বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের চিত্রকলা

.

অনেক অবাধ্য ছেলে আছে যাঁরা সংসারের নিয়ম মেনে চলেন না, কিন্তু বিশেষ প্রতিভা কিংবা বিশেষ মানবিক গুণাবলির জন্য তাঁরা জগৎ সংসারের সবার কাছে আদুরে ও স্মরণীয় হয়ে থাকেন। খেলাচ্ছলে নিয়ম ভাঙা চিত্রকলার ক্ষেত্রেও এমনটা নিশ্চয়ই বলা যায়। বলছি, বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে প্রদর্শিত বাংলাদেশের সমসাময়িক ২৬ শিল্পীর ‘প্রোলগ ০১’ বা ‘প্রস্তাবনা ০১’ প্রদর্শনীর চিত্রকলা প্রসঙ্গে। প্রথিতযশা এই শিল্পীদের কাজ বাংলাদেশের চিত্রকলার চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে এই প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের চিত্রকলা দেখারও একটা সুবর্ণ সুযোগও বটে।

‘ওয়াটার স্কেপ’, শিল্পী: রফিকুন নবী

শৈলী তৈরির অভিপ্রায়ে এ দেশের অধিকাংশ শিল্পী নিজের সৃষ্ট ভঙ্গি, মুদ্রা, টেক্সচার, ফর্ম ইত্যাদি পরিবর্তন করতে চান না। তাই তাঁদের চিত্রে এসবের পৌনঃপুনিক ব্যবহার একসময় রসভঙ্গের কারণও হয়ে থাকে। সমসাময়িক প্রজন্মের তরুণ শিল্পীদের বিষয় অন্বেষণ ও মাধ্যমগত নিরীক্ষা বাদে প্রায় সব শিল্পী মোটামুটি শৈলীকেই আঁকড়ে ধরে চলেন। বিষয় নির্বাচন, করণকৌশল, টেক্সচার দেখে এমনটা প্রথমেই চোখে পড়ে এ প্রদর্শনীতে। তবে রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, ফরিদা জামান, রোকেয়া সুলতানা, শেখ আফজাল, শিশির ভট্টাচার্য্যের কাজে বিষয়, শৈলী, গড়ন, বুনন, ড্রয়িং, রং লেপনে স্বকীয়তার পুনর্নির্মাণ থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে খেয়ালি লীলা চিত্রজমিনে হৃদয়কাড়া সুরে আচ্ছন্ন হয়, প্রাণ জুড়ায় এবং মনে রাখে স্থায়ী ছাপ।

নির্মল প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায় আবদুল মান্নানের ‘রূপসী বাংলা’ ও আহমেদ শামসুদ্দোহার ‘রিভাইভাল অব সুনদরবনস’–এ। এ যেন আলোকচিত্রধর্মী অঙ্কন শৃঙ্খলায় নিসর্গের বন্দনা। পাশাপাশি বাস্তবানুগতার বিপরীতে লীলামগ্ন রূপনির্মাণে বিমূর্ত ব্যঞ্জনা আছে মুর্তজা বশীর, হামিদুজ্জামানের ভিন্ন স্বাদের কাজে। দুজনের কাজে দৃষ্টান্তমূলক বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এ ছাড়া মাহমুদুল হক, কালিদাস কর্মকার, মোহাম্মদ ইউনুস, মুস্তাফা খালিদ পলাশ, আবুল বারাক আলভীর কাজ বিমূর্ততাকে কেন্দ্রে রেখে স্বকীয় শৈলী জানান দিতে ব্যস্ত। শাহাবুদ্দিন আহমেদের ভিন্নধর্মী ব্রাশিং ও গতি তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস।

‘ইমেইজ ৭’, শিল্পী: মুর্তজা বশীর। বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে (সিবিএল ডিভাস্তা সেন্টার) চলছে এ প্রদর্শনী

আবার সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুস শাকুর শাহ, কনক চাঁপা চাকমার চিত্রে এ অঞ্চলের মাটি, মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সাহিত্যিক উপাদান, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নকে দৃষ্টিনন্দন হৃদয়গ্রাহী করে সহজভাবে ব্যাখ্যা করে, অন্তর ছুঁয়ে যায়। মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামানের ‘গল্প’ সিরিজের নারীর রং বিন্যাসে মনকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। আর রণজিৎ দাসের ‘ইমোশন’ এবং নিসার হোসেনের ‘নরকের ডায়েরি’তে পাওয়া যায় বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংকেতিক অভিধা। সবমিলিয়ে এ প্রদর্শনীটি বৈচিত্র্যের বিভায় উজ্জ্বল।

প্রদর্শনীকে প্রামাণ্যকরণ করতে মুস্তাফা খালিদ পলাশের সম্পাদনায় শিল্পীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও খ্যাতিমান শিল্প-সমালোচকদের লেখা সংযোজিত দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থ আমাদের চিত্রকলার গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলেই মনে হয়। এ উদ্যোগের দ্বিতীয় ধাপ সাজানো হবে প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী শিল্পীদের কাজের সম্ভারে। এমন পরিকল্পনার জন্য প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা মুস্তাফা খালিদ পলাশ অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন।

প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ১৩ জুলাই, শেষ হবে ৯ আগষ্ট।