এক গলি ঢুকে গেছে আরেক গলির পেটে, অলিগলির চক্কর এখানে বোঝা কঠিন! ৩৭, ৩৮, ৩৭-এর ক, খ...এমন অজস্র নাম, অঢেল গলি। কিন্তু গলিতে ঢুকলেই নাকে খুশবু জাগায় বইয়ের গন্ধ। চারপাশে সার সার বইয়ের দোকান, ভেতরে রাশি রাশি বই। বাংলাবাজার, বইয়ের বাজার—এই বাজার মোটেই নিস্তরঙ্গ নয়, এর নিজস্ব একটি ঢেউ আছে; বিশেষত ফেব্রুয়ারির বইমেলার সময়ে পুস্তকপাড়াটি যেন বইয়ের গন্ধে ম-ম করে। বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ এলে তাই মনে হতে পারে ‘এলেম নূতন দেশে’। আমার মতো অ-ঢাকাইয়ার অবস্থা সংগত কারণে প্রায় তথৈবচ। পুরান ঢাকার এই বাজারের অলিগলিতে একটু-আধটু ঘুরেছি, কিন্তু এর আবহ ও আবহাওয়া বিষয়ে আমি তো বিস্তর অশিক্ষিত। বইপত্রে এ সম্পর্কে পড়েছি বটে, তবে সেকাল আর একালের বাংলাবাজারের চেহারা আঁকার ক্ষেত্রে সেই পাঠ বড়ই মাজুল।
বাঙালির বাজার থেকে বাংলাবাজার
আচ্ছা, বাংলাবাজার নামটি কীভাবে এল?
ঢাকা পুরাণ বইয়ের ‘ফুলবাড়িয়ায় জসীমউদ্দীন’ নিবন্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পুস্তক বাজারের এক চিলতে ছবি এঁকেছেন মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক মীজানুর রহমান: ‘সেকালে বইপাড়া বলতে বাংলাবাজার আর লয়াল স্ট্রিটকে বোঝাত। পুরোনো বইয়ের জোরটা ছিল বাংলাবাজারেই। চেটোনেটো লয়ালে আশুতোষ, স্কুল বুক সোসাইটি বিল্ডিং নামাঙ্কিত ত্রিতল ভবন আজও চোখে ভাসে। অনতি দূরে সিম্পসন রোডের মাথায় ছিল কলকাতা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে আসা ইসলামিয়া লাইব্রেরি, বাবুবাজারে চৌমাথার ডান পাশের গলিতে ওসমানিয়া বুক ডিপো আর বাবুবাজার পুলের ওপর মাখদুমিয়া অ্যান্ড আহসান উল্লাহ লাইব্রেরি। আরেকটি বইপাড়া ছিল চকবাজারে—ব্রিটিশ ও মোগল আমলের ছিটেফোঁটা গন্ধ তখনো পাওয়া যেত এই এলাকায়।’
বেশ বোঝা যায়, মীজানুর রহমানের এই ‘সেকাল’ পাকিস্তান হওয়ার অব্যবহিত পরের। আজকের সঙ্গে সেকালের বাংলাবাজারের মিল সামান্যই। অল্পস্বল্প যা মিল, তা একটি রাস্তার। সাবেক জিপিও ভবন থেকে পি কে রায় সড়ক (বাংলাবাজার রোড) নামে যে পিচঢালা রাস্তাটি চলে গেছে এখনকার ক্যাফে কর্নার পর্যন্ত, অনেকের মতে, সেটিই ছিল মূল বাংলাবাজার। তো, সেদিন সরেজমিনে ওই রাস্তায় চক্কর খেতে খেতে একের পর এক বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতে মারতে প্রশ্নটি এল মাথায়, বাংলাবাজার নামটি কীভাবে এল?
না, এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্যের হদিস পাওয়া যায় না, যেমন জানা যায় না এ বাজারের আদ্যোপান্ত ইতিহাস—কেমন করে এখানে গড়ে উঠল বইয়ের সাম্রাজ্য?
