পোশাকি নাম আশালতা সেনগুপ্ত। ডাকনাম দোলোনা। বড়রা আরও সংক্ষেপ করে ডাকেন দুলি। কিন্তু সমাজে তাঁর প্রধান—ভুল বললাম—তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি নজরুল ইসলামের স্ত্রী—প্রমীলা। নিশ্চয় হাসতে জানতেন তিনি, হাসতেনও; কিন্তু তাঁর যে কটি ছবি দেখা যায়, তার কোনোটিতে তাঁর মুখে হাসি তো দূরের কথা, হাসির রেখা পর্যন্ত দেখা যায় না। ছবি তোলার মুহূর্তে অনেকে আড়ষ্ট হয়ে যান। হয়তো তিনিও তা-ই হতেন। তবে তাঁর ছবির সঙ্গে তাঁর জীবনেরও একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে। ছবির বিষণ্ন প্রমীলা, আজন্ম আমৃত্যু দুখিনী।
তিনি তাঁর পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। তাঁর কোনো সৎভাইবোন ছিল কি না, জানা যায় না। কিন্তু তাঁর মায়ের তিনি ছিলেন একমাত্র সন্তান। পিতাকে তিনি হারান তাঁর বাল্যকালে। কাকার সংসারে আশ্রয় পেয়ে সেই সংসারেই বড় হচ্ছিলেন। লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। বড় হয়ে কয়েকটা কবিতা লিখেছিলেন এবং সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। তা ছাড়া কুমিল্লায় যখন রাজনৈতিক মিছিল বেরিয়েছে, তখন কিশোরী দুলি তাতেও অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়।
সেই সময় এক চৈত্র মাসের শেষে কান্দিরপাড়ের সেই শান্ত সংসারে অকাল-বৈশাখীর মতো আবির্ভাব নুরুদার—নজরুল ইসলামের। মাত্র কদিনের জন্য এসেছিলেন। সেই কদিন বাড়ির হাওয়ায় ঝড় তুলে তিনি আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেলেন দৌলতপুর নামে এক গ্রামে। সেখান থেকে মাস দেড়েক পরই খবর এল, নুরুদার বিয়ে। ‘কী মজা’ বলে দুলি তখন হাততালি দিয়েছিলেন কি না, জানা যায় না। কিন্তু বাড়ির অন্যদের সঙ্গে তিনি বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন ৩ আষাঢ় (১৩২৮)। দুঃখের বিষয়, সেই রাতেই বিয়েটা হতে হতে ভেঙে গেল। তার পরই নুরুদা আর রাঙাদা (প্রমীলার কাকাতো ভাই বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত) আষাঢ়ের সেই জোছনারাতে কান্দিরপাড়ে চলে যান। পরের দিন দুলিও ফিরে আসেন।
এই দুর্ঘটনার প্রচণ্ড আঘাতে নুরুদা মুষড়ে পড়েন। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক পর কলকাতা থেকে আসা এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। তবে মাস তিনেক পর, অক্টোবর মাসে, তিনি আবার কান্দিরপাড়ে বেড়াতে আসেন। সেবারে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ ছিলেন। তারপর তিনি আবার দুলিদের বাড়িতে আসেন পরের বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে (১৯২২)। তখনো দুলির বয়স চৌদ্দ হতে কয়েক মাস বাকি। তাঁর জন্ম ১৩১৫ সালের ২৭ বৈশাখ (৮ মে ১৯০৮)। সেই কিশোরীর চোখে চোখ রাখলেন নুরুদা। তিনি একদিন তাঁকে একটা কবিতা উপহার দিলেন, যার প্রথম পঙ্ক্তিতেই আছে—‘হে মোর রানী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।’ এ কথার মানে দুলি বোঝেন, আবার বোঝেন না। এ কি তাঁকেই বলা? সেবার এসে নজরুল কান্দিরপাড়ে ছিলেন প্রায় চার মাস। শেষ দিকে তাই নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা কুৎসা রটাতে আরম্ভ করেন, তাঁকে অপমান করতে উদ্যত হন। ওদিকে কলকাতা থেকেও কাজের ডাক আসে। তাই মে মাসের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যান চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর সমগ্র হৃদয়। কৈশোরের অবুঝ ভালোবাসা—‘টিনএজ ক্রাশ’ আর কি!
