গল্প

বধির যবনিকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল


আমাদের বাড়িতে তয়ফুর মামা আর সয়ফুর মামা, রমিজ মামা আর তমিজ মামা...এভাবে জোড়ায় জোড়ায় মামারা ছিল। তারও আগে মাতামহগো বেলায় ছিল হাফিজউদ্দিন-আফিজউদ্দিন... আফিজের মানে নাই, কিন্তু জোড়া আছে। প্রমাতামহের নাম আমি জানি না। সম্ভবত অত্যতিবৃদ্ধ প্রমাতামহ অবধি এই সব মিলের খেলা ছিল, মোসলমান না হইলে হিন্দু নামে, যা-ই হোক। এই সব গায়ের জোরে মিলানো জোড়ার ভেতর দিয়া তৈমুর মামা ছিল একখানা ব্যতিক্রম। ভিড়ের ভেতরেও সে উঁচায়া থাকত ব্যতিক্রমের মতো, ঔ-কারের মতো ঢেউখেলানো চুলের জন্য তারে আরও দিঘলা লাগত। বাট্টুগো সমুদ্রে সে সত্যকার তৈমুর লং, ইয়ে তৈমুর লং লম্বা ছিল কি না, আমি জানি না। তার গায়ের রং ছিল ফটফটা, আন্ধারে জ্বলে। খোশপোশাকি লোক, রাজাদের মতন চেহারা, খাড়া নাক, আয়ত চোখ, বাজখাঁই গলার আওয়াজ, আমাদের আটপৌরে ঘরে পাতলা তোশকের খটখটা বিছানায় বসে থাকলেও তারে মনে হতো যেন খাড়ায় আছে। তারে আমি প্রথম দেখি এক সেমাই-ঈদে। আমি তখন ছোট, ঈদের দুপুরে সাদা পোলাও আর দুধে রান্ধা কোর্মা চটকায় ছোট খালা খাইয়ে দিচ্ছে, সয়ফুর মামা এসে ছোট খালারে ঠোনা মেরে বলে, ‘দ্যাখ গা, আইছে!’

আমি সাথে সাথে চারফুটিয়া আপাদমস্তক কান হয়ে যাই, ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কে আসছে?’

সয়ফুর মামা আমার প্রশ্নরে পাত্তাই দেয় না। ছোট খালার সাথে নিচু গলায় কী যেন বলে। আমি পোলাও খাওয়া মুলতবি রেখে দৌড় লাগাই নানার শোবার ঘরে, ছোট খালা চিলের মতন ছোঁ মেরে ধরে আমারে, ‘ওড়না লইয়া যা।’ আমার এই জ্ঞান হয়, যে এসেছে তাকে দেখতে চারফুটিয়ারও এ কাঁধ-ও কাঁধ ওড়না মুড়ি দেওয়া চাই। শোবার ঘরে উঁকি দেওয়ার আগেই আমি ঠোকর খাই নানাজানের গায়ে, নানাজান খিলালকাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ঘেরা বারান্দায় যাচ্ছিল। আমি উদ্গ্রীব হয়ে উঁকি দিতে দিতে নানাজানকে জিজ্ঞেস করি, ‘কে আসছে, নানাজান?’

নানাজান সাধারণত আমার সব প্রশ্নের জবাব দেয়, এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমার কানের সীমার কাছে দাঁতে দাঁত পিষে নানাজান বলে গেল, ‘ব্ল্যাক শিপ।’ ও খোদা, ঈদ উপলক্ষে পাতা ফুলকাটা বিছানার চাদরে যে বসে আছে, কই সে তো কালো ভেড়া না, আস্ত লোক একটা। সয়ফুর মামাদের চেয়ে ঢের ভালো দেখতে। তয়ফুর মামা ছিল পাগল, তার কাজ ছিল ভেজা পেটিকোটের আড়াল থেকে খালাদের শুকাতে দেওয়া ব্রেসিয়ার বের করে এনে কাঁচি দিয়ে তাতে বেশুমার চোখ কাটা। আইলেটস। যেন অজস্র চোখ তাকায় আছে। সেই তয়ফুর মামাকেও তো নানাজান কালো ভেড়া, কালা কুত্তা এই সব কিছুই কয় না।

