গোয়েন্দা কাহিনির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গোয়েন্দা চরিত্রটি একসময় পাঠককে এতটাই আপ্লুত-আচ্ছন্ন করে ফেলে যে লেখকের নামটি তলিয়ে যায়—এ কথা মনে রেখে বলা যায়, বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে অবদান রয়েছে অনেকের। ‘ডিটেকটিভ’ নামের গল্পের মাধ্যমে এ জগতে কিছুটা স্পর্শ রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। কিন্তু বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির শুরুটা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা ও লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের হাতে। তাঁর ‘দারোগার দপ্তর’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডিটেকটিভ’—দুটি গল্পেরই প্রকাশকাল ১৮৯২। তবে গোয়েন্দা কাহিনির ধারাটি সৃষ্টি করেন পাঁচকড়ি দে (নীল বসনা সুন্দরী, মায়াবী)। আর কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যের ধারা সৃষ্ট হয়ে ওঠে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের লেখায় (আশ্চর্য হত্যাকাণ্ড)। পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা কাহিনি কখনো সরাসরি, কখনো দেশোপযোগী করে প্রকাশ করেছেন।
কোন গোয়েন্দা কার সৃষ্টি
যদি জিজ্ঞেস করা হয় গোয়েন্দা কল্কেকাশি এবং হুঁকাকাশির সৃষ্টা কে? কিংবা কিঙ্কর কিশোর রায় (কিকিরা) ও গোগোল কার গোয়েন্দা? দেখা যাবে আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। লেখকের নাম আর মনে করতে পারছি না। যথেষ্ট পরিচিত, স্বল্প পরিচিত ও প্রায় অপরিচিত কজন বাঙালি গোয়েন্দা—এবং তাদের যাঁরা সৃষ্টি করেছেন, সেই লেখকদের সম্পর্কে কথা উঠলে নিঃসন্দেহে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতুলনীয় সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সীকে দিয়েই তালিকা শুরু করতে হবে। এরপর আসবে সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য চরিত্র ফেলুদা।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মা, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি রায়ও খ্যাতিমান। অন্যদিকে বাংলাদেশে কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা ও মাসুদ রানা তো একাই কয়েকটি প্রজন্মের ওপর রাজত্ব করেছে। রোমেনা আফাজের বনহুর কিশোর রাজ্যে সেলিব্রেটি হিসেবে অবস্থান করেছে প্রায় দুই দশক। আর রাকিব হাসানের তিন গোয়েন্দারও আছে বিপুল পাঠকসমাজ।
এর বাইরে কলকাতা ও বাংলাদেশে আরও যাঁরা গোয়েন্দা ও রহস্য গল্প লিখেছেন—অখিল নিয়োগী, অভ্র রায়, অশোক কুমার মিত্র, মণীন্দ্রনাথ বসু, শরচ্চন্দ্র সরকার, কৃষানু বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম রায়, চিরঞ্জীব সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, নটরাজন, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, লীলা মজুমদার, শেখর বসু, সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী, হেমেন্দ্র কুমার রায়, আলী ইমাম, ফরিদুর রেজা সাগর প্রমুখ।
বাংলার অমর গোয়েন্দা
বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির স্বতন্ত্র ধারাটি অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বেগবান হয়ে উঠেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। তাঁরই সৃষ্ট গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী ছাপিয়ে গেছে রচয়িতাকেও। শরদিন্দু ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে রচনা করেছেন অনেকগুলো কাহিনি। ধারালো নাক, ঈষৎ জঙ্গলাকীর্ণ ভ্রু, গড়নে লম্বা—ব্যোমকেশের ছবি এমনই। বুদ্ধিবৃত্তিক চাল দিয়ে রহস্যজাল ভেদ করার অভাবনীয় ক্ষমতার অধিকারী এই চরিত্রটি। শরদিন্দুর ‘সত্যান্বেষী’তে তার আবির্ভাব; নিজের খেয়ে সত্যান্বেষণই ছিল প্রধান ব্রত। সে ফুটবলপ্রিয়, ধূমপান আর চা—তার চাই-ই। বাংলা সাহিত্যের খুঁটিনাটি ওর নখদর্পণে। তার আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশে, পরে কলকাতায় থিতু হওয়া—এসব তথ্য নিজেই অনেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ব্যোমকেশ।