তারপর নভেম্বর মাসে (১৯২২) তাঁদের আবার দেখা—বিহারের সমস্তিপুরে, দুলির মামার বাড়িতে। নজরুলের কাছ থেকে শুনলেন, তাঁর পেছনে পুলিশ লেগেছে। দুলির হৃদয় আশঙ্কায় দুলে ওঠে। নজরুল তাঁদের সমস্তিপুর থেকে কান্দিরপাড়ে পৌঁছে দিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় কী একটা কথা লেখার অভিযোগে নুরুদা গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। মামলা হলো, মামলায় তাঁর সাজা হলো এক বছরের। জেল থেকে ছাড়া পান পরের বছর (১৯২৩) ১৫ ডিসেম্বর। তার তিন-চার দিনের মধ্যেই বিরহিণী দুলির সঙ্গে মিলন হলো নজরুলের। কিন্তু কদিন পরই নজরুলের আরেকটা মামলা ছিল। তাই কান্দিরপাড়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব হলো না। তা ছাড়া কুৎসার ভয়ও ছিল। তাই দুলি আর তাঁর মাকে সমস্তিপুরে পৌঁছে দিয়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান। এদিকে দুলি গভীর আগ্রহ নিয়ে নজরুলের প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেই প্রতীক্ষা শেষে তাঁদের বিয়ে হয় ২৫ এপ্রিল (১৯২৪)। এবারও সমস্তিপুর থেকে দুলি আর তাঁর মাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নজরুল। বিদ্রোহী কবি দুলির নাম দিলেন মহাকাব্যের এক বীরনারীর নামানুসারে—প্রমীলা।
বিয়ের আগে প্রমীলাকে পার হতে হয়েছিল দুস্তর সমুদ্র। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে, যে পরিবারের আশ্রয়ে তিনি বড় হচ্ছিলেন, যে পরিবারের লোকেরা ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন। তা ছাড়া প্রবল বাধা এসেছিল সমাজের তরফ থেকে। কারণ, হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হয় না। তখনকার একাধিক রাজনীতিক এ বিয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করে মুসলমান-অধ্যুষিত সড়কের এক বাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে হতে আইনের বাধাও কম ছিল না। বাধা থাকত না যদি প্রমীলা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতেন অথবা তাঁর বয়স অন্তত আঠারো হতো। কিন্তু তাঁর বয়স ছিল ষোলো বছরেরও সপ্তাহ দুয়েক কম। তিনি মুসলমান হতে চাননি, নাকি তাঁর মা গিরিবালা দেবী তা চাননি, নাকি নজরুলই তা চাননি—জানা যায় না। কিন্তু আইনের বাধাকে গোঁজামিল দিয়ে অতিক্রম করেন নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের বিয়ে হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। নজরুলের বেশির ভাগ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু। কিন্তু বিয়েতে তাঁদের একজনও উপস্থিত ছিলেন না।
বিয়েতে ধুমধাম করার মতো টাকাপয়সা নজরুলের ছিল না। বিয়ে হয়েছিল মাসুদা রহমান নামের এক বিশিষ্ট নারীর সার্বিক আনুকূল্যে। বিয়ের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ-উৎসবও বলতে গেলে কিছুমাত্র ছিল না। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দেয় বিয়ের পর। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বিখ্যাত হলে কী হবে—মুসলমান নামধারী নজরুলের পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব হলো। আর প্রমীলা ও গিরিবালা দেবী পড়লেন নিজেদের স্বরূপের সংকটে। তাঁরা না মেশার সুযোগ পাচ্ছিলেন হিন্দু পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে, না পারছিলেন মুসলমানদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে মিশতে। সংসারের মধ্যে থেকেই তাঁরা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এই নিঃসঙ্গতা আংশিকভাবে তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারতেন নজরুল যদি ঘরমুখী হতেন। কিন্তু তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ঘরের বাইরে। তাঁর জগৎটা ছিল সংসার থেকে অনেক দূরে—বন্ধুদের মধ্যে। তাঁর সময় কাটত আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে, হইচই করে। তাঁর ধারণা ছিল ‘বেলা যাবে এবে (গান গেয়ে আর) পান খেয়ে।’ স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার মতো অফুরন্ত সময় কোথায় তাঁর?
