বানানবিভ্রাট

লুইস ক্যারল, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
লুইস ক্যারল, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

১.

বানান ঠিক হলো কি না, তা নিয়ে আমাদের সবারই দুশ্চিন্তা থাকে। মণীষা নাকি মনীষা—লিখতে গিয়ে সব গড়বড় হয়ে যায়। পত্রিকা অফিসে কখনো কখনো কোনো সহকর্মীর পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁদের লেখার দিকে চোখ পড়ে। সাংবাদিকদের ভুল বানান ধরিয়ে দিলে দুই রকম প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ তা জেনে নিয়ে বা অভিধান দেখে ঠিক করে নেন, কেউ বলেন, তাহলে প্রুফ আছে কেন—অর্থাৎ লেখার দায়িত্ব আমার, বানান ঠিক করবে সম্পাদনা সহকারীরা।

সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউ কেউ বানান-বিড়ম্বনায় ভুগেছেন সারা জীবন। তাঁদেরই কয়েকজনের কথা বলছি এখানে। সঙ্গে তাঁদের জীবনের অন্য কিছু বিষয়ও থাকল। তাঁদের মধ্যে দুজনের ছিল ডিজলেকশিয়া। মানে, লিখতে, পড়তে ও বানান করার ক্ষেত্রে স্নায়ুতন্ত্রের অক্ষমতা। মগজের কোনো অংশ ঠিকভাবে কাজ না করলে এ রকম হয়।

এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর লেখক লুইস ক্যারলের নাম কে না জানে। সুররিয়ালিস্টিক রূপকথার প্রবর্তক বলা হয় তাঁকে। তিনি কোনোদিন শুদ্ধ বানানে বাক্য লিখতে পারতেন না। ভিক্টোরিয়ান যুগে ভদ্রলোকদের মধ্যে এ ধরনের বানান ভুল করত খুব কম শিক্ষিত মানুষই। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না।

সেই লুইস ক্যারলই আবার অক্সফোর্ডে পড়ার সময় প্রমাণ করে ছেড়েছেন, অঙ্কে তাঁর মাথা ভালো। গণিতের ওপর লেকচার দিয়ে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। জীবনের ২৬টি বছর গণিতের সঙ্গেই ছিলেন। ক্যারল গণিত ভালোবাসতেন না, কিন্তু এতে আয় ছিল বেশি। সাহিত্যের পাশাপাশি গণিতের ওপরও লেখালেখি করেছেন তিনি।

২.

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখক জীবনও ছিল বানান ভুলে ভরা। কোনো কিছু দেখে এবং পড়ে না বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁকে অনেকেই ‘অশিক্ষিত লেখক’ বলত। এমনকি একটা পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘যে লেখক একটা শব্দও ঠিকভাবে লিখতে পারে না, তাকে লেখক হিসেবে মানা যায় না।’ তাতে অবশ্য অ্যান্ডারসনের লেখালেখি থেমে যায়নি। পৃথিবীর মানুষ এখনো তাঁর লেখা পড়ে এবং আনন্দ পায়। তবে বলে রাখা ভালো, শব্দ ও বাক্য পরিমার্জনার জন্য তিনি কম অর্থ ব্যয় করেননি।

রুশ লেখক পুশকিনের লেখা খুব পছন্দ ছিল অ্যান্ডারসনের। পুশকিনের একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার বাসনা ছিল তাঁর মনে। পুশকিন যেন তাঁকে একটা অটোগ্রাফ দেন, সে জন্য বহু মানুষকে তিনি অনুরোধ করেছেন। অবশেষে ১৮১৬ সালে পুশকিনের ‘এলিজি’ কবিতার সঙ্গে একটি অটোগ্রাফ এল অ্যান্ডারসনের হাতে। অ্যান্ডারসন মারা যান ১৮৮৫ সালের ৪ আগস্ট। মৃত্যুর আগপর্যন্ত পুশকিনের অটোগ্রাফ তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।

৩.

মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নিজের মতো করেই লিখতেন। বলতেন, লেখার কাজ আমার, কিন্তু সেটা পড়ার দায়িত্ব পরিমার্জনাকারী আর সম্পাদকদের। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় রয়েছে, ‘এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক গাড়ি।’ তেমনি লেখক হিসেবে হেমিংওয়েও ভাবতেন তিনি রাজাধিরাজ।

তবে নিজের লেখকজীবনেও বাজে রসিকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন হেমিংওয়ে। গত শতকের মহামন্দার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে যেভাবে পেরেছিল, সেভাবেই টাকা কামিয়ে নেওয়ার ধান্ধা করেছিল। সে সময় সেখানে আবির্ভাব হলো এক নকল হেমিংওয়ের। নকল হেমিংওয়ের চেহারা ছিল অবিকল আসল হেমিংওয়ের মতো। এই লোক হেমিংওয়ে সেজে টাকার বিনিময়ে পাঠকদের সামনে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন। টাকার বিনিময়ে দিতে শুরু করলেন অটোগ্রাফ। এসব যখন ঘটছে, তখন সাহিত্যমহলে তৈরি হলো বিশাল স্ক্যান্ডাল। সে সংবাদ পৌঁছে গেল হেমিংওয়ের কাছেও। খুব বিরক্ত হলেন তিনি। লাজুক হেমিংওয়ে পাঠকের মুখোমুখি হতে চাইতেন না। পাঠকের সামনাসামনি হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মনে ভীতি কাজ করত। একেবারেই অটোগ্রাফ দিতে চাইতেন না তিনি। তবে কোনো কোনো ভক্তের কাছে নতি স্বীকার করতে হতো তাঁকে। এ রকমই একজন ভিক্টর হিলি। পুরো তিন মাস হেমিংওয়ের পেছনে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন তিনি। শেষে বিরক্ত হয়ে হেমিংওয়ে লিখলেন হিলির অটোগ্রাফ খাতায়, ‘ভিক্টর হিলি, যে একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা, যাকে “না” করা হলেও তা বুঝতে পারে না।’