বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না : আল মাহমুদ

আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ১ জানুয়ারি ২০০৫
আল মাহমুদ। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ১ জানুয়ারি ২০০৫
‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা’ লিখেছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আলী মামুন

নাসির আলী মামুন: আধুনিক বাংলা কবিতার পুরোধা কবিদের এখন কেউ নেই। পরবর্তী কীর্তিমান কবিদের মধ্যে আপনি আর সৈয়দ শামসুল হক আছেন। পেছনের দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়?

আল মাহমুদ: অমিয় চক্রবর্তীকে দেখেছি। বুদ্ধদেব বসু তো কলকাতায় প্রথম আমার কবিতা ছাপলেন। আধুনিক কবিদের প্রায় সবাইকে দেখেছি, পরিচয়ও ছিল। পরিচয়ের আগেই তাঁরা আমার কবিতা পড়েছেন। বাংলাদেশে যাঁরা তখন আধুনিক কবি বলে নিজেদের দাবি করতেন, বুদ্ধদেব বসুরা ওঁদের অনেকের নামও জানতেন না। আমার সঙ্গের কবিরা এখন কারা আছেন বা নেই—খোঁজ রাখতে পারি না। চোখে দেখি না, কানেও অসুবিধা।

মামুন: উত্তরাধিকারসূত্রে অগ্রজ কবিদের কাছ থেকে কী কী পেয়েছেন?

মাহমুদ: পাঠ করার অভ্যেস। তাঁরা পাশ্চাত্য সাহিত্য প্রচুর পড়েছেন। আর কিছু নয়।

মামুন: জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্‌দীন—দুজনকেই আপনি বিবেচনায় রাখেন।

মাহমুদ: বিবেচনা কেন! তাঁরা দুজনেই বাংলা ভাষার ব্যতিক্রমী স্রষ্টা। জসীমউদ্‌দীন একজন মৌলিক আধুনিক কবি। তাঁকে আমি চিনতাম। দেখাও হয়েছে কয়েকবার। আমার কবিতা পছন্দ করতেন তিনি।

মামুন: গদ্য কবিতা জসীমউদ্‌দীন একেবারে পছন্দ করতেন না।

মাহমুদ: সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা হতে পারে। আমার অনেক গদ্য কবিতা পাঠ করে তিনি সাক্ষাতে মন্তব্য করেছেন। ভালো বলেছেন।

মামুন: আপনি তো তাঁর মতো লেখেননি?

মাহমুদ: তাঁকে আমি অনুসরণ করতে যাব কেন। তিনি প্রকৃত কবি ছিলেন বলেই কবিতা কী, তা বুঝতেন। অনেক কবি কবিতাই বোঝেন না।

মামুন: তাঁদের নিজেদের কবিতা?

মাহমুদ: তা-ও বোঝেন না।

মামুন: জীবনানন্দ দাশের মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ আপনার কাছে এসেছিলেন কেন?

মাহমুদ: এখন সেভাবে মনে নেই আমার, অনেক কিছুই আর মনে থাকে না, বয়স হয়েছে তো। তবে মঞ্জুশ্রী দাশ ঢাকায় দেখা করতে এসেছিল। কলকাতায়ও কয়েকবার দেখা হয়েছে।

মামুন: কী কথা হয়েছিল?

মাহমুদ: তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার বাবা কি আত্মহত্যা করেছিলেন। সে বলেছিল, না। অসতর্ক মুহূর্তে ট্রামচাপা পড়েছিলেন।

মামুন: মঞ্জুশ্রীর সঙ্গে লাবণ্য দাশকে নিয়ে কোনো কথা কি হয়েছিল?

মাহমুদ: আমার সঙ্গে আলাপে মায়ের নাম সে করেনি কখনো। বাবাকে সে খুব ভালোবাসত, এটা বলত। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে আমরা যা জানতে চাইতাম, সে ব্যাপারে সে কিছুই জানত না। মেয়ের কাছেও জীবনানন্দ অজানা কৌতূহলের বিষয় হয়েছিলেন বলে আমার ধারণা। রহস্যময়। মেয়ে তাঁর সম্পর্কে বেশি জানত না। তাঁর জীবনাদর্শ বা লেখার নেপথ্যের ঘটনাগুলো মঞ্জুশ্রীর কাছে জানতে চাইলে সে কিছুই বলতে পারেনি।

মামুন: শামসুর রাহমানের জীবিতকালে আমার নেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, শামসুর রাহমান যা লেখেন, তা সব আপনি পাঠ করেন। তাঁর বিষয়, শৈলী বা কবিতায় চিন্তা আপনার জন্য শিক্ষণীয়। এখনো তাঁর সম্পর্কে মন্তব্যটি বহাল রেখেছেন?

মাহমুদ: ঠিকই আছে, ঠিকই বলেছি।

মামুন: সত্যি কথা বললেন তো?