বিয়ে হওয়ায় প্রমীলা কতটা আনন্দিত হয়েছিলেন অথবা সুখী হয়েছিলেন, সেটা অনুমানসাপেক্ষ। তবে স্বস্তি লাভ করেছিলেন নিঃসন্দেহে। বিয়ের সতেরো সপ্তাহ পর প্রমীলার পুত্রসন্তান হলো জন্মাষ্টমীর দিন—২২ আগস্ট। সে কথা মনে রেখে নজরুল তার নাম দিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। পরে আরও একটা নাম দিয়েছিলেন তাকে। আকিকা করেছিলেন সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব নিয়ে—যদ্দুর সম্ভব হইচই করে। সেই সন্তান মারা যায় প্রায় চার মাস বয়সে। দুবছর পর তাঁদের আরেকটি সন্তান মারা যায় আকস্মিকভাবে। প্রতিটি ঘটনাই প্রমীলাকে মর্মাঘাত দিয়েছিল। নজরুলের বাইরের জগৎ ছিল, কল্পনার জগৎ ছিল, কবিতা-গানের জগৎ ছিল। প্রমীলার অন্তর্লোক থাকলেও বাইরের জগৎ ছিল না, সামাজিক জগৎও ছিল না।
সন্তান জন্মের পর দরিদ্র সংসারের খরচ আরও বেড়ে গিয়েছিল। যখনকার কথা বলছি (১৯২৪-২৭), তখন নজরুলের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল তাঁর কবিতা। সে আয় সচ্ছলভাবে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। এমনকি সে আয় নিয়মিতও ছিল না। সেই অপ্রতুল আয় দিয়েই নিজেদের খাওয়াদাওয়া, আহূত-অনাহূত যখন তখন আসা অতিথিদের আপ্যায়ন, কাপড়চোপড় ইত্যাদির ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর অসাধ্য সাধন করতে হতো। কান্দিরপাড়ে যে সংসারে তিনি মানুষ হচ্ছিলেন, সে সংসারে আর যা-ই হোক, এমন দুঃসহ অভাব ছিল না। নিজের সংসারে প্রমীলাকে এবং গিরিবালা দেবীকে যে কখনো কখনো অনশনে কাটাতে হয়েছে, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন নজরুলের সবচেয়ে দরদি বন্ধুদের একজন—মুজফ্ফর আহমদ। এ রকম একবার যখন প্রমীলা এবং তাঁর মায়ের অনশন-অর্ধানশন চলছে, তখন জরুরি বার্তা পেয়ে আবদুল হালিম কৃষ্ণনগরে গিয়ে তাঁদের চাল-ডাল কিনে দিয়ে এসেছিলেন। নজরুল সে সময় ঢাকায় গান শেখানোর ‘কাজে’ মশগুল ছিলেন।
কেবল ঢাকায় নয়, কলকাতায়ও একই অবস্থা। কলকাতার বাইরে—চুঁচুড়ায়ও তাই। গান শেখাতে গেলে সেখানেই আহার, সেখানেই নিদ্রা। এদিকে স্বামী হঠাৎ লাপাত্তা হওয়ায় প্রমীলার যে কত বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছে, কোনো জীবনীগ্রন্থে তার হদিস মেলে না। স্বামী খেলার মাঠে গেলেন ফুটবল খেলা দেখতে, কিন্তু খেলা শেষে চলে গেলেন কলকাতা থেকে ঢাকায়—এ দিয়ে নজরুলের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝানো যায় বটে, কিন্তু এই উচ্ছৃঙ্খলতা এবং দায়িত্ববোধের ঘাটতি তাঁর স্ত্রীর জন্য কত উদ্বেগ এবং অশান্তির কারণ হতে পারে, তার পরিমাপ করা যায় না। মা গিরিবালা দেবী সঙ্গে না থাকলে প্রমীলা একা কী করে বাস করতেন, তা চিন্তা করলে উত্তর মেলে না।
ওদিকে এক মুসলমান ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় গিরিবালা দেবীর কোথাও যাবার উপায় ছিল না। এমনকি ভাইয়ের বাড়ি সমস্তিপুরেও নয়। তিনি মেয়ের পরিবারে বাস করায় প্রমীলা খানিকটা রক্ষা পেয়েছিলেন দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন স্বামীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণের হাত থেকে। মা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন। অপরপক্ষে এটা অনুমান করা অসংগত হবে না যে, মা সঙ্গে থাকায় কমবয়সী প্রমীলা অনেক সময়ই মায়ের বুদ্ধিতে কাজ করেছেন। ফলে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক যতটা প্রত্যক্ষ এবং নিবিড় হতে পারত, ততটা হতে পারেনি। একে অন্যকে বুঝতে পারার যে সম্পর্ক তৈরি হতে পারত, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে তা-ও হতে পারেনি।