন্য সব বিভাগের চাইতে অনেক বেশি। কত সময় যে আমরা একসঙ্গে গল্প-গুজব, হাসিঠাট্টা,আড্ডায় মেতে থেকেছি, তার কোনো হিসাব নেই। মিশুকদের ফুলার রোডের স্টাফ কোয়ার্টারে, সাংবাদিকতা বিভাগের করিডরে, সেমিনার কক্ষে, নির্মাণাধীন ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে, বড় হতে থাকা বটগাছের তলায়, শিল্পী খালিদের সঙ্গে- কত কথা কত স্মৃতি। মিশুকের সংগ্রহে ছিল দুর্লভ একটি স্যুভেনির। চর্মচক্ষুতে দেখার ও নাড়াচাড়া করবার সৌভাগ্য হলো ওর সৌজন্যেই। একাত্তরে আমেরিকার ম্যাডিসন স্কয়ারে বিশ্বনন্দিত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে যে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়েছিল সেই স্যুভেনির। হাড় জিরজিরে একটি শরণার্থী শিশুর করুণ ছবি দিয়ে করা হয়েছিল ওই স্যুভেনিরের প্রচ্ছদ। পরবর্তীকালে পণ্ডিত রবিশঙ্করের মুখে সেই কনসার্টের কথা শুনেছি, তিনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন। মিশুকের সংগ্রহে আরও ছিল বিশ্বের সাড়াজাগানো সব গানের ঈর্ষণীয় সংগ্রহও। আপাদমস্তক রুচিমান, স্বাপ্নিক এক তরুণ ছিল সে। শিশুর মত সরল হাসি ওর মত ক’জনা হাসতে পারে? ওর মনটা যে নিষ্কলুষ, সেই ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অসামান্য জনপ্রিয় সুদক্ষ শিক্ষক পিতার সন্তান হয়েও শিক্ষকতায় আনন্দ ও মুক্তি খুঁজে পায়নি মিশুক। স্বভাবগতভাবেই এক ধরনের বোহিমিয়ান ছিল সে, নতুন নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনায় টগবগ করত সর্বক্ষণ। বিদেশে গিয়েছিল, কিন্তু মায়ের ভূমির টান প্রবল বোধ করেছিল বলেই সব ছেড়ে ছুড়ে ফিরে এসেছিল আপন মাটিতে।
ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিল আলী রীয়াজ, মিশুকের সহপাঠী। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওরা। রীয়াজ এখন আমেরিকার ইলিনয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধনের আগের দিন আমরা স্যুভেনির ছাপানোর জন্য সারা রাত কাটিয়েছিলাম আগামসিহ লেনের এক প্রেসে। আমাদের সঙ্গে আরও ছিল ওদের আরেক সহপাঠী ফয়সল মোকাম্মেল (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক জিএম, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), প্রয়াত তরুণ কবি সাজ্জাদ হোসেন। রাতভর চলল ছাপার কাজ। আমরা যখন সকাল দশটার পর স্যুভেনির নিয়ে কলাভবন প্রাঙ্গণে পৌঁছাই, তখন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। ডাকসুর সেই ঐতিহাসিক স্যুভেনিরটি (আলী রীয়াজ সম্পাদিত) বর্তমান ডাকসুর আবার ছাপতে পারে। তাহলে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীরা এই ভাস্কর্যটির নির্মাণ ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পারবে। মনে পড়ে, লেখাটি দফায় দফায় তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীকে দেখিয়ে আনতে হতো। তিনি ছিলেন ডাকসুর সভাপতি (পদাধিকার বলে)।
মিশুকের নিজের কথা একটু উদ্ধৃত করি ‘অপরাজেয় বাংলা’ প্রসঙ্গে। মিশুক লিখেছে, “... সেই ১৯৭৮-৭৯ খুব কঠিন সময় নানা কারণে। বাংলাদেশে তখন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব বেশি। তার মধ্যেই একজন শিল্পী একটি ভাস্কর্য বানিয়ে যাচ্ছেন বিশাল আয়তনের।... ওই দুই বছরে অপরাজেয় বাংলার ছবি তোলাটা হলো আমার জন্য ছবি তোলার শিক্ষা। আমার জন্য স্কুল। দিনে একরকম আলো তো বিকেলে অন্যরকম আলো। রাতেও কাজ করেছি। উনি (ভাস্কর খালিদ) অনেক সময় সারা রাত কাজ করেছেন।...ইন্টারেস্টিং হলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মানুষ ওখানে আসত ভাস্কর্য নির্মাণকাজ দেখত। যেমন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা খাঁ খাঁ করছে, বারান্দায় টিম টিম আলো জ্বলছে, এর মাঝে খালিদ ভাই একা একা কাজ করে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখা গেল দশ পনেরো জন রিকশাচালক অপরাজেয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে খালিদ ভাইয়ের কাজ দেখছে। কথা নেই বার্তা নেই। কোনো বিদেশি বা স্কুলের বাচ্চারা, রাস্তার টোকাই গ্রুপ-এক মনে দেখে যাচ্ছে খালিদ ভাই কী করেন।.. এর মাঝে রাজনৈতিক কিছু কিছু সমস্যাও হয়েছিল। যেমন হঠাৎ একদিন জামাতে ইসলামের কয়েকজন ভাস্কর্যটি ভাঙতে চেষ্টা করেছিল এই বলে যে এটা ইসলাম বিরোধী। তখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এল অপরাজেয় বাংলাকে বাঁচাতে। কোনো রাজনৈতিক কর্মী নয়, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই জামাতিদেরকে এমন তাড়া করল যে তারা আর পালানোর পথ খুঁজে পায় না। দু’জনকে ধরে চুনকালি মাখিয়ে সারা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোরালো।”
মিশুকের কাজ বহুমাত্রিক ও অনন্য। চলচ্চিত্র গ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু শিল্পী এসএম সুলতানের ওপর তথ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ দিয়ে। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র, টেলিছবি, টিভি নাটক পাপেট ছবির জন্য কাজ করেছে। জাতীয় জাদুঘরে অডিওভিস্যুয়াল শাখার পরিকল্পনা ও গড়ে তোলা। ঢাবি সাংবাদিকতা বিভাগে মিডিয়া সেন্টার প্রকল্প পরিকল্পনা ও গড়ে তোলা। বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিস টিভি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং। স্বদেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেল একুশে টিভির সূচনালগ্নে সংবাদ কার্যক্রমের পরিচালক, ডিসকভারি চ্যানেলের ‘সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল’ নামের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের চিত্রগ্রাহক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন টিভি দা রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক-এর সংবাদ কার্যক্রমের পরিচালক হিসেবে এটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় সংযুক্তি। কানাডায় অভিবাসী হয়েও থিতু হয়নি। দেশে ফিরে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী ও সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করছিল। মিশুক শরীরীভাবে নাই সত্য। কিন্তু সে আছে সুহৃদ অনুরাগী স্বজনের মনের গভীরে, তার রুচিস্নিগ্ধ ব্যতিক্রমী কাজগুলো প্রাণিত করবে উত্তরপ্রজন্মকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে...।