বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র, বিশাল জগতে, এর গল্প-কবিতা-উপন্যাসে, এত এত থিম নিয়ে কাজ হয়েছে যে ভাবলে মাথা ঘুরে যায়। একদিকে প্রেম, মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতক ও দেশপ্রেমের মতো চিরায়ত থিম। অন্যদিকে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব, বল্গাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিপদ—এসব তুলনামূলক আধুনিক থিম। প্রতীক্ষাও সাহিত্যের চিরায়ত থিমগুলোর একটি। কিন্তু ‘বর্বরদের জন্য প্রতীক্ষা’? ইদানীংকালের মধ্যেই আমি এই থিম নিয়ে আধুনিক সাহিত্যের পাঁচ বড় তারকা-লেখকের পাঁচটা বিখ্যাত লেখা খুঁজে পেয়েছি এবং বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে গেছি তাঁদের একজনের চিন্তার সঙ্গে আরেকজনের—পাঁচজনের দেশ ও সময় আলাদা হওয়া সত্ত্বেও—এই অবাক করা মিল দেখে। এর অর্থ এটাই হতে পারে যে বড় লেখকেরা সম্ভবত সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। তা বাসতেই পারেন, সেটা জোসেফ কনরাডও বাসতেন, এমনকি এ সময়ের ভি এস নাইপলও বাসেন। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের উপরিতলের জন্য প্রতীক্ষা, কাব্যিক বিলয় বা ধ্বংস ঘটতে দেখার জন্য বাসনা—একটু বেশি হয়ে গেল না? সেই বেশিটাই ঘটেছে পাঁচ লেখকের পাঁচ লেখায়। এক এক করে আসি, অতি সংক্ষেপে।
প্রথমে বিখ্যাত গ্রিক-মিশরীয় কবি সি পি কাভাফি, যাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত তিন-চারটি কবিতারই একটি ১৯০৪ সালে লেখা ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস’। কবিতাটি শুরু হচ্ছে এভাবে, কাভাফির টিপিক্যাল গদ্য ঢঙে: ‘এই বাজারে আমরা সব জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছি কেন?/ বর্বরতা আসবে আজ, তাই।/ সিনেটে কোনোকিছু ঘটছে না কেন?/ সিনেটরদের অধিবেশন চলছে, কিন্তু আইন পাস হচ্ছে না কেন?/ কারণ, আজ বর্বররা আসছে।’ এরপর কবিতাটা এগিয়ে যেতে থাকে নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে—স্বয়ং সম্রাটসহ রাষ্ট্রের রথী-মহারথী সবাই অপেক্ষা করে থাকে বর্বরদের জন্য। এত সময় সবাই দেখা যায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল—রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, সবাই উদ্বিগ্ন মনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তখন কবিতাটার শেষ হয় এইভাবে: ‘...এখন রাত, আর বর্বররা এল না এখানে।/ কিছু লোক এল সীমান্তের ওদিক থেকে/ তারা বলল, বর্বররা আর ওখানে নেই।/ এই বর্বরদের ছাড়া আমরা এখন আর করবই বা কী?/ এক অর্থে, ওরাই তো ছিল আমাদের সমাধান।’ কী রহস্যময় এক শেষ!
এরপর আমি ফ্রানৎস কাফকায়। বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের এই অন্যতম প্রধান লেখক ১৯১৭ সালে লিখলেন তাঁর ছোট গল্প ‘পুরোনো পাণ্ডুলিপির একটি পাতা’, যা আজ তাঁর জনপ্রিয় গল্পগুলোর একটি। এই গল্পটা আমরা শুনি এক মুচির জবানে, যার একটা দোকান আছে শহরের প্রধান স্কয়ারে। এই রাজধানী শহরে, যেখানে রয়েছে সম্রাটের প্রাসাদও, এবার ঢুকে পড়েছে উত্তরের বর্বররা; তারা কাঁচা মাংস খায়, তাদের ঘোড়াগুলোও মাংসখেকো। তারা তাদের বর্বরতার চূড়ান্ত করে ছাড়ল যখন তারা এক কসাইয়ের তাজা ষাঁড় সবাই মিলে জ্যান্ত খাবলিয়ে খাবলিয়ে খেল। দেশরক্ষার ভার কিনা সম্রাট এখন ছেড়ে দিয়েছেন সব মুচি, কসাইয়ের মতো লোকদের হাতে। কাফকা গল্প শেষ করলেন সামনে কেয়ামত নেমে আসবে সে রকমই এক ঘোষণা দিয়ে: ‘কিন্তু দেশরক্ষার কোনো যোগ্যতা আমাদের নেই; আর না আমরা কোনো দিন দাবি করেছি যে সে যোগ্যতা আমাদের আছে। পুরোটাই একটা ভুল বোঝাবুঝি; আর আমাদের ধ্বংসও নেমে আসবে সে কারণেই।’