মাহমুদ: হুঁ...।

মামুন: শামসুর রাহমান লিখেছেন প্রায় ৬০ বছর। তাঁর প্রভাব এখনো সক্রিয়। আপনি আগের মতো তাঁর লেখা পড়েন?

 মাহমুদ: গুছিয়ে বলা মুশকিল। কী করে বলব। তরুণেরা শামসুর রাহমান এখন পাঠ করে না। আমি নিজেই করি না।

মামুন: কী কারণে আপনি এখন পড়েন না?

মাহমুদ: নতুন কিছু পাই না শামসুর রাহমানের কবিতায়। তিনি একই কথা বারে বারে বলছেন। বহু আগে তাঁর কবিতা নিয়ে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে সময় প্রশংসা করেছি। এমন গদ্য তাঁর বন্ধুরাও লেখেননি। আমি বিশ্বাস থেকে লিখেছি। তিনি কোনো দিন আমার লেখা নিয়ে মন্তব্য করেছেন শুনিনি। আমি পরিশ্রম করে একা এই পর্যন্ত এসেছি।

মামুন: শামসুর রাহমান মারা যাওয়ার পর আপনি নাকি বলছিলেন, ‘কোথায় শামসুর রাহমান!’

মাহমুদ: সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। এগুলো তোমাদের বানানো। তাঁকে আমি অগ্রজ হিসেবে শ্রদ্ধা করি।

মামুন: আপনার সম্পর্কে শহীদ কাদরীর ভাষ্য, টায়ার কাটা স্যান্ডেল, গোলাপ ফুল আঁকা টিনের বাক্স নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন আপনি—এমনই তো জানি আমরা।

মাহমুদ: সে আমাকে ঠাট্টা করত এবং বলত। সেই বাক্সের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সারা বাংলাদেশ ছিল। শহীদ এখন ঢাকায় থাকলে আমি দেখা করতাম। সে তো কবি।

মামুন: আপনার ছোটগল্প, কথাসাহিত্য ও আত্মজৈবনিক উপন্যাস যেভাবে বেড়ে উঠির বিষয় ও ভাষাশৈলী নিয়ে প্রশংসা করেন অনেকে। কিন্তু দিনযাপন নামে শিল্পতরু থেকে একটি স্কেচধর্মী বই বেরিয়েছিল আপনার। বইটির বিষয় পরিকল্পনা, চিত্রকল্প, ভাষা প্রকৌশল মৌলিক ও অসাধারণ। এ ধরনের কাজ আর অব্যাহত রাখলেন না কেন?

মাহমুদ: আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই। কেউ কেউ এসে ইদানীং আমায় বলে, ভারত উপমহাদেশে আপনি এখন সব ভাষায় জীবিত কবিদের মধ্যে সবার ওপরে।

মামুন: শুনে বেশ খুশি হন?

মাহমুদ: বিশ্বাস করো, হই না। মনে হয় আমাকে উসকে দেওয়ার জন্য এগুলো বলে। আমি কোনো মন্তব্য করি না। কিছু বলি না।

মামুন: কারা বলে?

মাহমুদ: তোমাদের মতো আমার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে! আমার পাঠকেরা আমার সঙ্গে আছে—এইটুকু জানি, ব্যস।

মামুন: মৌলবাদী লেখক হিসেবে আপনার পরিচিতি থাকলেও এখন আপনার লেখার বড় অংশ প্রকাশিত হয় মূলত সেক্যুলার পত্রপত্রিকায়। আপনার কি মনে হয়, আদর্শের চেয়ে শিল্পকলাকে এখানকার পত্রপত্রিকাগুলো বেশি গুরুত্ব দেয়?

কবিকে দেখছেন কবি—শামসুর রাহমানের দিকে তাকিয়ে আছেন আল মাহমুদ, ১৪ জুন ২০১৬। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

মাহমুদ: শিল্পকলাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আমি তো কোনো মৌলবাদী কাগজে লিখি না। বড় বড় নিরপেক্ষ কাগজ আমার লেখা এখনো প্রত্যাশা করে। আমি নিয়মিত লেখা দিতে পারি না। তারা বিশেষভাবে ছাপে আমার লেখা। সম্ভবত আমার কবিতা না পেলে অনেক সম্পাদকের মন খারাপ হয়ে যায়। ধর্মবিশ্বাসের আদর্শ ও শিল্পকলাকে এক করা ঠিক নয়। এই পার্থক্যটা অনেকে বুঝতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাসকে সামনে টেনে এনে আমার সবকিছুকে যারা প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করতে চায়, খোঁজ নিয়ে দেখো তারা কারা। তাদের পরিচয় কী! আমি তো কাউকে ব্যারিকেড দিয়ে রাখতে চাই না। লেখা ছাড়া আর তো কিছু করি না। শুনেছি ঢাকায় এসে কলকাতার কেউ কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু তাদের যারা নিয়ে আসে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে তারা ওই অতিথিদের আমার কাছে আসতে দেয় না।

মামুন: ওপার বাংলায় আপনার আদর্শ এবং লেখা নিয়ে লেখক-সাহিত্যিকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানেন কিছু?

