ধারাবাহিক উপন্যাস, স্লোনেস: মিলান কুন্ডেরা, অনুবাদ: আনিসুল হক

ধীরে চলা

>উপন্যাস অনেক প্রকার। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, কবিতা অনেক রকম। আমরা বলব, উপন্যাসও অনেক রকম হতে পারে। নিকানর পাররা বলেছিলেন, সবকিছুই ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কবিতায়। শুধু দেখতে হবে, তা যেন সাদা কাগজের চেয়ে উত্তম হয়। আমরা বলব, সবকিছুই ঢুকিয়ে দেওয়া যায় উপন্যাসে, শুধু দেখতে হবে, তা যেন সাদা কাগজের চেয়ে ভালো হয়। 

উপন্যাস যে অনেক প্রকার, তা আমার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য আমি মিলান কুন্ডেরার স্লোনেস (Slowness) উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। এতে চার মাস লাগবে। একটা উপন্যাস অনুবাদ করা হবে। আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপও করতে পারব, উপন্যাস কত বিচিত্র হতে পারে, তা নিয়ে।


আমাদের হঠাৎই খেয়াল চাপল, আমরা একটা সন্ধ্যা, একটা রাত কাটাব একটা পুরোনো প্রাসাদে। এ ধরনের প্রাসাদের অনেকগুলোই ফ্রান্সে এখন হোটেল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কদর্যতার কাছে চাপা পড়ে যাচ্ছে একেকটা সবুজ চত্বর: পায়ে চলা পথ, গাছগাছালি, পাখপাখালি আটকা পড়ছে মহাসড়কের বিশাল জালের মধ্যে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। পেছনে দেখার আয়নায় লক্ষ করি আমার পেছনে একটা গাড়ি। একটা লাল আলো বাম পাশে জ্বলছে, নিভছে। পুরো গাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসছে রাশি রাশি অধৈর্য। ওই গাড়ির চালক আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে। একটা চিল যেমন একটা চড়ুইকে ধরার মুহূর্তটির ওত পেতে থাকে।

মিলান কুন্ডেরা

ভেরা, আমার স্ত্রী, আমাকে বলে, ‘প্রতি ১৫ মিনিটে ফ্রান্সে কেউ না কেউ রাস্তায় মারা যায়। এদের দিকে তাকাও। সব উন্মত্ত মানুষ তেড়েফুঁড়ে আসছে আমাদের দিকেই। এই লোকগুলোই আবার যখন কোনো বৃদ্ধাকে ছিনতাইকারীর হাতে পড়তে দেখে, নিজের জান বাঁচানোর জন্য তটস্থ–সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাহলে তারা যখন গাড়ি চালায়, তখন কেন একটুও ভয় পায় না?’

আমি কীই–বা বলতে পারি? হয়তোবা বলতে পারি: একজন লোক যখন মোটরসাইকেলে বাঁকা হয়ে বসে, সে কেবল সেই মুহূর্তটাতেই মনোনিবেশ করতে পারে। সে সময়ের একটা কাটা অংশে আটকা পড়ে, যার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। সময়ের ধারাবাহিকতা থেকে তাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সে সময়ের বাইরে। সে একটা ঘোরলাগা তীব্র আমোদের ভেতরে আছে। এ অবস্থায় সে ভুলে গেছে তার বয়স, তার স্ত্রী, তার সন্তান, তার উদ্বেগ; সুতরাং তার আর কোনো ভয় নেই। কারণ, তার ভয়ের উৎসটা পড়ে আছে ভবিষ্যতে। একজন মানুষ, যে কিনা ভবিষ্যৎ থেকে মুক্ত, সে ভয় থেকেও মুক্ত।

প্রযুক্তির বিপ্লব মানুষকে দিয়েছে গতি, গতি হলো এক উত্তুঙ্গ আমোদের নাম। মোটরসাইকেলচালকের বিপরীত অবস্থা একজন দৌড়বিদের। সে সব সময় তার দেহের মধ্যেই উপস্থিত আছে। তাকে সব সময় তার শরীরের ফোসকা নিয়ে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় পরিশ্রান্তি নিয়ে; সে তার ওজন অনুভব করে, নিজের এবং নিজের জীবনের সময় নিয়ে সে অনেক বেশি সচেতন থাকে। এর সবই বদলে যায়, যখন একজন মানুষ তার গতির দায়িত্বটা একটা যন্ত্রের ওপরে ছেড়ে দেয়, তখন থেকে তার শরীর আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নয়, সে গতির কাছে হাল ছেড়ে দেয়, যে গতির সঙ্গে দেহের কোনো সম্পর্ক নেই, বস্তুর কোনো সম্পর্ক নেই—বিশুদ্ধ গতি, স্বয়ং গতি, চরমানন্দ গতি।

কৌতূহলোদ্দীপক মিল: প্রযুক্তির শীতল উদাসীনতা বনাম আমোদের অগ্নিশিখা। আমার মনে পড়ছে ত্রিশ বছর আগের কথা। একজন আমেরিকান নারী আমাকে লেকচার দিয়েছিলেন। ইরোটিসিজম পার্টির একজন সদস্যের মতো করে তিনি লেকচার দিচ্ছিলেন। অবশ্য তাত্ত্বিক আলোচনা ছিল সেটা। ভীষণ শক্ত আর অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল ভঙ্গি। তিনি বলছিলেন যৌনতার মুক্তি নিয়ে। তার বক্তৃতায় একটা শব্দ বারবার আসছিল, তা হলো ‘অর্গাজম’। আমি গুনেছিলাম, ৪৩ বার অর্গাজম বলেছিলেন তিনি। দ্য রিলিজিয়ন অব অর্গাজম, যৌন জীবনে উপযোগিতাবাদ, দক্ষতা বনাম নিষ্ক্রিয়তা, সঙ্গম হলো একটা বাধা, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তা পার হয়ে গিয়ে চরম পুলক পেতে হবে, তা–ই হলো মিলনের এবং দুনিয়ার একমাত্র সত্য লক্ষ্য।

