মণিপুরি সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে আলাদা ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মণিপুরিদের নৃত্যকলাকে ধর্মীয় আচারের গণ্ডি থেকে বের করে এনে বিশ্বমণ্ডলে স্থান করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই মণিপুরি জাতি ও তাদের নৃত্যকলা বিশ্বের কাছ পরিচিতি লাভ করেছে।
শিলং থেকে সিলেট
১৯১৯ সালে অবকাশ যাপনের জন্য তখনকার আসাম রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর তিনি শিলং পৌঁছান। সেখানে ২০ থেকে ২২ দিন অবস্থান করার পর সিলেট ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শিলং থেকে সিলেট মাত্র ১৪০ কিলোমিটারের পথ হলেও তখন সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিল না। বিকল্প পথ গুয়াহাটি থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট আসতে হয় তাঁকে। অনেকটা দীর্ঘ ছিল এই পথ।
১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর, দিনটি ছিল বুধবার। খুব ভোরে সিলেটে পৌঁছান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। সুরমা নদীর ঘাট থেকে কবিকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ সিলেট শহরে আনা হয়। তিনি উঠেছিলেন শহরের নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয়। বাংলোর দরজা-জানালার পর্দাগুলো ছিল মণিপুরি কোমরতাঁতের তৈরি। গবেষক নৃপেন্দ্রলাল দাস তাঁর লেখায় প্রত্যক্ষদর্শী সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘বাংলোর বহির্দ্বারে টাঙানো ছিল মণিপুরিদের তৈরি প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো একখানা আচ্ছাদন বস্তু। স্থানান্তর থেকে পর্দা খানা আনীত হয়েছিল। ওই আচ্ছাদন বস্ত্রে মণিপুরিদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি মুগ্ধ হলেন।’ তাঁকে পর্দাটি শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
শ্রীহট্টবাসীর সংবর্ধনা ও মণিপুরিদের সঙ্গে কবির পরিচয়
পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় কবিকে টাউন হল প্রাঙ্গণে শ্রীহট্টবাসী জনসাধারণের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সৈয়দ মুর্তজা আলীর একটি লেখায় (আমাদের কালের কথা, চট্টগ্রাম, ১৩৮২) উল্লেখ আছে, ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। সেই অনুষ্ঠানে কবি দেড় ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা করেন, যা পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বেলা দুইটার সময় ব্রাহ্মসমাজ গৃহে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি কর্তৃক তাঁকে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানস্থলে কবির টেবিলে মোড়ানো ছিল মণিপুরি মেয়েদের তৈরি টেবিল ক্লথ। কাপড়খানি তাঁর ভালো লাগে। মেয়েদের বয়ন-নৈপুণ্য দেখে কবি মণিপুরিদের তাঁত ও জীবনযাত্রা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ওই দিন অনুষ্ঠান শেষে বেলা তিনটায় তাঁকে সিলেট শহরের কাছে মাছিমপুর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি বস্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মণিপুরি বস্তিতে কবির আগমন ঘটবে, এ জন্য বস্তিবাসী তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় সারি সারি কলাগাছ পুঁতে তোরণ নির্মাণ করেন। প্রতি গাছের গোড়ায় মঙ্গলঘট ও আমপাতার শোভন সজ্জা করেন। সে তোরণদ্বার দিয়ে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় মাছিমপুর পূর্বমণ্ডপের গোপীনাথ জিউ মন্দিরে। কবির উদ্দেশে মণিপুরি ছেলেমেয়েরা রাখালনৃত্য পরিবেশন করে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রাখাল নৃত্যের কাহিনি। এটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের পার্বণিক আচারেরই অংশ। কবির ইচ্ছা ছিল রাসনৃত্য দেখার, কিন্তু ক্লান্ত বোধ করায় মণিপুরি ছেলেমেয়েদের সন্ধ্যায় তাঁর বাংলোয় আসতে বলেন। তিনি আসার সময় মণিপুরি মেয়েদের তৈরি তাঁতের কাপড় কিনে নিয়ে আসেন।
ফাদার টমাসের বাংলোয় মণিপুরি রাস দেখেন রবীন্দ্রনাথ
