পৃথিবী উদ্ভ্রান্ত, পৃথিবী ভয়ানক

>এবার একসঙ্গে ঘোষিত হয়েছে সাহিত্যের দুই বছরের নোবেল পুরস্কার। ২০১৮ ও ’১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন যথাক্রমে পোল্যান্ডের লেখক ওলগা তোকারচুক ও অস্ট্রিয়ার কথাসাহিত্যিক পিটার হান্ডকে। তাঁদের লেখালেখির পৃথিবী এবং তাঁদের লেখা গল্প নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ আয়োজন।

প্রথম আলোর সঙ্গে কথাই ছিল এমন যে এবারের নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের লেখা যদি আমার আগে পড়া থাকে, তবেই কেবল তাঁকে নিয়ে লিখব, না পড়ে গুগল ঘেঁটে কিছু লিখব না। ঠিক যে কারণে লিখিনি সভেৎলানা আলেক্সিয়েভিচ বা বব ডিলানকে নিয়ে, আর যে কারণে লিখতে বসেছি পিটার হান্ডকে এবং ওলগা তোকারচুককে নিয়ে। পিটার হান্ডকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঔপন্যাসিক ডব্লিউ জি সেবাল্ডকে ভালোবাসার পথ ধরে, এ শতকের শুরুর দিকে। 

এবারের দুই নোবেলজয়ীর সঙ্গেই সেবাল্ডের নাম আসছে বারবার—হান্ডকের সবচেয়ে ভালো সমালোচকদের একজন সেবাল্ড, আর সেবাল্ডের ওপরে কাফকা ও মার্সেল প্রুস্তের পর হান্ডকের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি; এবং ওলগা তোকারচুকের লেখায় সেবাল্ডেরই গাঢ় গন্ধ।

তোকারচুকের নাম জেনেছি বলতে গেলে এই সেদিন, যখন তিনি ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার জিতলেন তাঁর ফ্লাইটস উপন্যাসের জন্য। তাঁর লেখায় আমি যতটা না পেয়েছি সেবাল্ডকে, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতালো কালভিনোর ইনভিজিবল সিটিজ আর বোর্হেসের ড্রিমটাইগারস-এর অনুগল্পকে। তবে সেবাল্ডও ভালোই আছে ওতে। সেবাল্ডের রিংস অব স্যাটার্ন উপন্যাস শুরু হয় স্যার টমাস ব্রাউনের মাথার খুলি এবং এক ফাঁসিতে ঝোলা চোরের মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ করা নিয়ে দুটি সত্য কাহিনির বিবরণ দিয়ে। ওলগা তোকারচুকের ফ্লাইটস-এর ১১৬টি বিচ্ছিন্ন, পারস্পরিক সম্পর্কহীন, মূলত ভ্রমণে থাকা মানুষের ছোটাছুটি–সম্পর্কিত অনুগল্পগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাঁর সেই একই সেবাল্ডিয়ান বিষণ্নতাকে সঙ্গী করে স্মৃতির বিভিন্ন স্তরে নেমে গিয়ে মৃত মানবশরীর বিষয়ে লেখা ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যানগুলোকে। 

২০১৮ সালের নোবেলজয়ী ওলগা তোকারচুক এবং ২০১৯–এর নোবেলজয়ী পিটার হান্ডকে: দুজনের লেখাতেই আছে এক অস্থির পৃথিবীর বিবরণ। ছবি: সংগৃহীত

জীবিত মানুষের ঘোরাঘুরির যে তাড়না, যে স্বাধীনতা, তার পুরো বিপরীতে আছে শরীরের নশ্বরতার ব্যাপারটি, তা যতই মৃত্যুর পর নানা কেমিক্যাল দিয়ে প্রসেসিং, মমিকরণ ইত্যাদি করা হোক না কেন। 