কেন ধীরতার সুখ বিশ্ব থেকে উধাও হয়ে গেল? বিগত বছরগুলোর সেই মন্থর হাঁটা? কোথায় গেল লোকগানের সেই ভবঘুরে নায়কেরা, যারা একটা মিল থেকে আরেকটা মিলে যাযাবরের মতো ঘোরাঘুরি করত আর তারাদের নিচে ঘুমাত। ঘাসের সঙ্গে, পায়ে চলা পথের সঙ্গে, খোলা পরিসর আর প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তারাও গেছে হারিয়ে। একটা চেক প্রবাদ আছে, তাদের কুঁড়েমি যাতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এক উপমার মধ্য দিয়ে: ‘তারা খোদার জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।’ যে লোক খোদার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কখনো একঘেয়েমিতে ভুগবে না। আর আমাদের দুনিয়ায় কুঁড়েমি মানে হলো, কোনো কিছু করার নেই। এটার মানে সম্পূর্ণ আলাদা। কোনো কিছু করার নেই যার, সে হতাশ, বিরক্ত, কিছু একটা করণীয় খুঁজতে সদা ব্যস্ত। আর খোদার জানালার দিকে যে তাকিয়ে আছে, সে সুখী।

স্লোনেস উপন্যাসের প্রচ্ছদ

আমি আবার গাড়ির আয়নায় তাকাই। বিপরীত দিক থেকে গাড়ি আসছে, তাই সেই আগের গাড়িটাই আমাকে অতিক্রম করতে না পেরে পিছু লেগে আছে। সেই চালকের পাশে একজন নারীও আছে। কেন ব্যাটা নারীকে মজার কোনো কথা বলছে না? কেন সে তার হাঁটুতে হাত রাখছে না? তার বদলে সে তার সামনের চালককে অভিশাপ দিচ্ছে যথেষ্ট জোরে গাড়ি না চালানার জন্য। আর নারীটাই–বা কেমন? সে–ও তো লোকটার গায়ে হাত রাখতে পারত। তা না করে সে–ও গাড়ি চালানোর পাল্লায় যোগ দিয়েছে। আর আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

আর আমি প্যারিস থেকে একটা প্রাসাদ এলাকার দিকে যাত্রার আরেকটা কাহিনি মনে করতে পারি। সেটা ছিল দুই শ বছর আগের একটা ঘটনা। মাদাম দে টি. এবং তরুণ শেভালিয়ে গিয়েছিলেন সে যাত্রায়। সেই প্রথম তারা দুজন দুজনের এত কাছে, তারা ছিলেন একটা ঘোড়ার গাড়িতে, গাড়ি দুলছিল, দুটো শরীর কাছাকাছি পাশাপাশি, গায়ে গায়ে লাগছিল, প্রথমে অনিচ্ছায়, তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে; ছন্দময় ধীরতা থেকে যৌনতার আবহাওয়া তৈরি হচ্ছিল। সেখান থেকেই শুরু হলো গল্পটা।


ভিভাঁ দেনো তাঁর উপন্যাসিকায় এই কথাই বলতে চেয়েছেন: বিশ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক এক সন্ধ্যায় গিয়েছেন থিয়েটারে। (তার নাম, পদবি কিছুই বলা হয়নি, কিন্তু আমি কল্পনা করি তিনি একজন শেভালিয়ে বা নাইট।) থিয়েটার হলে পরের বক্সে বসে আছেন একজন ভদ্রমহিলা, দেখতে পেলেন শেভালিয়ে। (উপন্যাসিকায় ভদ্রমহিলার নাম দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে নামের আদ্যক্ষর। মাদাম দে টি.। এই ভদ্রমহিলার একজন বান্ধবী আছেন, তিনি আবার এই শেভালিয়ের প্রেমিকা। ভদ্রমহিলা শেভালিয়েরকে অনুরোধ জানালেন, নাটক দেখা শেষ করে তিনি যেন তার সঙ্গে তার বাড়ি যান। ভদ্রলোক বিস্মিত হলেন। কারণ, তিনি জানেন মাদামের একজন খাতিরের লোক আছে। মার্কিজ ধরনের নাম। (এই বইয়ে মার্কিজের নামও বলা হবে না। আমরা একটা গোপনীয়তার দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি। যেখানে কারও কোনো নামই নেই।) রহস্যদীর্ণ শেভালিয়ে এরপর নিজেকে আবিষ্কার করেন এই মধুময় ভদ্রমহিলার সঙ্গে একই ঘোড়ার গাড়িতে। মধুর মসৃণ এক যাত্রা শেষে তাদের গাড়ি এসে থামে চমৎকার পল্লিপ্রান্তরে এক প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে সিঁড়ির সামনে। সেখানে মাদাম দে টি.-এর স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অভ্যর্থনা করতে। তিনজন একসঙ্গে নৈশভোজ সারেন অস্বস্তিকর অনুষ্ণ পরিবেশে, তারপর স্বামীটি তাদের দুজনকে একত্রে ছেড়ে দিয়ে নিজে বিদায় নেন।

তখন শুরু হয় তাদের রাত।