‘বাংলাবাজার এলাকাটি ছিল মোগল আমলের আগের ঢাকার একটি অতি পুরাতন অংশ। সেই যুগে এ এলাকা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। পরবর্তীকালে ঢাকা শহর পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হয় এবং চকবাজার হয়ে ওঠে এর মধ্যমণি। কতিপয় পরিব্রাজক “বেঙ্গলা নগর”-এর কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকে মনে করেন, বাংলাবাজার ছিল সেই নগরের কেন্দ্রস্থল। ...বাংলাবাজার এলাকাটি যে খুবই প্রচীন সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই।’ এই বাজার গড়ে ওঠার ইতিহাস তালাশ করতে গিয়ে ঢাকা গবেষক নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকার শরণ নিলাম আমরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে হুবহু একই রকম কথা বলেছেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। তবে এর সঙ্গে তিনি উত্থাপন করেছেন আরেকটি প্রশ্ন, ‘...নাকি সুলতানি আমলে যখন “বাঙ্গালা” শব্দটি জনপ্রিয় হলো, তখন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এ বাজারের?’
উত্তরে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে সম্প্রতি যোগাযোগ করা হলে বাংলাবাজার নাম বিষয়ে মুনতাসীর মামুন বললেন, ‘আমার মনে হয়, শুরু থেকেই এখানে বাঙালিরা ছিলেন, হয়তো তাঁরা একটি বাজার গড়ে তুলেছিলেন, তাই এর নাম বাংলাবাজার।’
বইয়ের সঙ্গে জোড়
বাঙালির গড়ে তোলা বাংলাবাজারের জৌলুশ এখন বড়ই বাড়বাড়ন্ত। অপরিসর গলি, গলির ভেতরে থরে থরে বিভিন্ন প্রকাশনীর দোকান আর বই—বহুতল মার্কেটে আকীর্ণ এই এলাকায় এখন আকাশ দেখাই দায়। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে বাংলাবাজারের সংস্রব আকস্মিকভাবে ঘটেনি, আছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় স্থাপন করলেন বাংলার রাজধানী। ১৮৬০-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’, মানে ছাপাখানা। আর ১৮৬৫ থেকে ১৯০০—এই সময়পর্বে কলকাতার বটতলার পুঁথির আদলে বাংলাবাজারের পার্শ্ববর্তী চকবাজারে দেখা গেল অগুনতি মুসলমানি পুঁথি, গড়ে উঠল কেতাব পট্টি। বাংলাবাজারের সঙ্গে বইয়ের জোড় বাঁধার ক্ষেত্রে এই তিনটি ঘটনার প্রভাব আছে বৈকি।
গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, ১৮৫৭-তে সিপাহি বিদ্রোহের পরপর একটি-দুটি করে বইয়ের দোকান গড়ে ওঠে এখানে। সে সময় ছাপাখানাগুলো ছিল বাবুবাজারে এবং বাংলাবাজারে ছিল পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র। ১৮৬০ সালে হরিশচন্দ্র মিত্র সম্পাদিত কবিতাকুসুমাবলি নামে ঢাকা থেকে যে ‘পদ্যবহুল মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়, তার বিক্রয়কেন্দ্রও ছিল ‘বাঙ্গালাবাজার’। এ ছাড়া ব্রিটিশ রাজ্যত্বে উনিশ শতকের শুরু থেকে চকবাজার, পাটুয়াটুলী, মোগলটুলী প্রভৃতি স্থানে যেসব ধর্মীয় পুস্তকের দোকান গড়ে উঠেছিল, তাদের কেউ কেউ পরের দিকে ঠাঁই নিয়েছিল বাংলাবাজারে।
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯২১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা পূর্ব বাংলা যখন জেগে উঠল, সেই জাগরণ বাংলাবাজারকেও দিল দোলা। লেখক-সাহিত্যিকেরা এ এলাকাকে বেছে নিলেন আড্ডাস্থল হিসেবে। ১২ আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে (১৯২৫) বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মর্মবাণী বের হলো ২৬ নম্বর বাংলাবাজার থেকে। (সূত্র: ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আবুল মকসুদ)।