সতেরো শতকের বেলজিয়ান সার্জন ফিলিপ ফেরহেয়েনের গল্প শুরু হলো এবার, গল্পটা বলছেন ফিলিপের এক ছাত্র। ফিলিপ ছিলেন এক চাষির ছেলে। তাঁর সেই ছাত্র বলছে: ‘ঐশ্বরিক খোদাইশিল্পীরা আমাদের জীবনের অন্য পাশটাতে যে নিয়তির কথা খোদাই করে রেখেছেন, আমি নিশ্চিত তা আমাদের চেনা বা জানার বাইরে। কেবল তখনই মানুষ ওই নিয়তিকে চিনতে পারবে, যখন তা দেখতে হবে মানুষের চিনবার মতো সাদাকালো। খোদা লেখেন তাঁর বাম হাত দিয়ে, আর সেটা আয়নায় লেখা।’ এই ধরনের লাইনগুলো যতটা বোর্হেসিয়ান (বাক্যের রহস্যময়তা অর্থে), ততটা সেবাল্ডিয়ানও (নিয়তির হাতে তাড়া খাওয়া মানুষের আফসোস নিয়ে খুব মৃদুস্বরে বলা অর্থে)। যা হোক, ফিলিপ যখন হল্যান্ডের লাইডেনে ধর্মতত্ত্ব পড়ছেন, তাঁর পায়ে পেরেক ঢুকল একদিন। পচন এমন পর্যায়ে গেল যে পা কেটে ফেলতে হবে। অপারেশনের আগে সার্জনকে মিনতি জানালেন ফিলিপ, তাঁর কাটা পা যেন রেখে দেওয়া হয়, তিনি যখন ভবিষ্যতে মারা যাবেন, তখন তাঁর সম্পূর্ণ শরীর নিয়েই তিনি কবরে যেতে চান। অপারেশনের পরে ফিলিপ ফেরহেয়েনের মাথায় অ্যানেসথেশিয়ার স্মরণ-বিস্মরণের কুয়াশা, তাঁকে বড় এক বোতলের মধ্যে দেখানো হচ্ছে তাঁরই কাটা পা, ‘দেখা যাচ্ছে চুবানো আছে ব্র্যান্ডিতে, যেভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে মাদেরকে দেখানো হয় নবজাতক শিশু।’ এর পরের বাক্যেই সেবাল্ডের লিরিক্যাল গদ্য, যাতে সময় ও স্থান একে অন্যের সঙ্গে ধীরে মিশে গিয়ে পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে বাকি সবকিছুর: ‘পা-টা একটা আদর্শ নমুনা হয়ে জীবন কাটাতে লাগল, অ্যালকোহলে ডুবানো সে, আছে চিরন্তন এক ঘোলার মধ্যে, স্বপ্ন দেখছে ভোরের ভেজা ঘাস ও সৈকতের উষ্ণ বালুতে দৌড়ে যাওয়ার তাঁর নিজস্ব স্বপ্ন।’ 