সে বহু বহুদিন আগের কথা। তখনো আরবের লোকে অসভ্য ছিল। তখন আমাদের রান্নাঘরগুলোতে সাঁড়াশি দিয়ে ডেগ নামানো হতো, ডালঘুঁটুনি দিয়ে অসেদ্ধ ডাল-বিলাই এবং আমাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হতো, খাস্তা নিমকপারা বানানোর একটা পিতলের চাকা ছিল, সেটার ওপরে আমার লোভ ছিল। সেতারা খালার গায়েহলুদে লাইজু খালা অভ্যাগত সবাইকে একই কাঁটাচামচে বেবি-গোল্লা খাওয়ায় দিয়েছিল, কারও অসুবিধা হয়নি। প্রায়ই মিলাদ শরিফ হতো, বাঁশকাগজের এন্তার ঠোঙায় মামারা প্যারাকি আর সন্দেশ ভরত সারা বিকেল। দিস্তা খাতা বলে একটা জিনিসের চল ছিল, মানে এক দিস্তা কাগজ কিনে এনে ভোমরকাঁটা দিয়ে সেলাই করে বানানো খাতা, সেটা অঙ্ক করে ফুরালে বোঝা গেল যে গণিত সাধনা হইছে। ঝরনাকলমের কালি থাকত দোয়াতে, সেই দোয়াত খুললেই একটা গন্ধ পাওয়া যেত, কালি ভরভর করে বের হলে চুলে মুছে ফেলা যেত। মানে, পুরোনো চিহ্ন বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সবই তখন বহাল ছিল। সেই আমলের ঈদে (যেহেতু আরবের লোকে তখনো অসভ্য ছিল) পিতলের কফগিরে পোলাও তুলে দিতে দিতে ফিকফিক করে হেসে ছোট খালা তৈমুর মামারে জিজ্ঞেস করল, ‘তৈমুর ভাই, আপনে এখন কার লগে সংসার করেন, মালার মা, নাকি শীলার মা?’

এই সব প্রশ্নের ভাঁজে একটা গর্হিতের সুর আছে, সেটা এ কাঁধ-ও কাঁধ ওড়না মুড়ি দেওয়ার বয়সেও বিলক্ষণ চেনা যায়। আমিও চিনলাম, কিন্তু শোলকটা ভাঙাইতে পারলাম না। ছোট খালার তৈমুর ভাই এই প্রশ্নের জবাবে মাথা হেঁট করে রইল, তার মুখে রক্ত জমল পষ্ট। ছোট খালা লক্ষ্যভেদ করার আনন্দে খিলখিল করে উঠল, ‘যার সাথেই করেন, ভাবিসাবরে নিয়া আইসেন বেড়াইতে। একা একা ক্যান আসেন?’ তৈমুর মামাকে আরও রক্তিম হয়ে ওঠা থেকে পরিত্রাণ করতেই হয়তো শামি কাবাবের প্লেট নিয়ে নানিজান ঢুকল খাবার ঘরে। তৈমুর মামার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা গেল, দাঁতে লাল ছোপ পড়ে গেছে এহ! নানিজান এ বেলা সুস্থ লোকের মতো আচরণ করছে দেখে আমিও খুশি হয়ে গেলাম।

বাকি নাটক আমার দেখার সদিচ্ছা থাকলেও পারলাম না। দীপা-নীপা-রূপা তিন বোন খেলতে এসেছে, ইটের সুরকি দিয়ে মসলা পেষাই হবে, লুচিপাতার লুচি, ব্লেড ধরে কচুরিপাতা ফালি ফালি করে কেটে ডাঁটার তরকারি। ঘরসংসার করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম বলে আমার আর কালো ভেড়ার বাকি ইতিহাস জানা হলো না। অন্তত সেই ঈদে।