এরপর ইতালিয়ান লেখক দিনো বুজ্জাতির অপর উপন্যাস দ্য তাতার স্টেপ; ফ্রান্সের প্রভাবশালী লাঁ মঁদ পত্রিকার হিসেবে বিশ শতকের প্রধান এখনো বইয়ের তালিকায় ২৯ নম্বরে আছে যেটি। ঘোর লাগানো এই উপন্যাসটির শুরু এভাবে: ‘এক সেপ্টেম্বরের সকাল। সামরিক বাহিনীতে নতুন যোগ দেওয়া জিওভাগ্নি দ্রোগো শহর থেকে রওনা দিল বাস্তিয়ানি দুর্গের উদ্দেশে; এটাই তার প্রথম পোস্টিং।’ এই বাস্তিয়ানি দুর্গ আছে উত্তরের সীমান্তের কাছে, এটা পেরোলেই তাতার বর্বরদের মরুময় তৃণপ্রান্তর বা স্তেন। এখানেই সারাটা জীবন কেটে যায় দ্রোগোর—একটাই অপেক্ষায় যে একদিন তাতাররা আসবে, যুদ্ধ হবে, সে বীরের মতো লড়বে। কী নির্বান্ধব, নির্মনুষ্য এক পরিবেশ, আর একজন মানুষের জীবনভর অপেক্ষার পেছনে কী দম-বন্ধ-করা এক আশা—বর্বরতা আসবে। কিন্তু ওই ভিনদেশি আগ্রাসন কি ঘটে কখনো? সেটা বলে দিয়ে আমি পাঠকদের উপন্যাসটি পড়ার মজা নষ্ট করতে চাইছি না।
দিনো বুজ্জাতির ১৯৪০ সালে লেখা এই উপন্যাসের লেজে লেজেই বেরোল ফরাসি জুলিয়ান গ্রাকের দ্য অপোজিং শোর; একই লাঁ মঁদ পত্রিকার গত শতাব্দীর সেরা ১০০ বইয়ের তালিকায় ৬৫ নম্বর এটি। বেরোনোর বছরেই ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার গকুঁর জিতে নিল এই উপন্যাস, কিন্তু নিভৃতচারী গ্রাহাম অত বড় পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করলেন। এখানে কাল্পনিক শহর ভেজ্জানো থেকে আসা নায়ক আলডের আর ভালো লাগে না এই সভ্যতা, এর ক্ষয় এর অধঃপতন। নেভির এক ঘাঁটিতে সে নিজেই নিজের পোস্টিং নিয়ে নিল; দেশের সীমান্তে অবস্থিত তার এই ঘাঁটি, এর নিচে বয়ে যাচ্ছে সারটেস উপসাগর আর ওর ওপারে শত্রুদেশ ফারগেস্তান, আলডোর দেশের সঙ্গে যার সুপ্ত যুদ্ধ চলছে ৩০০ বছর ধরে। কিছুই ঘটে না—যুদ্ধও হয় না, শান্তিও আসে না। আমরা শুধু জানতে পারি আলডোর স্বদেশি ভেজ্জানোর লোকেরা কত বীতশ্রদ্ধ তাদের দেশের সার্বিক দৃঢ়তার ধারণায়। একটা পুরো সভ্যতা তার নিজের একঘেয়েমি কাটাতে যেন আলডোর মধ্যে ভর করে বসে আছে কেয়ামতের প্রার্থনা করে—ফারগেস্তান থেকে বর্বররা আসবে, যুদ্ধ হবে; ক্ষতি কী? তারপর? এবারও থেমে যাচ্ছি এখানেই।
শেষ উপন্যাসটি সম্ভবত এ দেশের অনেকেরই পড়া—জে এম কুটসির ১৯৮০ সালের বেস্টসেলার ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস। ২০০৩ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকান এই লেখক তাঁর এ উপন্যাসের থিম যে এসেছে কাভাফির কবিতা ও বুজ্জাতির দ্য তাতার স্টেপ থেকে, তা সরাসরিই স্বীকার করেছেন। এর নায়ক এক ম্যাজিস্ট্রেট সে তার হাতে ন্যস্ত শহরটা চালাচ্ছে ভালোভাবেই। শহরটা সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী। শহরের সবাই অপেক্ষা করছে সীমান্ত পেরিয়ে যেদিন বর্বরতা আসবে, সেদিনের; কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, সেটা কখনো ঘটবে না। কিন্তু একদিন এল কর্নেল জোল, সবার মধ্যে সে এই বিশ্বাস ছড়াল যে সীমান্তের ওপারের বর্বররা অনেক ভয়ংকর; এবার পুরো শহর তাদের এত দিনের শান্তি পায়ে দলে ঘোরগ্রস্ত হলো এই ‘শত্রু’ নিয়ে। তারপর কত রক্তপাত, কত বর্বরতা, ম্যাজিস্ট্রেটের এক বছরে মতো জেল খাটা, চাকরি হারানো। একসময় তার মনে হলো ন্যায়ের পক্ষে সে একাই লড়ছে। সাধারণ মানুষের প্রতি সমব্যথী হওয়ার কারণে রাষ্ট্রের শত্রু হলো সে। রাষ্ট্র ভাবছে, সে বর্বরদের পক্ষের লোক। এখানে এ পর্যন্তই। পাঠক উপন্যাসটা পড়বেন এ—আশা নিয়ে এখানেই থামছি।
ভূবনবিখ্যাত এই পাঁচ সাহিত্যিকের ভিন্ন দেশ ও কালে লেখা পাঁচ বড় কাজের একই থিম—অপেক্ষা, বর্বরদের জন্য, ধ্বংস-বিলয়-কেয়ামতের জন্য। কে কাকে সভ্য বলছে, আর কার হিসেবে কে বর্বর—এই গূঢ় রাজনৈতিক প্রশ্ন স্পষ্ট মাথা তুলেছে পাঁচটি লেখাতেই, শুধু আবহশৈলী আর প্লটেই যা ফারাক। শেষে গিয়ে আমার থাকে শুধুই বিস্ময়বিমূঢ় এক প্রশ্ন—বোর্হেস যে বলেছিলেন, সারা পৃথিবীর সব লেখক আসলে একজনই মাত্র লেখক এবং সব লেখক একসঙ্গে মিলে লিখছেন একটাই মাত্র বই, সত্যই কি তাহলে তা-ই? আর জর্জ বুশের কুখ্যাত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকান বাহিনীদের অদৃশ্য বর্বরদের জন্য যে অপেক্ষা, তারও কি এত বড় সাহিত্যিক ভিত্তি আছে তাহলে?