এই সার্জনেরই একুশ শতাব্দীর প্রতিরূপ এবারে ওলগার সৃষ্ট আরেক চরিত্র ডাক্তার ব্লাউ। ব্লাউ প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন যে মানুষের শরীরের টিকে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। ওলগা লিখছেন: ‘এটা ধৃষ্টতা যে মাটির নিচে আমাদের শরীরকে খুলে-পচে যাবার কিংবা আগুনের শিখায় কোনো আবর্জনার মতো পুড়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদি ব্যাপারটা ব্লাউয়ের হাতে থাকত, তাহলে পৃথিবী তিনি গড়তেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে, সেখানে আত্মা হতো মরণশীল, আর আত্মার আমাদের দরকারটাই–বা কী এবং শরীর হতো অমর।’ এই ব্লাউ দেখা করতে যান তাঁর সহকর্মীর বিধবা স্ত্রী তাইনা মোলের সঙ্গে। তাইনা তাঁকে দেখান তাঁর প্রয়াত স্বামীর আজব সৃষ্টি এক প্রায়-জীবন্ত বিড়াল। ব্লাউ হাত ঢুকিয়ে দিয়েছেন বিড়ালের পেটের ভেতরে, তাঁর হাত এগিয়ে যাচ্ছে বিড়ালটার ‘জীবন্ত’ হৃৎপিণ্ডের দিকে, হঠাৎ একটা ক্লিক শব্দ, বিড়ালের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির বদলে ব্লাউ শুনলেন জোরে বেজে ওঠা এক গানের সুর, পরে তিনি বুঝলেন ওটা ছিল ফ্রেডি মারকুরির বিখ্যাত গান ‘আই ওয়ান্ট টু লিভ ফরএভার’। গল্পটা পড়ে আমি ইউটিউবে এই গান শুনতে গিয়ে দেখি গানের লাইনটা আসলে ‘হু ওয়ান্টস টুলিভ ফরএভার’। তখনই ভেবেছিলাম, কত সুন্দর ওলগার ওই ইচ্ছাকৃত ভুল এবং যে পাঠক মূল গানটা কষ্ট করে শুনতে যাবেন, তিনিই কেবল জানবেন, সত্যিকারের কথাসাহিত্যিকেরা তাঁদের লেখায় ভুলটুল সব করেন ইচ্ছা করেই। 

দ্য মোরাভিয়ান নাইট–এর প্রচ্ছদ

ফ্লাইটস নামের এই আজব উপন্যাসের থিম পাশাপাশি দুটো: মানুষের যাযাবর জীবনের প্রতি তৃষ্ণা—সব সময় চলতে চায় মানুষ, স্থির হয়ে বসতে চায় না কোথাও; আর মানুষের শরীর, যার কিনা সীমানা ও আয়ু নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। বইটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল, অনেক লেখককে একসঙ্গে পেয়েছিলাম এখানে—মান্​তেইন ও টমাস ব্রাউনের প্রবন্ধ লেখার ক্ল্যাসিক জ্ঞান-উন্মোচন করতে করতে ক্লান্ত হওয়া টোন, রিলকের দিনপঞ্জিধর্মী উপন্যাস মালটে লাউরিডব্রিগ্​গেতে বয়ে যাওয়া খাপছাড়া হাওয়া (যে উপন্যাস আমার আগস্ট আবছায়ায় এসেছে বারবার), স্বাধীন মনে চলা কুন্ডেরার লেখার ধাঁচ, কালভিনোর জাদুবাস্তব প্রকরণ, সেবাল্ডের বিষণ্নতা এবং দৈবজ্ঞের অবসাদ নিয়ে ইতিহাসের নির্বিকার ধ্বংসলীলার গা-ছাড়া উন্মোচন। 