তবে ১৯৪৭-এর দেশভাগই প্রকৃত অর্থে নতুনভাবে বিন্যস্ত করল এই বই বাজারকে। অবিভক্ত ভারতে প্রকাশনাশিল্প মূলত ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক, পূর্ব বাংলার মানুষেরা সেখান থেকে বই এনে বিক্রি করতেন। ফলে দেশভাগের পর প্রকাশনাজগৎ এখানে যেন পেল নবযৌবনের তরঙ্গ। প্রথম দিকে নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট ওয়েজ, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরি, আল হামারা লাইব্রেরি, মালিক লাইব্রেরি, খোশরোজ কিতাব মহল, হার্ডসন অ্যান্ড কোম্পানি, পুঁথিপত্র প্রভৃতি—নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নিল এসব সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা। কলকাতা থেকে এপারে এসে দোকান খুলল মল্লিক ব্রাদার্স। সবাই-ই ঠিকানা করে নিল বাংলাবাজারে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, সেই সময় বাংলাবাজারের অধিকাংশ প্রকাশনীর কর্ণধার ছিলেন লেখক, সৃজনশীল মানুষ। নওরোজ কিতাবিস্তানের মালিক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী, গ্রেট ইস্ট লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী প্রাবন্ধিক বরকত উল্লাহ, কিংবা আল হামারা লাইব্রেরির মালিক ছিলেন কবি মঈনুদ্দিন। এভাবে প্রকাশনার সঙ্গে সৃজনশীলতার রাখিবন্ধন ঘটেছিল পঞ্চাশের উষালগ্নেই।
সেই পঞ্চাশের সময় বুড়িগঙ্গা ও সদরঘাট লাগোয়া এই বাজার সম্প্রসারিত হয়েছিল যতটা না সৃজনশীল বইয়ের হাত ধরে, তার চেয়ে বেশি পাঠ্যপুস্তককে কেন্দ্র করে। বিশেষত ষাটের কালপর্বে যখন গড়ে উঠল পূর্ব পাকিস্তান পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ওই সময় প্রধানত পাঠ্যবইকে অবলম্বন করে স্বাস্থ্যবান হতে শুরু করল বাংলাবাজার। ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বই—দুই রকম প্রকাশনায় বাজারটি ছিল রমরমা। বলা ভালো, সহায়ক বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের বড় অংশের জোগান এখনো আসে এখান থেকে।
সৃজনশীলতার হাওয়া
পূর্ব বাংলায় সেই যে সৃজনশীল প্রকাশনার উন্মেষ, তার ক্যানভাস আজ ঢের ছড়ানো। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রকাশনীর কার্যালয় অথবা বিক্রয়কেন্দ্র আছে বাংলাবাজারে। পঞ্চাশের পটভূমিতে এটি ছিল এক রাস্তার এবং এই পি কে রায় সড়কটিই (প্যারীদাস রোডসহ) ছিল বাংলাবাজার এলাকার প্রথম পাকা রাস্তা, প্রায় সত্তর বছর বাদে এখনকার বাস্তবতায় আরও বহু পথ মিলে একাকার হয়েছে এখানে। ষাটের দশক থেকে লক্ষ্মীবাজার, জগন্নাথ কলেজ (এখন বিশ্ববিদ্যালয়), বাহাদুর শাহ পার্কসহ বাংলাবাজারের আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছিল পুস্তক বিতান। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে সেটি আরও বর্ধিষ্ণু, সম্প্রসারিত। আর হ্যাঁ, খান ব্রাদার্স, আহমদ পাবলিশিং হাউস, মাওলা ব্রাদার্স, চট্টগ্রামের বইঘর, চলন্তিকা বইঘর, পুঁথিঘর (১৯৭১-এর পরে নাম হয় মুক্তধারা), বর্ণমিছিল, বুক কোম্পানি, বিউটি বুক হাউস—এসব সৃজনশীল প্রকাশনী ষাট ও সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে একদিকে যেমন এ দেশের সাহিত্যিকদের বেড়ে ওঠায় সহায়ক হয়েছে, তেমনি বাংলাবাজারের আলোও ছিল তারা। ‘আলো’ শব্দটি এখানে ভাবাবেগে নয়, ভেবেচিন্তেই লেখা হয়েছে। ফলে কথার সপক্ষে দু-একটি দৃষ্টান্ত এখন দরকারি হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে: শহীদ কাদরির প্রথম কবিতার বইয়ের প্রকাশক ছিলেন বইঘরের মোহাম্মদ শফি। খান ব্রাদার্সের মোহাম্মদ মোসলেম খান বের করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, হুমায়ুন কবীর, হুমায়ুন আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, এমনকি হুমায়ূন আহমেদের প্রথম চার উপন্যাসের প্রকাশকও তারা। আর মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা তো আমাদের দেশে বইমেলার প্রথম উদ্গাতাদের একজন, তিনিও প্রকাশ করেছেন অনেক তরুণের প্রথম বই।
লেখার এই অংশে ব্যবহৃত বেশির ভাগ তথ্যই কুড়িয়ে পাওয়া, কিছু আছে পুস্তকাদি থেকে খুঁটে খাওয়া, বাদবাকিটুকু পেয়েছি রাস্তায় হেঁটে, বিভিন্ন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলার সূত্রে। যেমন তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছি, কেমন ছিল ষাট-সত্তর দশকের বাংলাবাজার?