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। একদিন প্রতিভা সোম (পরে প্রতিভা বসু) এবং তাঁর মা নজরুলের সঙ্গে নজরুলের বাসায় গিয়েছিলেন। নজরুল যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে যে ঘরে প্রমীলা ছিলেন সেই ঘরে যেতে উদ্যত হন, তখন গিরিবালা দেবী অন্য ঘর থেকে এসে দৃঢ় কণ্ঠে নজরুলকে বলেন, ‘খবরদার নুরু, ওই ঘরে তুমি যাবে না। দুলির অসুখ।’ এ হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। এর ফলে দুই অতিথির সামনে নজরুলের যে অপমান হয়েছিল, তা সমগ্র পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্ককেই প্রবলভাবে নাড়া দেবার কথা। বিশেষ করে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের। বস্তুত, মা সঙ্গে থাকায় প্রমীলা স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিণতি লাভ করতে পারেননি।
জীবন ধারণের স্বল্পতম উপকরণের অভাব, স্বামীর কাছ থেকে যথেষ্ট সঙ্গ না পাওয়া, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব না থাকা এবং সর্বোপরি স্বামীর একনিষ্ঠতা এবং আনুগত্যের অভাবে প্রমীলা খুব সুখী হয়েছিলেন বলে মনে করা শক্ত। একেবারে প্রথম দিক ছাড়া স্বামীর ভালোবাসা তিনি কতটুকু পেয়েছিলেন, তাতেও সন্দেহ হয়। নজরুল ছিলেন প্রেমের কবি। অসংখ্য নারীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তাঁদের অনেককে তাঁর ভালো লেগেছিল। ভালোও বেসেছিলেন কাউকে কাউকে এবং তাঁদের নিয়ে অসংখ্য প্রেমের কবিতা এবং গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু দুলিকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখলেও, প্রমীলাকে নিয়ে প্রেমের গান অথবা কবিতা লিখেছিলেন বলে মনে করা কঠিন। তাঁর সুস্থ থাকাকালে প্রকাশিত প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে কোনো গ্রন্থও উৎসর্গ করেননি তাঁর নামে—যদিও বিশেষ নারীকে সরাসরি উৎসর্গ করতে না পেরে সে নারীর পিতার নামে অথবা কোনো নারীর নামে উৎসর্গ করতে না পেরে রবীন্দ্রনাথের নামেও গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। (দোলনচাঁপা বইটির নামের মধ্যে অবশ্য দুলির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।)
দৌলতপুরে বিয়ে ভেঙে যাবার পর কান্দিরপাড় থেকে নজরুলকে কলকাতায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন মুজফ্ফর আহমদ। তখন (জুলাই ১৯২১) তিনি প্রমীলাকে দেখেছিলেন। দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, দুলি এক হাসিখুশি চঞ্চল কিশোরী। সেই কিশোরীকেই প্রমীলা নজরুল হিসেবে তিনি দ্বিতীয়বার দেখেন ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রমীলার বয়স তখনো আঠারো হয়নি। কিন্তু মুজফ্ফর আহমদ অন্য এক মেয়েকে দেখতে পান প্রমীলার মধ্যে। বয়সের তুলনায় একটু বেশি ‘ধীর, স্থির এবং শান্ত।’ তাঁর সেই হাসি মুছে যাওয়া মুখের ছবিই আমরা দেখতে পাই তাঁর বিভিন্ন আলোকচিত্রে।
যদি আর্থিক অভাবজনিত কষ্টের দরুন প্রমীলা অসুখী হতেন, তাহলে ১৯২৯-৩০ সাল থেকে তাঁর সুখী হবার কথা ছিল। কারণ, এ সময় গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান লেখা, তাতে সুর দেওয়া এবং সে সুর গায়ক-গায়িকাদের শেখানো বাবদ নজরুল অনেক টাকা পেতেন। বেতারের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ঘটেছিল। এমনকি মঞ্চের সঙ্গেও। এতটাই সচ্ছল হয়েছিলেন যে, তিনি একটা বড় গাড়িও কিনেছিলেন ১৯৩১ সালে। গাড়ি কেনার জন্য অবশ্য অগ্নিবীণার গ্রন্থস্বত্বও বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯২৬-২৭ সালের আর্থিক অনটনের কথাকে তখন প্রমীলা এবং গিরিবালা দেবী হয়তো কেবল দুঃস্বপ্ন বলেই বিবেচনা করতেন। কিন্তু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যই সুখ আনতে পারে না। ওদিকে নজরুল গান-বাজনা আর গানের নরনারীদের নিয়েই মত্ত থাকলেন। পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল না। উচ্ছৃঙ্খল জীবনে শৃঙ্খলা এল না একটুও।
তদুপরি ১৯৩০ সালের ৭ মে তিন বছর আট মাস বয়সে বসন্ত রোগে ভুগে নজরুল এবং প্রমীলার—যাকে বলে—নয়নমণি—বড় পুত্র বুলবুল মারা যায়। সেদিন অথবা তার আগের দিন ছিল প্রমীলার জন্মদিন। পুত্রশোকে নজরুল যে কষ্ট পেয়েছিলেন, তা তিনি কোনো দিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গানে গানে তিনি সেই শোকের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রমীলা কী মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলেন, আমরা তা জানতে পারিনি। কারণ, স্বামীর মতো তিনি গান অথবা কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁর শোকের কথা ব্যক্ত করে মনকে লঘু করতে পারেননি। বিভিন্ন জনের লেখা থেকে মনে হয়, বুলবুলের ছিল অসাধারণ প্রতিভা। তিন বছর বয়সে নজরুল হারমোনিয়ামে কোনো সুর বাজালে সে বলে দিতে পারত সুরটা কোন রাগরাগিণীর। জীবজন্তুর নাম ইংরেজিতে বলে দিতে পারত ছবি দেখলে। উপরন্তু, স্নেহ কেড়ে নেওয়ার মতো ব্যবহার ছিল তার। প্রতিভা সোম যেদিন নজরুলের সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন, সেদিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বুলবুল দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘এই যে কাজীদা, কোথায় ছিলে?’ নজরুল তাকে বুকের মধ্যে ধরে হেসে বলেন, ‘আবার কাজীদা বলেছিস!’ এ রকম সহস্রÊস্মৃতি প্রমীলা এবং নজরুলকে তিলে তিলে দংশন করছিল।
কিন্তু প্রমীলার সবচেয়ে বড় বিপদ ঘনায় ১৯৩০-এর দশকে কবির বেহিসাবী বিলাসিতা এবং অপব্যয় থেকে। যে নজরুল কয়েক হাজার গান লিখে হাজার হাজার টাকা আয় করেছিলেন, ১৯৪০ সাল আসার আগেই তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। তার চেয়েও বড় বিপদ প্রমীলার দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা—যার পরিণতিতে তিনি তাঁর নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। মা তখন তাঁর একমাত্র সহায় হয়েছিলেন। স্বামীও তাঁকে রোগমুক্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন—প্রথমে চিকিৎসা, তারপর টোটকা চিকিৎসা এবং সবশেষে যোগ, পুজো ও নামাজের আশ্রয় নিয়ে। তবু প্রমীলা আরোগ্যলাভ করেননি। কিন্তু প্রমীলার দুর্ভাগ্যের তখনো শেষ হয়নি। সেটা হলো স্বামী যখন ১৯৪২ সালের গোড়া থেকেই রোগাক্রান্ত হলেন। সেই রোগ জুলাই মাসে নজরুলকে অপ্রকৃতিস্থ এবং উন্মাদে পরিণত করে। ক্রমে তিনি বাক্রুদ্ধ হন। সে সময় প্রথম চার বছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রমীলাকে এবং সংবিৎহারা নজরুলকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন গিরিবালা দেবী। তারপর কী দুঃসহ পরিবেশে প্রমীলা তাঁর স্বামী এবং দুই কিশোর পুত্রকে নিয়ে বেঁচে ছিলেন, তা বর্ণনাতীত।
এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। তারপর দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মারা যান। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর কবরের পাশে জায়গা রাখা হয় স্বামীর জন্য। প্রমীলা প্রতীক্ষা করে থাকেন, মৃত্যুর পরও তিনি থাকবেন স্বামীর পাশে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! তাঁর মৃত্যুর পরও বাংলাদেশের এক ফৌজি একনায়ক প্রমীলার স্বামী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় চিরদিনের জন্য আটকে রাখেন, আটকে রাখেন চিরতরে। প্রমীলার প্রতীক্ষা পরিণত হয় অনন্ত প্রতীক্ষায়।
ghulammurshid@aol. com