পরের ঈদেও এই তৈমুর মামা এল, এবার তার সাথে আমার মুখোমুখি দেখা হলো জাফরিকাটা সিঁড়িবারান্দার খোপ খোপ আলো-অন্ধকারে, বাইরে থেকে যেখানে ঢুকলেই চক্ষে ধাঁধা লাগে, আমি না দেখে দৌড় লাগাতে গিয়ে ঢুঁ মারলাম তৈমুর মামার পেটে, সে বজ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কোনডা?’ আমি হকচকিয়ে গেলাম, আমি আমার অন্যান্য ভার্সন সম্পর্কে তখনো সচেতন নই, এই যে ব্যক্তির কত রকম ব্যক্তিক দিক থাকতে পারে, এই সব আমি তখনো জানি না। অতএব আমি কে, এই তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর দেব ক্যামনে? উত্তর না জানলে আমি যা করি, তা-ই করলাম, দৌড় লাগালাম। সেই ঈদে আমি ‘কুমির তোর জলে নেমেছি’ খেললাম, দড়ি লাফ প্রতিযোগিতা করলাম দীপা-নীপা-রূপা আর শিপুর সাথে (শিপু তদ্দিনে প্রতিযোগী হওয়ার মতো বড় হয়েছে। সামনে আরও আসবে এই রকম নাম মিলিয়ে মিলিয়ে, যদ্দিন একটা ছেলে না জন্মে।), রান্নাবাটিও খেললাম। ‘মোটকা-মুটকি কাঁঠালের কোষ/মোটকায় পাদ দিলে মুটকির দোষ’—এই সব ছড়া শিখে হেসে গড়ালাম। খাবার ঘরে ছোট খালার হাতে আবার তৈমুর মামার ‘কুমির তোর জলে নেমেছি’ দশা হলো কি না, তা জানতে পারলাম না।

ঈদের রাতে আম্মা এসেছে নানাবাড়িতে, আব্বা ঈদের ছুটিতে জয়দেবপুর গেছে, ছোট খালার একটা বিয়ে লাগি-লাগি করছে তখন, তা নিয়ে মহাসমারোহ এই বাড়িতে, এই সব রাতে মামাদের কাউকে পাওয়া যায় না, এমনকি তয়ফুর মামাও ব্রেসিয়ার কাটা বাদ দিয়ে মরিচবাত্তি নিয়ে কোথাও বের হয়ে যায়। তখন মালার মা-শীলার মা এই সব নিয়ে কথা উঠল। উদ্ভাসিত মুখে ছোট খালা কইতে লাগল, মালার মায়ের আসল নামটা তার সেই দিন পর্যন্ত মনে আছিল, কী তার ফিগার, কী সম্ভ্রান্ত দেখতে, শীলার মায়েরে বিয়া করার খবর শুইন্যা সেই যে সাজানো সংসার ছাইড়া গেল আর আসে নাই ফিরে। তার পরেও কি ব্ল্যাকশিপ থামছে নাকি! ইন্ডিয়া গিয়াও নাকি বিয়া করছে। পাসপোর্টই তার আছে পাঁচখান। চোরাচালানি করতে গিয়া জেলও তো খাটছে, এই জেলে গিয়াই পান খাওনের এমন বদভ্যাস হইছে। দাঁতগুলো কালা কইরা আনছে। ভাগ্য ভালো, নানি ঘরের ভোতরে মাচান বান্ধার প্রস্তাবে রাজি হয় নাই...এই সব কথা লোলুপ মুখে শুনবার অপরাধে আম্মা আমাকে কান পাকড়ায় বের করে আনল। নিজেও বের হয়ে আসল টাংস্টেনের বাত্তি জ্বলা সেই হলুদ আলোর ঘর থেকে। পরে সবাই যখন আনন্দমেলা দেখতে ব্যস্ত, আমি ঘেরা বারান্দায় জামরুলগাছটার কাছে চেয়ার টেনে বসে ছিলাম। নীপা বা রূপা কোনো একজন মাইর খেয়ে আকাশ-বাতাস এক করে কাঁদছে। শাওয়ালের চাঁদ ডুবে গেছে ততক্ষণে। সুনসান বিরলে আমার মনে হলো, তার মানে মালার মা আর শীলার মা আলাদা ব্যক্তি হওয়াটা খারাপ কথা, মালা-শীলা দুই বোনই এক মায়ের হলে তৈমুর মামাকে কেউ এমন করে লজ্জা দিতে পারত না? তা কী করে হয়, আব্বার অফিসেই তো শফিক চাচারে সবাই মিলে শরবত খাইয়ে নাকাল করে অজ্ঞান অবস্থায় আরেক বিয়ে করায় দিল! অজ্ঞান হয়ে বিয়ে করে ক্যামনে আমার খুব দেখার সাধ, রূপকথার ডালিম কুমাররে পর্যন্ত কঙ্কাবতীর ঘুম ভাঙায় বিয়া করণ লাগে যেখানে...যা হোক, বয়োজ্যেষ্ঠর দুনিয়া বহুত গোঁজামিলে ঠাসা।

