ভারত ভাগ ও স্বাধীনতা নিয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

সম্প্রতি পেরিয়ে গেল অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জন্মশতবর্ষ। তিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন নানা কারণে। লিখেছেন খুবই কম, কিন্তু আলাপচারিতায় তাঁর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার তল খুঁজে পাওয়া যেত না। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী ভাবুক ও আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উত্থানপর্বের নিবিড় পর্যবেক্ষক। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলেক্ষ আয়োজন

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (১৯১৪—২৮ নভেম্বর ১৯৯৯)

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক (১৯১৪-১৯৯৯) ১৯৫০-এর দশক থেকে ঢাকার বিদ্বৎসমাজকে নতুন মত ও পথের দিশা দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৩১ সালে এবং কৃতবিদ্য হওয়ায় ১৯৩৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব পান। প্রায় এক দশক ঢাকা বাসের পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের বাসনায় ১৯৪৫ সালে তিনি লন্ডন যান। সেখানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় বছরের কিছু বেশি সময় কাটান। তবে তাঁর বাসনা পূরণের জন্য সময়টা খুব একটা পর্যাপ্ত ছিল, এমন প্রমাণ মেলে না। ডিগ্রি না নিয়েই আবদুর রাজ্জাক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। যদিও তিনি পণ্ডিত হ্যারল্ড জে লাস্কির অধীনে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনার কাজটি শেষ করেছিলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ’। অভিসন্দর্ভটি ১৯৫০ সালে জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক বিষয়টিকে আর এগিয়ে নেননি।

আবদুর রাজ্জাকের পুরো অভিসন্দর্ভ ছাপার মুখ দেখেনি। হাতে গোনা যে কয়জন মানুষ তা পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, এই অধমও তাঁদের একজন। আমার হাতে এসেছিল অভিসন্দর্ভটির ফটোকপির ফটোকপি। সত্যি বলতে কি, এর অংশবিশেষের পাঠোদ্ধার ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অভিসন্দর্ভটি নিঃসন্দেহে দুমূর্ল্য। কালের করাল গ্রাস সত্ত্বেও এটি প্রকাশের দাবি রাখে। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পরপরই আবদুর রাজ্জাক পূর্ব পাকিস্তানের অসম উন্নয়ন ও বৈষম্য এবং আবশ্যিকভাবেই পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আকুল হয়ে পড়েন। এই প্রশ্নগুলো সম্ভবত, পুরোপুরি না হলেও, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের গুরুতর সমস্যাগুলোর ওপর ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেওয়ার কিছু কারণের ব্যাখ্যা হাজির করে।

আবদুর রাজ্জাকের অভিসন্দর্ভের মূল ধারা দুটি। ভারতকে ১৯৪৭ সালে টুকরা করার কৃতিত্বের বড় দায় সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ওপর বর্তানো এবং এই বিভাজনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকার উন্মোচন, যে শ্রেণিটি সব সময়ই কংগ্রেসের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছিল।

আবদুর রাজ্জাক এই বিচার-বিশ্লেষণ করতে বসেছিলেন যে স্বাধীনতা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে ভারতকে কেন খণ্ডিত হওয়ার ভাগ্য বরণ করতে হলো, বলতে গেলে যা হয়ে উঠল বিধির বিধান। এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাকের পয়লা বিচার হলো, এ মতের কোনো অন্যথা ছিল না যে এ ছাড়া আদৌ টিকে থাকা সম্ভব। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়েছিল প্রধানত ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের পৌরোহিত্যে। আমাদের গবেষক তাঁর অনবদ্য ভাষায় বলছেন, ‘বিপরীত স্রোতের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে না তুলে কংগ্রেস বরং ভারতকে টুকরা করার জন্য জোর চেষ্টা চালায়।’

আবদুর রাজ্জাক লিখছেন, ‘পরের পৃষ্ঠাগুলোয় শিক্ষিত ভারতীয়দের “চিন্তার আবহাওয়া”র বরাত দিয়ে ভারত ভাগের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানো ছিল যাদের ইতিকর্তব্য।’ রাজ্জাক আরও যোগ করেছেন, ‘এই শিক্ষিত ভারতীয়দের “চিন্তার আবহাওয়ার”র নমুনা পত্রপত্রিকায় ছাপার হরফে তেমন পাওয়া যাবে না। এর চিরন্তন অবদান বিধৃত আছে ভারতের দুটি স্বদেশি সাহিত্যে—বাংলা ও উদুর্তে।’ ‘এই দুই সাহিত্য ধরে রেখেছে উনিশ শতকের গোড়ায় সূচিত ‘অন্তরের অনুসন্ধান’-এর ফলাফল।’