‘তখন এখানকার বেশির ভাগ দোকান ছিল একতলা। দোতলার ওপরে কোনো দালান ছিল না। ঘরগুলো কোনোটা টিনের, কোনোটা ছিল চুন ও মাটি-সুরকির গাঁথুনিতে গড়া। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম এখানে রড-সিমেন্ট ব্যবহার করে দালান নির্মাণ শুরু হয়। তখন দোকানপাট সব ছিল প্রধান সড়কের ওপরে, ভেতরে কোনো দোকান ছিল না। এখন যেখানে মান্নান মার্কেট, সেখানে দাঁড়ালেই দেখা যেত বুড়িগঙ্গা নদী।’
১৯৬৫ থেকে বাংলাবাজারে আসা-যাওয়া নওরোজ সাহিত্য সম্ভারের অধিকর্তা ইফতেখার রসুল জর্জের। তাই তাঁর চোখ দিয়ে একপলকে দেখা হলো ষাট-সত্তরের বাংলাবাজার।
সেকালে প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন আকবর হোসেন, আকবর উদ্দীন, বেদুইন সামাদ, বেদুইন শমসের, নজিবর রহমান, রোমেনা আফাজ ও কৃষ্ণগোপাল বসাক নামের এক লেখক। এই কৃষ্ণগোপালের রিক্তের বেদন উপন্যাসটি সে সময় দশ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। তথ্যগুলো দিতে দিতে ১৯৬৬-এর ছয় দফার বছর থেকে বাংলাবাজারকে চেনা খান ব্রাদার্সের বর্তমান মালিক কে এম ফিরোজ খান বললেন, ‘জসীমউদ্দীন, আবু ইসহাক, সরদার জয়েন উদ্দীন, সত্যেন সেন, আবুল ফজল, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান—এঁরা ছিলেন সিরিয়াস ঘরানার লেখক, এঁদের বইও চলত; কিন্তু বিক্রির দিক দিয়ে ওঁরা ছিলেন শীর্ষে। ষাট থেকে আশির দশক অব্দি আমরা যেকোনো বই একটি সংস্করণে হয় সাড়ে বারো শ, নয়তো সাড়ে বাইশ শ কপি ছাপতাম, এর কোনো নড়চড় হতো না।’
বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলিময় পুরোনো ঢাকার বাংলাবাজারে বসে আরও একজন প্রকাশক ফিরিয়ে আনলেন হারানো সময়ের স্মৃতি। স্টুডেন্ট ওয়েজের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহর ছেলে তিনি, মোহাম্মদ লিয়াকত উল্লাহ। তাঁর কথায় ফুটে উঠল এখানকার কবি-লেখক-শিল্পীদের আড্ডা, ‘বয়স্ক লেখক-শিল্পীদের আড্ডা প্রধানত হতো আমাদের স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে। এর বাইরে সেই সময়ের অপেক্ষাকৃত তরুণেরা আসর জমাতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে।’
তাঁর কথা শুনি আর আমাদের মনে পড়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের আত্মস্মৃতি তিন পয়সার জ্যোৎস্নার দিনরাত্রিগুলো, কী অনুপম গদ্যেই না সোনালি দিনের সেই সব বৃত্তান্ত লিখেছেন সৈয়দ হক!