কিন্তু আমি আমার এই লেখা একেবারেই ওলগাকে নিয়ে লিখতে বসিনি। কী–বা লেখা যায় একজন লেখকের একটা মাত্র বই পড়ে? আমার এই লেখা মূলত হওয়ার কথা ছিল পিটার হান্ডকেকে নিয়ে। হান্ডকের মহিরুহ সমতুল্য লেখক ব্যক্তিত্বের তুলনায় ওলগা তো সেদিনকার শিশু! আর ওলগার যেখানে মাত্র একটা বই আমার পড়া, সেখানে হান্ডকে পড়েছি কমপক্ষে ছয়টা, এবং পড়ছি প্রায় দুই দশক ধরে নানাভাবে। কেন হান্ডকে পড়ি আমরা? কেন লাখ লাখ কপি, এমনকি মিলিয়ন কপি হান্ডকে বিক্রি হয় যখনই এই অতিপ্রজ লেখক একটা করে বই বাজারে ছাড়েন, তখনই? এমনকি—এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা—সুসান সন্টাগ এই ঘোষণা দিয়ে দেওয়ার পরেও যে পৃথিবীতে এখন থেকে লাখ লাখ পাঠক আর কোনো দিন হান্ডকে হাতে তুলবেন না? সালমান রুশদিও সেই ১৯৯৯-তে বলেছিলেন হান্ডকে ‘বছরের সেরা উজবুক (বা উন্মাদ)’। আমার ধারণা, বাঙালি পাঠক পিটার হান্ডকে নোবেল পাওয়ার পর অনেক বেশি জেনে গেছেন তাঁর মানবতাবিরোধী অবস্থান, সার্বিয়ানদের সংঘটিত গণহত্যায় তাঁর সমর্থন ইত্যাদি বিষয়ে। এর একটাও ভুল কথা না—হান্ডকে যুগোস্লাভিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন, খুনি সার্বদের নাৎসিদের সময়কার বিপদগ্রস্ত ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করেন, উপরন্তু তিনি স্রেব্রেনিকা ও অন্যত্র যে মুসলিম গণহত্যা ঘটে, তার সংখ্যা নিয়ে ঠাট্টা করেন, গণহত্যাকারী ঘৃণিত খুনি প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হান্ডকে ২০ হাজার লোকের সামনে তাঁর সপক্ষে স্তুতিবাক্য পড়েন, ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও আমি হান্ডকে পড়ি। নিশ্চিত তিনি বাংলায় লেখেন এমন আমাদের কোনো ১৯৭১ সালের চরম স্বাধীনতাবিরোধী দালাল লেখক হলে আমি তাঁকে ভালোবাসতাম না। তার মানে বসনিয়ান গণহত্যা কি আমার কাছে কোনো বিষয় না? না, কথাটা এমন না। ওগুলো আমার কাছে দূর ইউরোপের ইতিহাসের অনেক রহস্যময় অধ্যায়—হান্ডকের ব্যাখ্যাগুলো পড়ার পর একটু হলেও তো মনে হয় যে কার ভাষ্য নেব? হান্ডকের, না আমেরিকার? আবার অন্যদিকে হান্ডকে এত শক্তিশালী লেখক যে... নাহ্​, এ কথা বলার পর যদিও খেপে যেতে পারেন অনেকে তবু বলি, পিটার হান্ডকে এই চলতি শতাব্দীতে যত লেখক সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে (এমনকি নাইপল, কুয়েট্সি, বার্গাস ইয়োসাকে মাথায় রেখেও) সবচেয়ে শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক। আমি জানি না তিনি কবি হিসেবে কেমন, পরোক্ষসূত্রে জানি যে নাট্যকার হিসেবে তিনি অসাধারণ, আর জানি যে ঔপন্যাসিক হিসেবে অতুলনীয় তাঁর সৃষ্টিশীলতা—চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজের বিশ্বাসকে তুলে ধরা, শব্দের পরে শব্দে অবিশ্বাস্য আলো জ্বালিয়ে পথ চলা, পাঠের খাঁটি আনন্দ দান যাতে করে ঘুম নষ্ট হয়ে যাবে, যেহেতু মনে হবে যে কোনো একটা নতুন জীবনসত্য চোখের সামনে ফুটে উঠল যেন—এসব বিচারে পিটার হান্ডকে অতুলনীয়, যতটা অতুলনীয় চলতি শতকের আগের নোবেল বিজয়ী কথাকার আলবেয়ার কামু, গার্সিয়া মার্কেস, গুন্টার গ্রাস, হেমিংওয়ে এবং জোসেফ ব্রডস্কি (প্রবন্ধে)। 

