‘বল বীর বল উন্নত মম শির’—কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আমাদের জাগরণের স্মারক। কালজয়ী কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সেই হিসাবে এখন ধ্রুপদি এ কবিতার শতবর্ষ। ‘বিদ্রোহী’র বিচিত্র প্রবাহে ফিরে দেখা।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের স্বতন্ত্র পরিচয় চিহ্নিত করতে যথার্থভাবেই ভূমিকা রেখেছে। কবিতাটি পত্রিকায় প্রকাশের আগে নজরুল তাঁর নামের আগে ‘হাবিলদার’ শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন এবং ‘হাবিলদার’ লেখা বাদ দেন। পরে তিনি রচনাবৈশিষ্ট্যেই ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিতি পান। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা না করলেও নজরুল হয়তো ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হতেন। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যে এ পরিচয় প্রতিষ্ঠায় নিয়ামক বিন্দু হিসেবে কাজ করেছে, সে কথা বলা যায়।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রশংসা করে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘মনে হলো এমন কখনো পড়িনি’। কিন্তু তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’য় ‘বিদ্রোহী’কে তিনিই স্থান দেননি। তবু বাংলা সাহিত্য থেকে দু-একটি কবিতার নাম বলতে বললে ‘বিদ্রোহী’কে বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, কাব্যস্বভাব ও প্রভাবে এই কবিতা বাংলা সাহিত্যে অনন্য। ‘বিদ্রোহী’তে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মজাগরণ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে তিনি বহুমাত্রিক রূপে প্রকাশমান। এ কবিতায় তিনি সব ধ্বংসকারী আবার স্রষ্টা; তিনি বিপ্লবী আবার প্রেমিকও; তিনি সর্বাংশে স্বদেশি আবার বিশেষভাবে আন্তর্জাতিকও; প্রচণ্ড আধ্যাত্মিক আবার ব্যাপকভাবে ইহজাগতিকও; এখানে নজরুল যেমন ভারতীয় পৌরাণিক দেবদেবীকে স্থান দিয়েছেন, তেমনি মুসলিম পুরাণের অনুষঙ্গাবলিও এনেছেন। যে প্রসঙ্গগুলো উত্থাপিত হলো, প্রিয় পাঠক, আপনি এর প্রায় সবটাই শুনে থাকবেন। কিন্তু যে উত্তরটি লিখিতভাবে বোধ করি কেউ দেননি বলে অনুমান তা হলো, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি শুধু ‘রচিত’ নয়, এটি কবির ওপর ভর করেছিল। এই ‘ভর করা’ কবিতাটির আগে এবং পরে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও ‘বিদ্রোহী’র সমান বা তার চেয়ে উচ্চতা ও মর্যাদাসম্পন্ন আর একটি কবিতা লিখতে পারেননি, অন্যরা তো ননই। সমকালে ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি হয়েছে—উত্তরকালেও; এর প্রতিক্রিয়ায়ও কবিতা লিখিত হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটির স্বতন্ত্র পরিচয় নেই।
বাংলা কাব্যাঙ্গনে আলোচ্য কবিতাটি খুবই প্রভাবক কবিতা। যেকোনো সময় বসে এটি লেখা যায় না; এমনকি যিনি ‘বিদ্রোহী’ লিখেছেন, তিনিই আর একটি ‘বিদ্রোহী’ বা এর মতো কবিতা লিখতে পারেননি। এটি যখন পত্রিকায় প্রকাশ পায়, তখন কাব্যকলার দিক দিয়ে কোনো কবিতাই হয়নি—এমন অভিযোগ ওঠে। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস কিংবা কবি গোলাম মোস্তফার লেখা প্যারোডি বিশেষত ‘আমি ব্যাঙ, আমার লম্বা দুটো ঠ্যাং’ খুব আলোচিতও হয়। কিন্তু অল্প পরে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের কাব্যবলয় ছিন্নকারী প্রথম ব্রহ্মাস্ত্রই হলো ‘বিদ্রোহী’।