আবদুর রাজ্জাকের মতে, ‘ভারত ভাগ হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আপসহীন বিরোধের পরিণাম।’ যা-ই হোক, ভাবাদর্শের জগতে যা ‘জাতীয় রেনেসাঁ’ (কিংবা জাতীয়তাবাদ) নামে পরিচিত, তার অনন্য ফল ছিল ‘রাজনীতির ময়দানের এই পরিণাম’। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক ইতিহাসবিদ যেমন বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু তা ছিল জাতীয় রেনেসাঁর অঙ্গ ও প্রকাশ।’ আবদুর রাজ্জাক ইতিহাসবিদ সীতারামাইয়ার লেখা থেকে আরও একটি বড় অংশ তুলে ধরেন, ‘এসব আন্দোলনে (হিন্দুধর্মীয় ভাবাদর্শগত স্কুলগুলোর উল্লেখ করে) ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় কর্তব্যের নানা ধারা ও উপধারার সম্মিলন ঘটেছিল। ফলে পূর্বসংস্কার ও কুসংস্কারমুক্ত হয়ে, পুরোনো বিশ্বাস ভেঙেচুরে নবায়নের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে, বেদের ভাবাদর্শ ও নবযুগের জাতীয়তার সঙ্গে মেলববন্ধন সৃষ্টির একটি অবকাশ ঘটেছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সেই মহান কর্তব্যটি সম্পন্ন করে।’

এর পরে আসে, যদি আমরা আলোচনা করতে চাই, উঠতি মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়াদের প্রশ্ন। আবদুর রাজ্জাক লিখছেন, ‘ভারতে কংগ্রেস বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলোর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য থেকে ফুটে উঠেছে যে এসবের সর্বাত্মক নেতৃত্বে ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি।’ ‘অন্যদের অংশগ্রহণ ছিল পরের ধাপে,’ আবদুর রাজ্জাত লিখছেন, ‘কিন্তু নেতৃত্ব ছিল অনন্য।’ আবদুর রাজ্জাক জোরালোভাবে বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর বৈশিষ্ট্যের ওপর শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের মূল খাসলতের মার্কা মেরে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এমনকি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিণতিও শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর মধ্য দিয়ে সাধিত হয়নি।

আবদুর রাজ্জাক বোধগম্য কারণেই বিশেষভাবে আলো ফেলেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় শেষ ২৫ বছেরর ওপর (অর্থাৎ ‘ভারত সরকার আইন ১৯১৯’ পাস হওয়ার পরের সময়টায়), যখন ভারতীয়দের কাছে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক শক্তি হস্তান্তরিত হতে থাকে। রাজনৈতিক উত্তেজনার শুরুর দিনগুলোয়, ক্ষমতার চর্চা বিদেশি আমলাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, রাজনীতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে রঞ্জিত হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিনগুলোয় ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় খণ্ড খণ্ড করে। উভয় ঘটনাই রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের অমোচনীয় দাগ রেখে গেছে। এটিই সেই সময়, যখন তর্ক বা যুক্তি প্রদর্শন মুখোমুখি সংঘাতের রূপ নেয়।