মাহমুদ: কলকাতায় গেলে আমাকে পরিচিত ও অপরিচিতজনেরা ঘিরে থাকে। তারা আমাকে পাঠ করে। তোমার জানা উচিত, ওখানকার বড় পত্রিকাগুলো আমার লেখা যেকোনো সময় ছাপাতে আগ্রহী। সেখানে আমার কবিতার অনেক পাঠক আছে। বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে তারা আমার বই পড়ার জন্য নিয়ে যায়। শিবনারায়ণ রায় শুধু নন, আরও কজন আমার লেখার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। কলকাতায় তো আমাকে কেউ মৌলবাদী বলে না!

মামুন: আপনার আদর্শ কি শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ততাকে বাধাগ্রস্ত করে?

মাহমুদ: সেটা কী করে বলব। আমার তো মনে হয় এটা কোনো বাধা হতে পারে না।

মামুন: অতিকট্টর ইসলামপন্থীরা পাইকারি হারে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেন এবং যেনতেন ছুতোয় তাঁর লেখা বাতিল করতে চান। অথচ তাঁর শিল্পের সার্থকতা ঈর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ কিংবা খ্যাতিনামা হিন্দু লেখকদের ঢালাওভাবে বাতিল করে দেওয়া কি ভালো হবে?

মাহমুদ: না, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি অনেক বড় লেখক। যারা করে, তারা বোকামি করে। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ।

মামুন: সৃষ্টিশীল সাহিত্য পাঠ করতে এখনকার তরুণেরা আর পাঠাগারে যান না। ইন্টারনেট আর ফেসবুকে তাঁদের বিচরণ। বই বা মুদ্রণশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি আতঙ্কিত?

মাহমুদ: না, আতঙ্কিত না। যারা সাহিত্যকে ভালোবাসে, তারা ঘুরেফিরে সাহিত্যের কাছেই ফিরে আসবে। আমার মনে হয়, যতই পাঠাগারবিমুখ হোক, সাহিত্য তার আপন মহিমায় বেঁচে থাকবে। ইন্টারনেট সৃষ্টিশীল সাহিত্যকে গ্রাস করতে পারবে না।

মামুন: প্রথম জীবনে আপনি ছিলেন বামপন্থী। রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনের বই বা রুশ সাহিত্য সম্পর্কে আপনার কোনো নস্টালজিয়া কাজ করে?

মাহমুদ: একসময় প্রচুর পড়েছি রুশ সাহিত্য। মনে পড়ে সেই সব। এখন ওই বইগুলো পাই না।

মামুন: আপনার প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই কেবল সোনালি কাবিন-এর কথা বলে। এরপরে কি আপনার কোনো বড় কাজ নেই?

মাহমুদ: আমি এই সোনালি কাবিন-এর পর শব্দটি বিশ্বাস করি না। সোনালি কাবিন মুগ্ধতার জায়গায় আছে। তার পর অনেক লিখেছি। তার পরের সাহিত্য ব্যর্থ হয়েছে—আমি মনে করি না।

মামুন: বাংলাদেশের সাহিত্যের বড় কাজগুলো গত শতকের পঞ্চাশ বা ষাটের লেখকদের হাতের দান। এর পরবর্তীদের কাছ থেকে কি আমরা বড় মাপের সাহিত্য পেলাম, কী মনে হয় আপনার?

মাহমুদ: ছোট বা বড় মাপের সাহিত্যিক—এভাবে বলা ঠিক না। সাহিত্যের একটা আকর্ষণ থাকতে হবে তো। সময় ও যুগের দাবি থাকতে হবে। আমাদের রচনায় যুগের চাহিদা ছিল। পরেও কিছু ভালো লেখা আছে। এটা ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

মামুন: কী লিখতে ইচ্ছে হয় এই মুহূর্তে?

মাহমুদ: কাব্যনাটক। আয়ু ফুরিয়ে যাচ্ছে—বুঝতে পারছি না। আমি চেষ্টা করেছি কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে অমর হয়ে থাকতে। কিন্তু প্রত্যাশার সবটুকু করা যায়নি।

মামুন: বইমেলা বা ঈদসংখ্যার প্রকাশনা দেখলে বোঝা যায়, আমাদের সাহিত্য পরিমাণের দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু মানের জায়গাটা কেমন?