পুরোনো দিনের হাওয়া বারবারই ঘোরাঘুরি করে এখানকার প্রকাশকদের ভাষ্যে। এঁদের একজন অনন্যার মনিরুল হক, পৈতৃক সূত্রে এসেছেন প্রকাশনা ব্যবসায়। ‘স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত নতুন কিছু প্রকাশনার জন্ম হওয়া ছাড়া বাংলাবাজারে খুব বেশি ভাঙচুর হয়নি।’ তাঁর এ কথার সাক্ষ্য দেন আরেক প্রকাশক, সময় প্রকাশনের প্রতিষ্ঠাতা ফরিদ আহমেদ। নিজের স্মৃতিকথা ফরিদ আহমেদের প্রকাশকনামা ও হুমায়ূন আহমেদ-এ তিনি লিখছেন, ‘...তখন বাংলাবাজারে অনেক টিনের টংঘরে বইয়ের দোকান ছিল। ...আমি তাজমহল বুক ডিপো দেখেছি। বেশ বড় টিনের চৌচালা ঘর। ...এসব টিনের ঘর ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল মার্কেট।’
এ বাস্তবতায় একদল তরুণ প্রকাশক এলেন ব্যবসায়। শুরু হলো ভাঙাগড়ার নতুন উন্মাদনা।
নতুন উন্মাদনা
উন্মাদনাই বটে। এ সময় বাংলাবাজার হয়তো নিজেকে ছাড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল। একতলা, দোতলা ভবনগুলো ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠতে থাকল। পাশাপাশি আশির মধ্যভাগ থেকে নব্বইয়ের শুরুর দিকে, ছয়-সাত বছরের মধ্যে গড়ে উঠল বিদ্যাপ্রকাশ, আফসার ব্রাদার্স, অনুপম, আগামী, অনন্যা, অবসর, কাকলী, সময়, পল্লব, দিব্যপ্রকাশ, প্রতীক—সৃজনশীল বইয়ের এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এত দিন বাংলাবাজারে যাঁরা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই ব্যবসাটি পেয়েছিলেন পরম্পরাসূত্রে; উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেকে, কেউবা আবার নানা প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে হাত পাকিয়েছিলেন। এ পর্বে ঘটল ব্যত্যয়, নতুন দু-চারজনও এ পথ মাড়ালেন বইপত্র ভালোবেসে। মুদ্রণ ব্যবস্থায় তখন চলেছে দারুণ ভাঙাগড়ার কাল, মান্ধাতার আমলের লেটার প্রেসের স্থলে এসেছে অফসেট, লেমিনেটিং চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, বইয়ের বাঁধাইও আগের চেয়ে মজবুত। স্বভাবত প্রচ্ছদও ঝেড়ে ফেলেছে তার প্রাচীন খোলস। তবে কি নতুন উন্মাদনার যুগে সবকিছু নতুন হয়ে উঠল কোনো জাদুর ছোঁয়ায়? সেটি জাদুই ছিল। জাদুকর এলেন আর পাল্টে দিলেন খোলনলচে। এত দিন যাঁরা ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় কী নীহাররঞ্জন গুপ্তের পাঠক, সেই তাঁরাই ভীষণ আদরে লুফে নিলেন তাঁকে। তো, সেই জাদুকরের নামটি কি আর মুখ ফুটে বলতে হবে? হুমায়ূন আহমেদ। প্রায় একাই তিনি দাঁড় করিয়ে দিলেন বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্প। না, কথাটি পুরোপুরি ঠিক হলো না, হুমায়ূনের সঙ্গে এ সময় দুর্দান্তভাবে সংগত করলেন ইমদাদুল হক মিলন। হুমায়ূন-মিলনের হাত ধরে নব্বইয়ের শুরুতে ভেঙে গেল এক সংস্করণে সাড়ে বারো শ বা সাড়ে বাইশ শ বই বের করার দীর্ঘদিনের রীতি। এর বিপরীতে পাওয়া গেল আরেকটি ছবিও:Ñপ্রথম সংস্করণেই অনেক বই নেমে এল পাঁচ শ-এর কোঠায়।
বাংলাবাজারে লেখকদের আড্ডা কমতে থাকল, প্রকাশকেরাই উল্টো ছুটতে থাকলেন লেখকের বাড়িতে—হুমায়ূন-মিলনের ডেরায়।
তাঁদের পথ অনুসরণ করে নব্বইয়ের শেষাশেষি জনপ্রিয় লেখকের তালিকা বাড়ল। পাঠকেরা ছুঁয়ে দেখলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হকসহ আরও কয়েকজনের বই। বিশ শতক শেষে নতুন সহস্রাব্দের সূর্য তখন আমাদের দুয়ারে আসন পেতেছে।