আবদুর রাজ্জাক জোর দিয়ে বলছেন, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কোনো বিচারেই কেবল দেশীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল ছিল না। ‘স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যদি ভারতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সমাপ্ত হতো, যা কি না তড়িঘড়ি করে ঘটল, তাহলে ব্যাপক আকারে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের ক্রিয়া ও অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হতো।’ ঔপনিবেশিক সরকার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরস্পরের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আবদুর রাজ্জাকের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘রাজনৈতিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। এই শ্রেণিই ছিল মুখ্য। এদের মাধ্যমেই সরকার তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখত। সরকারের ওই শ্রেণির গলা টিপে ধরার প্রশ্নই উঠত না; কারণ তা ছিল সরকারের নিজেরই গলা টিপে ধরার শামিল।’ শেষের দিকে ঔপনিবেশিক ভারতের আইনসভার বিকাশ এভাবে সরকারের শাসনযন্ত্র গঠনের স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক আন্দোলনের বাইরে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসরমাণ ভারতের আরও দুটি লক্ষণ আবদুর রাজ্জাক চিহ্নিত করেছেন, ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার আধিপত্য আসে প্রথমত বেসামরিক ও সামরিক এই দুই অংশের বৈশিষ্ট্য ও গঠনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে।’ দ্বিতীয় ধারাটির ইশারা মেলে, ভারতে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হ্রাসের মধ্য দিয়ে। তাঁর দেওয়া তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯১৩ থেকে ১৯২৭ সালে ব্রিটেন থেকে অর্থ আমদানির পরিমাণ সত্যিই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, সাম্রাজ্যে ব্রিটিশ বিনিয়োগের হার হিসেবে ভারতের শেয়ারও ১৯২০-এর দশকে কমে গিয়েছিল। যুদ্ধের আগের কালপর্বে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিনিয়োগের প্রধান এলাকা, যা ছিল ৫৩ শতাংশ। অথচ ভারতের জন্য তা ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। ভারতের শেয়ার এমনিতেই খুব বেশি একটা ছিল না। ‘তবু ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সালে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে, ত্রিনিদাদ, জ্যামাইকা ও আইরিস ফ্রি স্টেটের সঙ্গে ভারত ১ শতাংশের এক-চতুর্থাংশ শেয়ার করছিল। ইংল্যান্ড থেকে ভারতে অর্থপ্রবাহ কোনোকালেই প্রবল ছিল না, কিন্তু এই পর্যায়ে এসে অংশত তা শুকিয়ে যায়।’ উপরন্তু ‘ভারতে বিনিয়োগ অব্যাহত থাকার সময়েও কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য মোটা অঙ্কের বরাদ্দ দেওয়া হতো না। বরং তা আসত সরকারি ঋণ হিসেবে।’

পরে অবশ্য ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় বাজারে ঋণ দিতে শুরু করে। সরকার এটি করে বৈদেশিক উৎস থেকে কোনো ঋণ না নিয়েই। ভারত সরকারের তৎকালীন অর্থবিষয়ক সদস্য স্যার বাসিল ব্ল্যাকেটের ১৯২৬ সালের ঐতিহাসিক ঘোষণাটিকে এখানে তার এক উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়। তিনি ঘোষণা করেন, ‘সরকারকে ২২ কোটি পাউন্ড ঋণ সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু ১৯২৬-২৭ সালের মধ্যে আমাদের বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকার তৃতীয় বছরের মতো বৈদেশিক ঋণ নেওয়া এড়িয়ে চলবে। বিদেশি ঋণ না নিয়েই ৩৫ কোটি পাউন্ডের বেশি নতুন আর্থিক প্রকল্পে অর্থের জোগান সরকারকে দিতে হবে।’

এ সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাকের মন্তব্য, ‘স্যার বাসিল ব্লাকেট ঘোষণা করে দিলেন যে ভারতীয় দৃশ্যপটে নতুন প্রভুরা আবির্ভূত হয়েছেন।’ রাজনৈতিক কাঠামো তত দিনে যে গুরুত্ব অর্জন করেছে, তখনো তার প্রকাশ ঘটেনি। রাজনৈতিক দলগুলো যা নিয়ে জোটবদ্ধ হতে পারত, আবদুর রাজ্জাকের মতে, ভবিষ্যতের জন্যই সেটি তোলা রইল। স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো অদূর ভবিষ্যতে যেসব পথ অনুসরণ করবে, তা ছিল একেবারে আনকোরা।

আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্ব বা বিচার, কেউ কেউ গ্রহণ করলেও, না পরিচিতি পেল, না চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠল। আমাদের গজবের দিনগুলোতেই হয়তো তাঁর তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা পূর্ণ মূল্য আমরা অনুভব করব। যাহোক, এখানে জায়গা বেশি নেই। তাঁর বিচার বা তত্ত্বের টিকে থাকার সামর্থ্য বা অন্যতর মূল্য অনুধাবনের জন্য আরও কোনো ক্ষণের অপেক্ষা করতে হবে, অন্ততপক্ষে তাঁর যা কিছু এখনো আমাদের কাছে আছে, সেসবের পুনরুদ্ধার হওয়া পর্যন্ত।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মিজান মল্লিক