মাহমুদ: মানের দিকটা ভালোই। আমাদের লেখালেখির একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। আমাদের আর কলকাতার বাংলা ভাষা এক নয়। আমাদের ভাষার বৈচিত্র্য ওদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আঞ্চলিক ভাষা, আদিবাসী ভাষা বা মানুষের কথ্যভাষায় সাহিত্য রচিত হচ্ছে। প্রমিত ভাষার বাইরেও আজকাল লেখালেখি শুরু হয়েছে শুনেছি। এগুলো আমাদের বাংলা ভাষাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করছে। ওদের ভাষা মরা ভাষা। আজকাল আমাদের বই কলকাতায় চলে যাচ্ছে। ওদের পাঠকেরা বাধা মানছে না। বাংলাদেশের বই পড়তে ওখানকার তরুণ পাঠকেরা ব্যাকুল। আমাদের ভাষাই আধুনিক বাংলা ভাষা।

মামুন: সাধারণত উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর আমাদের মেধাবীরা এখনো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারই হতে চায়। কেউই আল মাহমুদ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হতে চায় না। ব্যর্থতা কাদের, আপনাদের না তরুণদের?

মাহমুদ: কী বলব বলো।

মামুন: আপনারা কি তরুণদের কাছে ‘আইকন’ হিসেবে পৌঁছাতে ব্যর্থ তাহলে?

মাহমুদ: তা-ই তো মনে হয়।

মামুন: তাহলে ৬০-৬৫ বছর কী করলেন, কাদের জন্য লিখলেন?

মাহমুদ: লিখলাম তো তরুণদের জন্য। কিছু করার নেই।

মামুন: প্রযুক্তির দাপটে বই কি শেষ পর্যন্ত জাদুঘরে গিয়ে লুকাবে, নাকি কিছু মানুষের আত্মার আসবাব হয়ে অটুট সৌন্দর্য ছড়াবে?

মাহমুদ: বই ধ্বংস হবে না কোনো দিন। কিছু মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে বই বেঁচে থাকবে। আমার তো মনে হয় না বই জাদুঘরে যাবে।

মামুন: বই যদি না থাকে, তাহলে মানুষের মনুষ্যত্বের কোনো আত্মিক বিপর্যয় ঘটবে কি না?

মাহমুদ: এটা সময়ই বলে দেবে। তবে বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না

মামুন: আমাদের এখানকার অনেক সাহিত্যিক একে-অন্যের লেখাজোকা নিয়ে কেমন যেন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখান। ফলে ভালো লেখা সম্পর্কে অন্য লেখকের অনুভব অজানা থেকে যায়। এটা আমাদের সাহিত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না?

মাহমুদ: করে তো। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না আমরা। সবাই যে যার মতো বিচ্ছিন্ন। সমকালে একজন লেখক জানতে চান, অন্যরা তাঁর লেখা নিয়ে কী বলে। যখন অপেক্ষা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া তিনি পান না, তখন ওই লেখক অন্যদের প্রতি হয় প্রতিক্রিয়াশীল হন অথবা বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। প্রাণবন্ত সাহিত্য-সভ্যতার জন্য এ ধরনের প্রবণতা দারুণ ক্ষতিকর। আমি অনেককে নিয়ে কলম ধরেছি। প্রবন্ধ লিখেছি আমার সমসাময়িক এবং তরুণদের নিয়ে। না লিখলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

মামুন: দাদা-দাদি, নানা-নানির কিস্‌সা, জসীম উদ্‌দীনের ধুলোমাটি আর আঞ্চলিক শব্দসম্ভারের সূক্ষ্ম রসায়নে একেবারে প্রথম থেকে একটি আলাদা মেজাজের কাব্যভাষা আপনি তৈরি করলেন। কবির এই কাব্যভাষা কি দৈবের কাজ, নাকি চেষ্টার ফসল?

মাহমুদ: দৈবের কাজ তো নয়ই। পরিশ্রম, প্রচুর পরিশ্রমের ফসল। সচেতনভাবে আমার কাব্যভাষা আলাদা। আর দীর্ঘকাল সাধনা করলে এমনিও হয়। আমাকে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি লেখায় নতুনত্ব আনতে সময় দিতে হয়েছে। অনেক খেটেছি আমি।

মামুন: মৃত্যু আপনার মধ্যে বেদনা তৈরি করে কি?

মাহমুদ: মৃত্যুচিন্তা আছে আমার। তবে মৃত্যুকে সমাপ্তি মনে করি না। মৃত্যুর ওপারে আরেকটা জীবন আছে—এটা বিশ্বাস করি। কিন্তু মৃত্যু আমার মধ্যে বেদনা তৈরি করে। কারণ, মৃত্যু মানে বিচ্ছেদ, চূড়ান্ত বিচ্ছেদ।

কবির মগবাজারে বাসায় এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে এ বছরের ১৪, ১৬ ও ২৫জুন।