সেই রাতে মাছিমপুর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি বস্তি থেকে একদল শিল্পী ফাদার টমাসের বাংলোয় পৌঁছান। শিল্পীরা মণিপুরি রাসলীলার কিছু গীতি ও নৃত্য কবির সামনে উপস্থাপন করেন। সেদিন কবিগুরু মণিপুরি নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন এবং শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের এই নৃত্য শেখানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শান্তিনিকেতনে মণিপুরিদের বস্ত্র ও বয়নশিল্প শেখানোর বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেদিনকার রাসনৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি নৃত্যশিল্পী ইমাগো দেবী। ইমাগো দেবীকে কবিগুরু শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে চাইলেও মণিপুরিদের কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্য
শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে নৃত্যশিক্ষাগুরু আনিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা ও চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলেন৷ দেবদাসী নৃত্য শেখানোর জন্য কোচিন থেকে নৃত্যশিল্পী আনিয়েছিলেন। কথাকলির জন্য নৃত্যগুরু আনিয়েছিলেন কেরালা থেকে। মণিপুরি নৃত্যের মুদ্রা শেখানোর জন্যও মণিপুর রাজ্য থেকেও তিনজন শিল্পীকে শান্তিনিকেতনে আনা হয়, কিন্তু বাংলা ভাষা জানা না থাকায় তাঁরা ফেরত চলে যান।
ওই সময়ে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য ছিল। বীরেন্দ্রকিশোরকে অনুরোধ জানিয়ে নৃত্যগুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান তিনি। মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি নৃত্যশিক্ষক-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের কথা উল্লেখ করেছেন—
‘বহুমানভাজলেষু,
মহারাজ, বুদ্ধিমন্ত সিংহকে আশ্রমে-পাঠাইয়াছেন সে জন্য আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি। ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে। আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মণিপুরি শিল্প কার্য্য শিখিতে ঔসুক্য প্রকাশ করিতেছে। মহারাজ যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে। আমাদের দেশের ভদ্রঘরের মেয়েরা কাপড় বোনা প্রভৃতি কাজ নিজের হাতে করিতে অভ্যাস করে ইহাই আমাদের ইচ্ছা। এই জন্য আসাম হইতে একজন শিক্ষয়িত্রী এখানকার মেয়েদের তাঁতের কাজ শিখাইতেছে। কিন্তু শিলেটে (সিলেট) আমি মণিপুরি মেয়েদের যে কাজ দেখিয়াছি তাহা ইহার চেয়ে ভালো। আমি বুদ্ধিমন্তের নিকট আমার প্রস্তাব জানাইয়াছি। সে মহারাজের সম্মতি পাইলেই তাহার স্ত্রীকে আনাইয়া এখনকার মহিলাদিগকে মণিপুরি নাচ ও শিল্পকার্য্য শিখাইবার ব্যবস্থা করিতে পারিবে এইরূপ বলিয়াছে। এ জন্য এ সম্বন্ধে মহারাজের সম্মতি ও আদেশের অপেক্ষায় করিয়া রহিলাম।
ভগবান আপনার কল্যাণ করুন এই কামনা করি। ইতি
১৯ মে মাঘ ১৩২৬
শুভানুধ্যায়ী
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বুদ্ধিমন্ত সিংহ শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আশ্রমের শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে বুদ্ধিমন্তের কাছে নাচ শেখেন। বুদ্ধিমন্ত সিংহ বেশি দিন ছিলেন না। ‘শিল্পাশ্রম’ নামে ত্রিপুরা রাজ্যের আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থাকার কারণে তাঁকে ফেরত চলে যেতে হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আরেক নৃত্যগুরু নবকুমার সিংহ রাজকুমার। নবকুমার শান্তিনিকেতনে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। এর মধ্যে ত্রিপুরার রাজা বৈকুণ্ঠ সিংহ নামের আরেকজন গুরুকে পাঠান নবকুমার সিংহের সঙ্গে কাজ করতে। তখন আশ্রমের মাসিকপত্র ‘শান্তিনিকেতন’-এর ১৩২৬ সালের ফাল্গুন সংখ্যায় সংবাদ প্রচার হয়, ‘ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বাহাদুরের দরবার হইতে দুজন কলাবিদ আশ্রমে আসিয়াছেন। আশ্রম বালকেরা তাঁহাদিগের নিকট হইতে মৃদঙ্গ সহযোগে সাঙ্গীতিক ব্যায়াম শিক্ষা করিতেছে।’ এই সংবাদের ভাষা থেকে বোঝা যায়, প্রাথমিকভাবে এই নৃত্যশিক্ষাকে শান্তিনিকেতনে ঠিকভাবে গ্রহণ করা হয়নি। তাই একে ‘সাংগীতিক ব্যায়ামশিক্ষা’ বলা হয়েছিল।
ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতনের বিদ্যার্থীরা মণিপুরি রাসের ‘চালি’ ও ‘ভঙ্গি’ সঠিকভাবে শিখতে সমর্থ হন। দেবযানী চালিহার ভাষ্যমতে, ১৯২৬ সালে সংগীত ভবনে মঞ্চস্থ হয় ‘নটীর পূজা’ যেখানে সর্বপ্রথম মণিপুরি নৃত্যধারা অনুসরণ করা হয়। নাটকটির নৃত্য নির্দেশক ছিলেন নবকুমার সিংহ। তিনি চাকরি নিয়ে আহমেদাবাদ চলে গেলে আসাম থেকে আসেন তরুণ নৃত্যশিল্পী আতম্বা সিংহ। তারপর ১৯৩১ সালে যান আসামের আরেকজন নৃত্যগুরু সেনারিক সিংহ রাজকুমার। তাঁরা বিদ্যার্থীদের নতুন পাঠক্রমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মণিপুরি নৃত্যের তালিম দিতে থাকেন। এই সময়ে মণিপুরি নৃত্যকে বাংলায় জনপ্রিয় করতে এগিয়ে আসেন জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের আরও দুজন মানুষ—সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীমতি ঠাকুর। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নৃত্য কলা লয়’। নৃত্য কলা লয় কাজ করে মণিপুরিসহ অন্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের ফরমগুলোকে জনপ্রিয় করতে।
রবীন্দ্রসংগীতের গভীরতা ও কাব্যময়তার সঙ্গে মণিপুরি নৃত্যের সাবলীল গতি ও বিশুদ্ধ নান্দনিকতার বিশেষ সামঞ্জস্য থাকায় শান্তিনিকেতনে উচ্চাঙ্গ নৃত্যধারার মধ্যে মণিপুরি নৃত্য সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি গানের সুর ও তাল দিয়েও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে একে একে মঞ্চস্থ হয় ‘শাপমোচন’, ‘ঋতুরঙ্গ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘মায়ার খেলা’। ‘শাপমোচনে’ অভিনয় করেন নবকুমার সিংহ। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় সম্পূর্ণভাবে অনুসরিত হয় মণিপুরি সুর ও তাল। ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অভিনয় করতে আসাম থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক নৃত্যশিল্পী চন্দ্রজিৎ সিংহ রাজকুমারকে। তারপর আসেন রাসধারী নরোত্তম সিংহ। মণিপুর থেকে রাজকুমার সূর্যবর সানা ও তাঁর পুত্র প্রিয় গোপাল সানা যোগ দেন নৃত্য কলা লয়ে।
এভাবে মণিপুরিদের সঙ্গে কবিগুরু, শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের এক গভীর সখ্য ও আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে।
গুরু নীলেশ্বর মুখার্জি ও রবীন্দ্রনাথ
১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুর মণিপুরিপাড়ায় রাখাল বালকদের যে দলটি রবীন্দ্রনাথের সামনে মণিপুরি গোষ্ঠলীলা পরিবেশন করে, তার একজন ছিলেন নীলেশ্বর মুখার্জি । রবীন্দ্রনাথ নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে ১০ টাকা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের উপজেলার বালিগাঁও গ্রামে। এই নীলেশ্বর মুখার্জিই শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৩৫ সালে। তখন দ্বিতীয় পর্যায়ে মণিপুরি নৃত্যের পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়। খোলা হয় আলাদা বিভাগ। নীলেশ্বর মুখার্জি মৃদঙ্গ শেখানোর দায়িত্ব পান।
শান্তিনিকেতনে নীলেশ্বর মুখার্জির সঙ্গে কবিগুরুর সাক্ষাতের কথা পাওয়া যায় মণিপুরি লেখক রবিবাবু সিংহের ‘মণিপুরি নৃত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। নীলেশ্বর মুখার্জি নিজেও স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছেন মাতৃভাষায়।
রবীন্দ্রনাথ তখন উত্তরায়ণের দোতলায় বসে ছিলেন। অনেক দর্শনার্থীর ভিড়। হঠাৎ কবিগুরু বললেন, ‘আজ নীলেশ্বর মুখার্জির আসার কথা, তাই না?’ ভিড়ের মধ্য থেকে নীলেশ্বর মুখার্জির কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যাঁ, গুরুদেব আমি এসেছি।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কাছে ডেকে মণিপুরি ভাষার গান শুনতে চান তাঁর কাছে। নীলেশ্বর গাইলেন মণিপুরি পালার গান, ‘সাজলো কুসুম শেজ বিছাওল/ বাড়ই বাড়লো রাতির সে মাতি/ আমার বিনোদিনী বিনোদ করে/ সাজলো কুসুম বিছাওল।’
রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘গানটি কত মাত্রার।’
নীলেশ্বর বললেন, ‘বারো মাত্রার।’
মাথা নেড়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘না, আমার মনে হয় চৌদ্দ মাত্রার।’ রবীন্দ্রনাথ জানতেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতিতে শ্রীমতী রাধার এই গান বাঙালি সুরে ১৪ মাত্রায় গাওয়া হয়। কিন্তু বিনয় ও সাহসিকতার সঙ্গে বিশাল সুধী সমাবেশে গানের মাত্রা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন নীলেশ্বর মুখার্জি। তিনি বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি আমাকে কেবল একটি মণিপুরি খোলের ব্যবস্থা করে দিন। আমি খোলের তালে মাত্রা গুনে প্রমাণ করে দেব যে গানটি ১২ মাত্রার।’ তারপর খোল এনে হাজির করা হয়। নীলেশ্বর মুখার্জি উৎসুক দর্শনার্থীদের সামনে খোলের তালে তালে তাঁর আঙুলি দিয়ে মাত্রা সংকেত করে সেদিন প্রমাণ করেছিলেন গানটি ১২ মাত্রার।
নীলেশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করে ফেলেন। তাঁর শান্ত স্বভাব ও গুণী শিল্পীর গুণ দেখে মুগ্ধ হন। নীলেশ্বরের অনুরোধে কবি ‘কোন দেবতা সে কী পরিহাসে’ গানটি চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে সংযোজন করেন। ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘কুঞ্জ দ্বারে নব মল্লিকা’ এই দুটি রবীন্দ্রসংগীত মণিপুরি নৃত্যের তালে তালে সার্থকভাবে মঞ্চে নিয়ে আসেন নীলেশ্বর। ১৯৩৬ সালে পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লাহোর ও মিরাটে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। সেই সব মঞ্চায়নে নীলেশ্বর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীলেশ্বরের নৃত্য দক্ষতায় ১৯৩৮ সালে শিলংয়ে এবং ১৯৪০ সালে আসানসোল, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে পুনর্মঞ্চায়িত ‘শাপমোচন’, ‘রথের রশি’ ইত্যাদি নাটকেও তিনি ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ১৭ বছর বয়সী কন্যা ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে গুরু নীলেশ্বরের ছাত্রী ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে মণিপুরি নৃত্যকলার যে সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছিল, তার সঙ্গে নীলেশ্বর মুখার্জি এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার সময় নীলেশ্বরের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ একটি বিদায়গীতি লিখে দিয়েছিলেন। গানটি হচ্ছে ‘যাবে, যাবে হে নিজালয়ে/ তোমায় বিদায় দিতে/ যত দুঃখ হয় চিত্তে’। ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নীলেশ্বর মুখার্জি মৃত্যুবরণ করলে শান্তিনিকেতন থেকে শোকবার্তা পাঠানো হয়।
মণিপুরি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ আজও অমলিন
লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা মণিপুরি নৃত্যের বিশ্বময় প্রচার হওয়ার পর থেকে গত শতকের তৃতীয় দশক থেকে মণিপুরি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটতে থাকে। মণিপুরি নৃত্যগুরু ও শিল্পীরা সমাদৃত হতে থাকেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে তাঁরা আমন্ত্রিত হতে থাকেন। কেবল ধর্মীয় আচারের জন্য পালিত সংস্কৃতি অর্থকরী হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে মণিপুরি সমাজে। মণিপুরি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ অসামান্য ভূমিকা রাখার জন্য মণিপুরি সম্প্রদায় আজও কবিগুরুকে ‘মণিপুরি নৃত্যের পথিকৃৎ’ হিসেবে বিবেচনা করেন। মণিপুরি নৃত্যগুরুরা আজও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন কবিগুরুর নাম। সম্মানিত করার জন্য কবিগুরুর লেখা গান মণিপুরি রাসলীলায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সিলেটের মাছিমপুরের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিপল্লিতে স্থাপন করা হয়েছে কবিগুরুর প্রতিকৃতি।
মণিপুরি রাস উৎসবে ‘বাকি আমি রাখবো না’ কিংবা ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি’র মতো গানগুলো যখন গভীর শ্রদ্ধায় নৃত্যের সঙ্গে গীত হয়, তখন বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ মণিপুরি সমাজে আজও কতটা আদরণীয়, কতটা প্রাসঙ্গিক।
লেখক: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার লেখক ও গবেষক
তথ্যসূত্র:
১. ‘আকাংখা’, শান্তিনিকেতনের পত্রিকা, ১৩২৬ বাংলা
২. ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, মার্চ ২০, ১৯৭৫
৩. ‘শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ’, অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাস
৪. ‘ভারতের নৃত্যকলা’, গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়
৫. ‘Classical Manipur Dance: its response Outside Manipur’ Devjani Chaliha, Calcutta 1999
৬. ‘মণিপুরি নৃত্য ও রবীন্দ্রনাথ’, রবিবাবু সিংহ।