এরপরের দুইবার আমরা ঈদের সময় জ্যাঠার বাড়ি গেলাম, নানাবাড়ি যাওয়া হলো না। গরমকালে সে বাড়িতে ঢুকলেই অবধারিতভাবে আম-কাঁঠালের তরমুজের সম্মিলিত ইথাইল অ্যালকোহলের মদির গন্ধ ঘা দিত নাকে। এই বাড়িতেই আমি প্রথম বেগম পত্রিকাটা চোখে দেখি, অন্তর্বাস ও স্তনবিষয়ক বিবিধ বিনোদনমূলক জ্ঞান লাভ করি এবং পুরকায়স্থ ভগ্নিদ্বয়ের লেখা পড়ি। আমাদের জেঠি কুরবানির পশুর তেলে মাংস ভেজে চাকা চাকা মাংস রেখে দিত খাটের নিচে ঝুড়ি ভরে, সেটা সারা বছর ঝুরি করে খাওয়া যেত নাকি। সংরক্ষিত মাংসের গন্ধ আর স্তনবিষয়ক পুস্তিকাগুলো আমার কাছে স্মৃতিতে ক্যামনে সমার্থক হয়ে গেল জানি না, হয়তো এভাবেই। জ্যাঠা ছেলেদের খুব বকত, সিনেমার খলনায়কদের নামে ডাকত আর বলত, ‘ছেলে দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হইয়া গেলাম! মনে হয় বাঁশঝাড়ের মইধ্যে বাসা বানাইছি।’ আমার খুব আদর ছিল, সত্যি, গোলাপি লেসের পরি-জামা কিনে দিয়েছিল জেঠি সেই ঈদে। আমি তবে কী? বাঁশবনে একখানা জাম্বুরাগাছ? ছেলেদের দেখতে পারত না বলে আর মেয়েশিশু ভালোবাসত বলে জ্যাঠারে লোকে ‘প্রগ্রেসিভ’ কইত। সেই বাড়িতে বিভোর হয়ে ঝর্ণাদাস পুরকায়স্থের লেখা পড়ার সময় কান খাড়া হয়ে গেল আমার, আব্বা বলছে, ‘আরেকটা বিয়া? মাকালডার দুঃখ কমে নাই তাইলে?’

তৈমুর মামারে আমি এরপরে বহুদিন দেখি নাই। কারও বিয়েতে, আকিকায়, মুসলমানিতে কোত্থাও না। তখন আমার এসএসসি দেওয়া শেষ, এরপর বিশাল ছুটি। সেই ছুটিতে নানাবাড়িতে গড়াগড়ি করে কাটাই, দিনের আধা বেলা শ্রাবণ-রাজা পড়ি, তারপর জি-সিনেমা দেখি। ছোট খালার তিন মেয়ে হয়েছে তদ্দিনে, তয়ফুর মামাকে স্থায়ীভাবে দিয়ে আসা হয়েছে কোনো গারদে, নানিজান বার্ধক্যজনিত অসুখে মারা গেছে বলে নানাজান দেশগাঁয়ের এক বিধবা বেওয়া মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে, সয়ফুর মামারা তাকে মা ডাকতে নারাজ। এই সব শোরগোলের ভেতর থেকে উত্তীর্ণ হওনের আশায় পুরোনো অ্যালবাম নিয়ে উঠে যাই তেতলায় ছাদের ঘরে। দেখি নানিজান সাদা-কালো ছবিতেও কত ফরসা, রানী সরকারের মতন খোঁপা করা আর চুলের লতা দুই কানের সামনে আনা। আমার আম্মার বিয়ের সব ছবি কেমন ঝাপসা। পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা কালচে একটা ছবিতে আমি দাদাজান আর নানাজানের মাঝখানে বসে দুইজনের গলা জড়িয়ে ধরে আছি। এই সব ঝুরঝুরে ছবির মহফিলে একটা সাদা-কালো ছবি, অতিশয় সুপুরুষ এক যুবকের সাইড ফেইস—ভালো করে দেখি তৈমুর মামার। স্টুডিও শ্যামলীতে তোলা ছবি। পেছনে মেয়েলি হাতে লেখা ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’। কে লিখেছে এই লাইন, মালার মা, নাকি শীলার মা? সয়ফুর মামা মামির সাথে লুডু খেলতে খেলতে বলে, ‘তয়ফুরের পাশেই এক ব্যাডা থাকে, সে অষ্টপহর আমাগো তৈফুররে কইতে থাকে, ওই পাগল ওষুদ খা, ভালো হবি!’ দীপার বিয়ে হয়ে গেছে, সে ফোলা পেট নিয়ে বাড়ির কাঠের দরজায় দাঁড়িয়ে দরদাম করে পটোল কেনে—ওই যেমন পেট হলে আমরা সবিস্ময়ে কইতাম, ক্যামন কিরমি হইসে দ্যাখ! নীপা প্রেম করে তার গানের মাস্টারের সাথে।

এভাবে প্রাকৃতিক সুধীরতায় আমি সেই বাড়িটা থেকে আলাদা হতে থাকি। এইচএসসি পরীক্ষা নাগাদ বিভাজনরেখাটা প্রায় বিদারণরেখায় পরিণত হয়। সেই উত্তরের ঘরটায় আর আমি নানাজানের বুড়া-মানুষগন্ধী বালাপোশের কোকুন বানায়া তার ভেতরে বসে থাকি না, ছুটির দুপুরের মন্থরতা পার করি না রাজ্যের সিনেপত্রিকা পড়ে। সেই রকম একটা সময়ে একদিন ছোট নানিজান আমারে এসে বলল, ‘শালটা গায়ে দে, তৈমুররে একবার চোখের দেখন দেইখ্যা আসবি।’ নানাজান মারা গেছে, আমি আর ছোট নানি নির্বিবাদে নানাজানের ব্ল্যাকশিপরে দেখতে চললাম। মায়াকাননের দিকে রিকশা ছুটে যাচ্ছে, সাঁই সাঁই করে বাড়িঘর উঠছে চারদিকে, হাসু-মাসুদের সেই গোলাপজামগাছটা নেই, সন্ধ্যা নেমে গেছে ঝপ করে, হোমিওপ্যাথির দোকানের সামনে ভিড় জমছে, শীত জাঁকিয়ে নেমেছে, আমি শালের কিনারায় কান ঢাকি। তৈমুর মামা তার অন্য ভাইদের সংসারেই থাকে, কিডনির রোগী, আর হয়তো বাঁচবে না, জীবনের সকল অনাচারের শোধ নিচ্ছে শরীর। ঘরগুলোতে খুব ধুনো দেওয়া হয়েছে। চোখ জ্বলছে আমার। আবার একটা হলুদ আলো জ্বলা ঘর আর সবুজ রং করা আলো-শোষক দেয়াল। সামনে ধুঁকছে প্রায় অনাত্মীয় এক রহস্যময় পুরুষ, যে আজকাল ডালের আমিষটুকুও খেতে পারছে না। তৈমুর মামার কঙ্কালসার মুখের কোথাও সেই দেবনিন্দ্য রূপের লেশমাত্র জেগে নেই। আমারে ছোট নানিজান ঠেলে দিল তার সামনে, সামনে আসবামাত্র তৈমুর মামা আমার হাত ধরল, দাঁতনের মতো শক্ত আঙুল, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। অনেকক্ষণ এমন অস্বস্তিকরভাবে চেয়ে রইল। আমি তাকাতে দিলাম, তাকিয়েই যাদের তুষ্টি তাদের আজকাল যে করুণাবশে তাকাতে দিই সেইভাবে। একবার ছোট নানিরে চিঁ চিঁ করে বলল, ‘এত মিল!’ কার সাথে মিল আমার? মালা-শীলা-মঞ্জিলা কার মায়ের সাথে?