নজরুলের বয়স যখন মাত্র ২২ বছর, তখন তিনি লিখলেন ‘বিদ্রোহী’। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক রাতের কথা জানাচ্ছেন নজরুলেরই কক্ষ-সহচর, পরে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহ্মদ। তিনি ‘বিদ্রোহী’ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে আমি তা জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। “বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’ এর একটু পরে মুজফ্ফর আহ্মদ আবার লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনতে পারত না। তার ঘুম সাধারণত দেরিতেই ভাঙত, আমার মত তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথম পেনসিলে লিখেছিল।’ মুজফ্ফর আহ্মদের ধারণা যদি সত্য হয় যে শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন, তাহলে কবিতাটি যে ‘ভর করা কবিতা’, এটি বলতেই হবে। কারণ ‘ঘোরে’ পাওয়া মানুষের মতো তিনি এটি লিখেছেন। আর যদি এই ধারণা সত্য না-ও হয়, অর্থাৎ ‘শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে’ কথাটুকু বাদ দিই, তবু রাত দশটা থেকে পর দিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত মাত্র আট ঘণ্টা সময়। এই আট ঘণ্টায় এক শ বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ পঙ্ক্তির একটি কবিতা লেখা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, বিশেষত ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা! কবিতাটি এক শ বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ পঙ্ক্তির এ কথা লিখলাম এ কারণে যে এটি পরে খানিকটা পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির ‘নজরুল রচনাবলী’র (১৯৯৬) পাঠে অবশেষে দাঁড়িয়েছে এক শ ঊনচল্লিশ পঙ্ক্তি। ‘বিদ্রোহী’ ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম বেরিয়েছিল সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে, পরে মাসিক ‘মোসলেম ভারত’, ‘প্রবাসী’ ইত্যাদি সাময়িকীতে প্রকাশ পায়। ‘অগ্নি-বীণা’র বিভিন্ন সংস্করণের পাঠেও স্তবক বিন্যাসে ও একটি-দুটি শব্দে সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। তবে এতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চারিত্র্যে কোনো পরিবর্তন হয় না। এই আলোচনায় বিবেচনা করি এক শ ঊনচল্লিশ পঙ্ক্তির কবিতা—যেটা আছে বাংলা একাডেমির ‘নজরুল রচনাবলী’তে (১৯৯৬)।
‘শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ বলে যিনি প্রথমেই স্বমহিমায় ঘোষণা দিলেন, তিনি কবিতার শেষে ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির’ বলে এখানে গাইলেন আত্মসত্তার গান। শুরু থেকে শেষ অবধি একেবারে ‘আমি’ আর ‘আমি’! এই আত্মসত্তার কথকতা কিন্তু ‘ভর করা’ পদাবলির বড় বৈশিষ্ট্য। ভর করা অন্য পদগুলোতেও আত্মসত্তার জয়গান আছে—অর্থাৎ সেখানে ‘আমি’ই মুখ্য। সেই পদগুলোয় ‘আমি’ এমন শক্তিমান হিসেবে আবির্ভূত, অনুসারীরা সেই শক্তিকে সমীহ করে, মানে এবং ভাবে এর বাইরে যাওয়া মানেই ধ্বংস অনিবার্য। ‘বিদ্রোহী’তে–ও তেমনি। ‘আমি’ শক্তির উত্থান—এই গুণটির কারণে অবশ্য অনেকে বলেছেন, মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ কথিকার প্রভাবেই নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখেছেন। মোহিতলালও এ কথাই মনে করতেন। নজরুল তখন সক্রিয় লেখার জগতে। মোহিতলালের বক্তব্য নিয়ে সরাসরি তিনি কোনো কথা বলেননি। বলবেনই–বা কেন? এক সুফলা রজনীতে তিনি যে আলোর কুণ্ডু পেলেন, তার ওপর কোনো ছায়াই স্থায়ী হবে না—এ বিশ্বাস বোধ করি তাঁর ছিল।