প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা—সত্যজিৎ রায়ের হাতে তৈরি হওয়া এক অসাধারণ বেগবান চরিত্র। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর, বাংলা সাহিত্যকে সত্যজিৎ প্রথম উপহার দিলেন ফেলুদা চরিত্রটি। পোশাকি নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র হলেও সবাই তাকে চেনে ফেলুদা হিসেবেই। ইংরেজি কায়দায় সে নিজের নাম লেখে ‘প্রদোষ সি মিটার’। বয়স সাতাশের কাছাকাছি, লম্বা ছয় ফুট, হাতে চারমিনার সিগারেট। বেসরকারি গোয়েন্দা ফেলুদার নিবাস ২১ রজনী সেন রোড, বালিগঞ্জ, কলকাতা।
বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠে যোগব্যায়াম প্রাণায়ম করে ফেলুদা। পছন্দ করে খেতে। চারমিনার সিগারেটের সঙ্গে খায় পান। সিনেমা দেখা, গান শোনা—এসবেই তার আগ্রহ। ফেলুদার কথা বলার কৌশলটি অসাধারণ। কথা দিয়ে অপরাধীকে এমনভাবে বশীভূত করে যে ‘কনফেশন’ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে অপরাধী।
নয় বছর বয়সে পিতৃহারা ফেলুদা বেড়ে উঠেছে তার পিতা জয়কৃষ্ণ মিত্রের ছোট ভাইয়ের বাড়িতে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃত পড়াত তার বাবা। শার্লক হোমসের সার্বক্ষণিক সহযোগী ডাক্তার জন ওয়াটসনের মতো ফেলুদারও আছে তোপসে। পুরো নাম তপেশ রঞ্জন মিত্র। ফেলুদার কাকার ছেলে সে। ফেলুদার দুর্দান্ত ভক্ত তোপসের বয়স সাড়ে তেরো।
ফেলুদার প্রিয় বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলি জটায়ু ছদ্মনাম নিয়ে বাংলা ক্রাইম সিরিজের বইপত্র লেখে। অবিশ্বাস্য সব গল্প বোনে সে।
ফেলুদা সিরিজে মোট কাহিনি ৩৯টি। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দিয়ে শুরু, তারপর একে একে বাদশাহী আংটি, গ্যাংটকে গন্ডগোল, সোনার কেল্লা, বাক্স রহস্য, কৈলাশে কেলেঙ্কারি, রয়াল বেঙ্গল রহস্য, বোম্বাইয়ের বোম্বেটে, গোরস্থানে সাবধান—উপন্যাস এবং গল্প ‘কৈলাশ চৌধুরীর পাথর’, ‘গোলকধাম রহস্য’, ‘নেপোলিয়নের চিঠি’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’, ‘লন্ডনে ফেলুদা’, ‘রবার্টসনের রুবি’, ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’—এভাবে ফেলুদাকে একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। ফেলুদা কাহিনি থেকে সত্যজিৎ রায় নিজে বানিয়েছেন চলচ্চিত্র সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ; তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় বানিয়েছেন টিভি সিরিয়াল।
আরও কয়েকজন গোয়েন্দা
কল্কেকাশি—শিবরাম চক্রবর্তী, হুঁকাকাশি—মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কাকাবাবু—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শবর দাশগুপ্ত-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, গোগোল—সমরেশ বসু, ঋজু বোস—বুদ্ধদেব গুহ, গর্জন—হিমানিশ গোস্বামী, ভাদুড়ি মশাই—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার—সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, অর্জুন—সমরেশ মজুমদার, প্রলয়—দেবল দেববর্মণ, পাণ্ডব—ষষ্টিপদ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র—অদ্রীশ বর্ধন, গার্গী—তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণ—প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, দীপক চ্যাটার্জি—স্বপন কুমার, জাকি আজাদ—শেখ আবদুল হাকিম, কিশোর, মুসা ও রবিন—রকিব হাসান।