হান্ডকে ‘লেখকদের লেখক’, যদিও সাধারণ পাঠক মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য পর্যায়ের। সবচেয়ে বিখ্যাত হান্ডকে গবেষক কথাসাহিত্যিক ডব্লিউ জি সেবাল্ডের কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে কিছু বাক্য তুলে ধরা যাক। হান্ডকের অনেক নামকরা উপন্যাস রিপিটেশন (পুনরাবৃত্তি, ১৯৮৬) প্রসঙ্গে সেবাল্ড: ‘এই বস্তু–পৃথিবীর পেছনে কী লুকিয়ে আছে, তা আমাদের মধ্যে যে লেখক দেখার সবচেয়ে বড় সামর্থ্য রাখেন, তিনি পিটার হান্ডকে। শুধু শব্দ দিয়ে তিনি আরও সুন্দর এক পৃথিবীকে আমাদের সামনে দৃশ্যমান করেন...তাঁর রাজনীতি স্পষ্টই ভুল, কিন্তু তিনি শব্দ-বিশ্বকে যা দিয়ে যাচ্ছেন, তাকে উপেক্ষা করার পথ কী?’

ফ্লাইটস-এর প্রচ্ছদ

হান্ডকেকে সমালোচকদের হাত থেকে বাঁচানোর প্রয়াস নিতে গিয়ে আবার সেবাল্ড: ‘শিল্প সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত অধিবিদ্যার (মেটাফিজিকস) সঙ্গে। ইতিহাসের টগবগে এক মুহূর্তকে আপনি ম্যাক্সিম গোর্কির মতো করে তুলে ধরুন, ওটা কোনো শিল্পসৃষ্টিই নয়; আবার একই ইতিহাসের দার্শনিক, পারলে আরও উচ্চতার মেটাফিজিক্যাল জায়গা থেকে, বয়ান আনুন, যেমন কনরাড, যেমন বোর্হেস, যেমন হান্ডকে ওটা নিখাদ শিল্প।’ রিপিটেশন উপন্যাসের নায়ক ফিলিপ কোবাল, আমার পড়া বিশ্বসাহিত্যের সেরা মানব মুক্তির স্বপ্নে বিভোর এক পোস্টমর্ডান চরিত্র, যার জীবনকে সেবাল্ড বলছেন: ‘বহুদিক থেকে তা মিলে যায় হান্ডকের নিজের পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে, যে গল্প আপনারা জানবেন হান্ডকের মায়ের আত্মহত্যা করা নিয়ে লেখা উপন্যাস এ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস পড়তে গেলে।’ গ্রামীণ দারিদ্র্যে বেড়ে ওঠা পিটার হান্ডকে এই উপন্যাসে তাঁর ঘোরলাগানো গদ্যে বলতে থাকেন চাষার পরিবার থেকে সভ্য জগতের মানুষের মাঝখানে চলে আসা এক ফিলিপ কোবালের গল্প, যাকে এখন লিখে লিখে, লিখিত শব্দের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে দিতে ‘তাঁর নিজের জীবনের রূপান্তরকে অর্জন করতে হবে¾নিপীড়িত জীবনের বেঁচে থাকা থেকে গর্বোদ্ধত দুর্দমনীয় এক উচ্চতায় উঠবার রূপান্তর।’