‘বিদ্রোহী’তে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রে অসংগতি ও শোষণের বিরুদ্ধে কবিজনোচিত প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এই কবিজন বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের সাধারণ কবি নন। অন্তত ‘কোরবানী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘শাত্-ইল্-আরব’ ইত্যাদি যে ছন্দোগতিসম্পন্ন তা এখানে নেই। নজরুল অন্য থেকে তো ভিন্নই, পৃথক নিজের থেকেও। তখনকার প্রচলিত কাব্যঢঙের সঙ্গে বড্ড ‘বেমানান’ ছিল ‘বিদ্রোহী’র ঢং। এই বেমানানটাই চমক। কী বিন্যাস, কী শব্দ প্রয়োগ, কী বক্তব্য ধারণ—কোনো দিক থেকেই এটিকে প্রচলিত কবিতা বলেননি কেউ।
মুজফ্ফর আহমদের সাহচর্য নিশ্চয়ই নজরুলের মনে বিরূপ রাজনৈতিক সমকাল নিয়ে ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল। তবে ‘বিদ্রোহী’ সমাজবাদের পক্ষের ঝান্ডাও হয়ে ওঠেনি। ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’—এটিই কবিতাটির একমাত্র চেতনা নয়। মনে হয়, ‘বিদ্রোহী’তে নজরুল বহু ‘বাণী’ ধারণ করলেন—অপ্রচলিত শব্দবন্ধে, একেবারে নতুন আঙ্গিকে। এই বাণীগুলো তাঁর লেখনীর ডগায় এসেছে, আর তিনি তা অতি দ্রুততার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন। মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন, ‘দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথম পেনসিলে লিখেছিল।’ ফাউন্টেন পেন ছিল না—এটি একটি কারণ। কিন্তু নজরুল কেন পেনসিলে কবিতাটি প্রথম লিখেছিলেন—মুজফ্ফর আহমদের এই ধারণার সঙ্গে চূড়ান্ত বিরোধে আমরা যেতে পারি না। সাহিত্য সৃষ্টির সঙ্গে যাঁদের যোগ, বিশেষত কবিতা যাঁরা লেখেন—তাঁরাই কেবল বুঝবেন, যেকোনো সৃষ্টির পেছনেই মাথা ও হাতের ‘ব্যাটে–বল’ হওয়া কতটা জরুরি; মহৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তো বটেই।
মাত্র বাইশ বছরের এই কবি ভারতীয় পুরাণ সম্পর্কে এত জানেন! জানেনই যদি, এত চমৎকার দক্ষতায় সেগুলো তিনি স্থাপন করলেন কবিতায়! প্রায় অসম্ভব নয় কি? কবে শিখলেন এ সব পুরাণকথা? নজরুলজীবনীকারদের দ্বারস্থ হয়েও এর যথাযথ উত্তর পাওয়া যায় না। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ব্যবহৃত ভারতীয় পুরাণ, স্পষ্ট করে বললে হিন্দুধর্মীয় অনুষঙ্গগুলোর তালিকা ও ব্যাখ্যা করলে আর একটি পৃথক পুস্তিকা হতে পারে। কিন্তু অবলীলায় সেগুলো ব্যবহৃত হয়েছে ‘বিদ্রোহী’তে। মনে হয়, এই কবিতায় নজরুল কর্তৃক ব্যবহৃত ভারতীয় পুরাণের সূত্র ধরে নজরুলজীবনের কোনো এক অনুদ্ঘাটিত দিক উন্মোচনের সুযোগ আছে। নজরুলের শৈশবে আরবি পড়ার, করাচিতে ফারসি পঠনপাঠনের বিস্তর উল্লেখ ও কল্পনার জালবিস্তার জীবনীকারেরা করেছেন। কিন্তু একজন নবীন যুবার ভারতীয় পুরাণে স্বচ্ছন্দ অধিকার কীভাবে হলো তার, তত্ত্বতালাশ তাঁরা করেননি। বিশেষত যে নবীন যুবার নাম ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ অর্থাৎ সনাতন হিন্দুর ঘরে নয়, মুসলিম মৌলভির ঘরে যাঁর জন্ম। এর আগে হাতে গোনা তাঁর যে কবিতাগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এই করণকুশলতার সামান্য ইঙ্গিতও নেই। অবশ্য ভারতীয় পুরাণ ব্যবহারের