কেবল ছয়টি অক্ষর—বাংলাবাজার। এই বাজারের হাত ধরে যেভাবে বেড়ে উঠেছে মুদ্রণ, প্রকাশনাশিল্প ও বাংলাদেশি সাহিত্য; পেছন ফিরে দেখি সে ইতিহাসের সূর্য সব সময়ই সমুজ্জ্বল, কত কত ‘শুঁয়োপোকা’ ‘প্রজাপতি’ হয়ে উঠেছেন এ বাজারে এসে! এখান থেকেই তো আলোর মুখ দেখেছে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, রশীদ করিম, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ, মোহাম্মদ রফিক, সেলিনা হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক থেকে শুরু করে শহীদুল জহির, শাহাদুজ্জামান ও শাহীন আখতারদের বই। একদিকে লোকপ্রিয় লেখক অন্যপ্রান্তে সিরিয়াস—দুই গোত্রের সাহিত্যিকদেরই বাংলাবাজার আশ্রয় দিয়েছে জননীর মতো।
বইয়ের এই হাটবাজারে
পুরোনো ঢাকা পেরিয়ে বইয়ের হাটবাজার এখন যদিও ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ঢাকায়, তবু বাংলাবাজারের মাহাত্ম্যÍএকটুও টোল খায়নি তাতে। প্রকাশকদের তথ্যমতে, বর্তমানে এখানে বইয়ের দোকান আছে প্রায় দুই হাজার। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খুচরা ক্রেতারা হরহামেশা এখান থেকে বই কিনলেও এখন এটি বইয়ের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। দেশের সব প্রান্তে এখান থেকে সরবরাহ করা হয় সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বই। বাংলাবাজারের একাধিক সৃজনশীল প্রকাশকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন এখান থেকে ছয়-সাত লাখ টাকার মতো সৃজনশীল বইয়ের লেনদেন হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল অব্দি এই হার থাকে একটু বাড়তির দিকে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও অন্যপ্রকাশের প্রধান মাজহারুল ইসলামের কথায়, ‘চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ মিলিয়ে কখনোবা চল্লিশ লাখ টাকার মতোও বিক্রি হয়।’
আর পাঠ্যপুস্তক থেকে বিক্রি? তার সঠিক হিসাব কেউ জানাতে পারেননি, কেবল বলেছেন, ‘প্রতিদিন কোটি টাকার ওপরে...।’
এখানে এখন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিভুক্ত প্রকাশক আছেন ৭৮ জন। আর পুরোনো সংগঠন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য তিন শর বেশি। সব মিলে সদস্যসংখ্যা চার শর ঘর ছুঁয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন অনেক প্রকাশক। অক্ষরবিন্যাস, মুদ্রণ, পেস্টিং, বাঁধাই ও লেমিনেশন—বইয়ের প্রশস্ত কর্মযজ্ঞে বাংলাবাজারের বইপাড়াকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করছেন লক্ষাধিক লোক।
এন্তার লোক, কত রংবেরং—প্রতিদিন তাদের হাজারো রকমের চক্কর, এই বই আসছে, ওই বই যাচ্ছে! গায়ে গা ঘেঁষে একসঙ্গে পার হচ্ছে মানুষজন আর বইপত্র। এর মধ্যে ঢাকাইয়া কোনো প্রকাশক দোকানের কর্মচারীকে হয়তো হেঁকে বলছেন, ‘আবে বাবলা, বইয়া বইয়া মাক্ষী (মাছি) মারবার লাগছস ক্যালা (কেন)? যা বে হালা, লৌড়া (দৌড়া বা দৌড় দে), বইগুলা লয়া আয়...’
পরের দৃশ্যে নিরুচ্চারভাবে গো গো করতে করতে পাশের দালান থেকে বাবলা নামের ছেলেটি নিয়ে আসবে এক গাট্টি বই...
আহা, বাংলাবাজার মানে তো এমন অসংখ্য লেখাজোখাহীন ছবির জ্যান্তব বোঝাপড়া!
বাংলাবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার
*মোগল আমলের আগে বাঙালিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত
*সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে ছিল বিক্রয়কেন্দ্র
*১৯৪৭-এর দেশভাগের পর নতুন বিন্যাসের সূচনা, শুরু হলো প্রকাশনা–পর্ব
*পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল—দুই ধারার বই ছিল প্রকাশনার প্রথম থেকেই
*পুরোনো খোলস ভাঙল ১৯৮৫-এর পর
*বর্তমানে দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার
*প্রতিদিন সৃজনশীল বইয়ের লেনদেন ছয়-সাত কোটি টাকা
*মোট প্রকাশক চার শর বেশি
*এই বইপাড়াকে ঘিরে জীবিকা গড়ে তুলেছেন লক্ষাধিক লোক
সূত্র: বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা