বইপত্র

বিশ্ববিদ্যালয় তবে ইউরোপের সৃষ্টি!

নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীত
নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীত

শিশির ভট্টাচার্য্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব অনেকগুলো কারণে আগ্রহের উদ্রেক করে। গ্রন্থনাম এই আগ্রহ-উৎপাদনের প্রধান কারণ। এরপর অধ্যায়-বিভাজন দেখে আরও বেশি কৌতূহলী হতে হয়। ছোট–বড় ১১টি অধ্যায়ে গ্রন্থকার অনেকগুলো বিষয় তুলে এনেছেন। ‘কাকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়?’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির প্রেক্ষাপট’, ‘মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়’—এ রকম একুশটি অধ্যায় রয়েছে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বোলোনিয়া ও প্যারিস মডেল’, ‘বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়’ ইত্যাদি শিরোনামে লেখক আসলে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও এর ধারাক্রম তুলে ধরেছেন। গ্রন্থকারের ভাষ্যমতে, এটি একটি অনুবাদকৃতি। ফলে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, অনুবাদের মধ্য দিয়ে এই প্রথম বাংলা ভাষায় গ্রন্থিত হলো মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এজন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।

তবে কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি হয় বইটি পড়ার পর। বইয়ের নামে ‘আদিপর্ব’ সংযোজিত থাকায় এবং ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে কেবল ইউরোপের ঐতিহাসিক বিবরণ শুরু হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, এর আগে কি ইউরোপে কি ইউরোপের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। অনেকেরই জানা, প্রাচীন ভারতে শিক্ষার্থীরা গুরুর গৃহে থেকে বিদ্যা-অর্জন করত। মানছি, গুরুগৃহ বা আশ্রমকেন্দ্রিক ওই বিদ্যায়তনকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা ঠিক হবে না। তবে এর কারণ কি এই, তা বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় চলত? আরও জেনেছি, এই কারণসহ মোট পাঁচটি গুণ বা লক্ষণের ভিত্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বলা যায়। স্বীকৃত সনদের অভাবে ও নিজস্ব পাঠ-পদ্ধতির কারণে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বোধ করি একালের শিশির ভট্টাচার্য্যের মতো ইউরোপীয় কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সংজ্ঞায়ন করতে শিখেছিলেন; তাই তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিশ্বভারতীকে ‘বিদ্যালয়’ই বলেছেন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব



‘আদিপর্ব’ দেখে আশা করেছিলাম, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যাবে। কিন্তু গ্রন্থকার ওদিকে যাননি। বরং শুরু করেছেন এভাবে: ‘বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটির উৎপত্তি মধ্যযুগের ইউরোপে।...যে প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি, সেই প্রেক্ষাপট পৃথিবীর কোথাও অন্য কোনোকালে সৃষ্টি হয়নি।’ আর এই যুক্তিতে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছেন মধ্যযুগ-পূর্ববর্তী সময়কালের বা ইউরোপ-বহির্ভূত অন্য ভূখণ্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাহলে শিশিরের বিভিন্ন ধারাবাহিক রচনায় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তক্ষশীলার যে উল্লেখ, একে শেষ পর্যন্ত তাঁর ওইসব রচনার মতোই ‘রূপক ও ব্যঙ্গ’ হিসেবে ধরে নিতে হয়!

তক্ষশীলা নামটি এখনকার দেওয়া। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২৭০০ বছর আগে, প্রাচীন ভারতে। বেদ-ব্যাকরণসহ এখানে ৬০টির মতো বিষয় বা শাখা ছিল। জ্ঞান-অর্জনের জন্য বহির্বিশ্ব থেকে বহু শিক্ষার্থী তক্ষশীলায় এসেছেন। এখানকার বিখ্যাত শিক্ষার্থীর মধ্যে চাণক্য, পাণিনির নাম উল্লেখ করা হয়। প্রাচীনতম আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় বিহারে ৪২৭ খ্রিষ্টাব্দে—গুপ্তবংশের রাজা শকরাদিত্যের সময়ে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১১৯৭-তে। এখানে ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা। প্রতি রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারদের নিয়ে বসত মুক্ত আলোচনা। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার আকৃতিতে ছিল বিশাল; এবং এখানে ছিল বিভিন্ন শাস্ত্রের অজস্র পাণ্ডুলিপি।

এ ছাড়া বিক্রমশীলা, সোমপুরসহ আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন পরিব্রাজক এসব বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে গেছেন এবং তাঁদের বর্ণনায় লিপিবদ্ধ করেছেন। এগুলোসহ মধ্যপ্রাচ্য, চীন বা ইউরোপের অন্যান্য প্রাচীন বিদ্যায়তনকে এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বড়জোর মধ্যপর্ব তৈরি হতে পারে। গ্রন্থকার স্বীকার করেছেন, ‘সেনাবাহিনী ছাড়া মানব ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠান আর নেই।’ তাই যদি হয়, তবে খ্রিষ্টীয় ১৩-১৪ শতকের এই বিবরণকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিপর্ব বলা যায় কীভাবে? উপসংহার-পূর্ববর্তী সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ে তিনি অবশ্য প্রশ্ন রেখেছেন, ‘তক্ষশীলা, নালন্দা বা আরব দেশের উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে সমসাময়িক যুগে “বিশ্ববিদ্যালয়” বলা হতো কি না।’ আবার গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখের সূত্র ধরে জানতে চেয়েছেন, ওইসব উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি গঠনগত ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য কমবেশি ছিল কি না।’ এসব প্রশ্ন-উত্থাপনে এখানে লেখককে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছে। উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, ওই পাঁচটি গুণ বা লক্ষণের ভিত্তিতেই এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিপাদন করা সম্ভব।

শিশির ভট্টাচার্যের গদ্য শক্তিশালী; যদিও এই অনুবাদে সেই শক্তিমত্তার পরিচয় গরহাজির। প্রচুর বাক্যের শেষে হতো, করত, ছিল ইত্যাদি ক্রিয়াপদের একঘেয়েমি অবস্থান। বইটিতে খুব সীমিতভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের বানানত্রুটিও দেখা যায়। আবার বইয়ের ফ্ল্যাপে ও গ্রন্থাভ্যন্তরে আদিপর্ব ‘তিনশ বছর’ বলে দেখানো হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৪০০ পর্যন্ত দুই শ বছরকে! তবে শেষ পর্যন্ত মানতেই হয়, বাংলা গ্রন্থ-তালিকায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। অধিকন্তু আধুনিক শিক্ষাকাঠামোয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকার অর্থে কতটুকু ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়ে উঠতে পেরেছে, এটিও ভাবিয়ে তোলে এই বই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব
শিশির ভট্টাচার্য্য
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৮৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৫২০ টাকা।