সঙ্গে নজরুল মুসলিম পুরাণও প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরেছেন: হাবিয়া দোজখ, ইস্রাফিলের শিঙ্গা, বোরবাক, জিব্রাইলের পাখা। এর পাশাপাশি আবার এসেছে গ্রিক পুরাণের অর্পিয়াসের বাঁশি। তবে ভারতীয় পুরাণের যে ব্যাপক ও বহুমাত্রিক ব্যবহার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আছে, আর কোনো বাংলা কবিতায় তা একেবারেই নেই বলা চলে। এই কবিতায় নজরুল দ্বৈতাদ্বৈতবাদী পথকে ব্যবহার করেছেন অনেক ক্ষেত্রে। যেমন পুরাণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মসম্প্রদায়কে অদ্বৈতভাবে উল্লেখ করেছেন: সপ্ত নরক (রৌরব)> হাবিয়া দোজখ, প্রণবনাদ> ইস্রাফিলের শিঙ্গা, উচ্চৈঃশ্রবা> বোরবাক, বাসুকির ফণা> জিব্রাইলের পাখা। অন্যত্র ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’; ‘আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন’; ‘আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,/ কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা—’। কিন্তু এ সবই কবিতাটি জন্মের সঙ্গেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই কবিতায় মোটেও বড় কোনো ‘ঘষামাজা’ করতে হয়নি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে লেখা, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ, এরপর মাসে মাসে বিভিন্ন সাময়িক পত্রে পুনর্মুদ্রণ।
‘বিদ্রোহী’কে বাংলা কবিতায় প্রচলধ্বংসী বা ‘ব্রেক থ্রু’ বলা যেতে পারে। ষাণ্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত মুক্তক ছন্দে রচিত এ কবিতায় অতিপর্ব নিয়ে এমন ‘ছেলেখেলা’ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যাবে না। কিন্তু মনেই হয় না, অতিপর্ব ‘অতি’ কিছু! বিশেষত ‘আমি’কে যখন সম্মানে সামান্য দূরে রাখা হয়, তা যেন কবিতার ভাবকেই মূর্ত করে। শুধু অতিপর্ব কেন, পর্ব নিয়েই খেলেছেন কবি। কোথাও দুই পর্ব, কোথাও তিন আবার কোথাও তার বেশি। পর্বের এই দোলনে কিন্তু পড়তে গতিশ্লথ হয় না। এ যেন পাথুরে পথের ঘোড়া। পথের বন্ধুরতাই এর গতিবৃদ্ধির সহায়ক-ছন্দোগতি। শব্দ এখানে বহুমাত্রিক জ্যোতিষ্ক হিসেবে সংস্থাপিত। এই কবিতার একটি শব্দ থেকে অন্য শব্দের গমনরেশ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
বাংলা কাব্যাঙ্গনে আলোচ্য কবিতাটি খুবই প্রভাবক কবিতা। যেকোনো সময় বসে এটি লেখা যায় না; এমনকি যিনি ‘বিদ্রোহী’ লিখেছেন, তিনিই আর একটি ‘বিদ্রোহী’ বা এর মতো কবিতা লিখতে পারেননি। এটি যখন পত্রিকায় প্রকাশ পায়, তখন কাব্যকলার দিক দিয়ে কোনো কবিতাই হয়নি—এমন অভিযোগ ওঠে। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস কিংবা কবি গোলাম মোস্তফার লেখা প্যারোডি বিশেষত ‘আমি ব্যাঙ, আমার লম্বা দুটো ঠ্যাং’ খুব আলোচিতও হয়। কিন্তু অল্প পরে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের কাব্যবলয় ছিন্নকারী প্রথম ব্রহ্মাস্ত্রই হলো ‘বিদ্রোহী’। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে এই কবিতা হয়ে ওঠে বীজমন্ত্র। বাঙালি যখনই আত্মমুক্তি চেয়েছে, তখনই তার কণ্ঠে ‘বল বীর-চির উন্নত মম শির’ হয়েছে উচ্চারিত। একান্ত পাঠ থেকে আবৃত্তি—সব জায়গায় এর প্রভাব ব্যাপক। তাই ‘বিদ্রোহী’ শুধু নতুন কাব্যদ্বারই উদ্ঘাটন করেনি, মানবচেতনার বাতায়নও খুলে দিয়েছে। এটি কবিতামাত্র নয়, বাঙালির জাগরণ স্মারকও নিশ্চয়।