এই সামান্য পাঁচ-ছয় শব্দের মধ্যে পিটার হান্ডকের কোনো বিশ্লেষণ অসম্ভব, শুধু এটুকু বলা ছাড়া যে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস, ভিম ভেন্ডার্সের সিনেমার কারণে বহুল আলোচিত দ্য গোলি’স অ্যাংকজাইটি অ্যাট দ্য পেনাল্টি কিক, বিষয়ে জানবেন যে ওটা সার্ত্রে-কামু-অস্তিত্ববাদ এবং আরও বেশি হুলিও কোর্তাসারের গল্প ‘দ্য স্লাইম অব দ্য ডেভিল’ (যা নিয়ে আন্তোনিয়োনি বিখ্যাত সিনেমা বানান ব্লো-আপ নামে) ধরনের ‘এই পথ না ওই পথ’, ‘কী ঠিক আর কী বেঠিক’, ‘মারব না লুকাব’—জাতীয় দার্শনিক প্রশ্ন তোলা এক খেলা, যার একেবারে শেষে (মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার বই এটি) নায়ক তাঁর ফুটবলের গোলকিপারের পেনাল্টি কিকের মুখোমুখি দাঁড়ানোর অনিশ্চয়তা আর মানতে না চাওয়া জীবনটা থেকে পালাচ্ছে, এক মেয়েকে আকস্মিক ও অব্যাখ্যেয় কারণ থেকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে সে, আর এখন তার ঘরের বিছানায় বসে ভাবছে, ‘এই তো চেয়ারটা ছিল মাত্রই ডানে, এখন চেয়ারটা আবার বামে। ছবিগুলো কি উল্টে দেওয়া হয়েছে? সে ছবিটার দিকে বাম থেকে ডানে তাকাল, তারপর ডান থেকে বামে। আবার বাম থেকে ডানে, এই তাকানোটা বই পড়ার মতো। তারপর দেখল একটা “ওয়ার্ডরোব”, “তারপর” “একটা” “ওয়েস্টবাস্কেট”...।’ এরপরই ভাষার আর ক্ষমতা নেই বলার যে নায়ক কী দেখছে, অতএব অনেকগুলো প্রতীক, অনেকগুলো চিহ্ন আঁকা উপন্যাসের পাতায়, যার দ্বিতীয়টি গোলপোস্টের একটা ক্ষুদ্র ছবি।

হান্ডকের বইগুলোর মধ্যে যে বইটি জীবনে আরও একবার পড়তে চাই তা তাঁর দ্য মোরাভিয়ান নাইট। ‘প্রতিটা দেশেরই আছে যার যার সমরখন্দ, যার যার নুমানসিয়া’—এভাবেই শুরু করেন হান্ডকে, ‘সহস্র আরব্য রজনী’র ঢংয়ে, সেরভেন্তেস, বোর্হেসের মতো করে। উপন্যাসে দূর পৃথিবীর এই কিংবদন্তির জায়গাগুলোকে একত্রে যোগ দিয়েছে দানিউব নদীর মোরাভা নামের এক শাখায় ভাসতে থাকা এক হাউসবোট। এই নদীর পাড়েই মিলেছে স্লাভ ও জার্মানদের পৃথিবী, মূলত যুদ্ধে। এবার গল্পের কথক তাঁর হাউসবোট ঘিরে জড়ো করেছেন তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, দূরের আত্মীয় এবং যাঁকে নিয়ে তিনি গল্পটা বলছেন, সেই অতীতের এক লেখকের বন্ধুদের। তাঁদের সবাইকে তিনি এখন, এক ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়ে, শোনাবেন এক বহুস্তরবিশিষ্ট, সময়ের ধারণা দুমড়ে দেওয়া গল্প। কথক একবার গল্প বলতে বলতে পার হচ্ছে লা মাঞ্চা, আপনার তখন মনে পড়ছে সেরভেন্তেসের পৃথিবীর কথা, এবং যখন কথক বলছে (সেরভেন্তেসের দূর অতীতে লেখা সেই দোন কিহোতের চরিত্রগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে): ‘একের পরে একে তার পূর্বপুরুষেরা তার দিকে আসতে লাগল ভোরের আলোয়, তার কাছে পৌঁছাল, তাকে পার হয়ে গেল,’ তখন এ পৃথিবীতে ক্ষণিকের পাঠক হিসেবে সময়ের নির্বিকার বিপর্যস্ততা লক্ষ করে আপনার সম্ভবত চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবে। ৩২০ পৃষ্ঠার এ অবিশ্বাস্য উপন্যাস শেষ হচ্ছে এভাবে: ‘লেখক আমাদেরকে ডাকলেন তাঁর নৌকার ওপরে, বললেন, “আসো আসো, সবাই আসো, তোমাদেরকে একটা দুঃখের কাহিনি বলব আমি!” একটা দুঃখের কাহিনি? সেটা দেখা যাবে।’

মানবের উদ্​ভ্রান্ত জীবনের নানা দুঃখের কাহিনি ইতিহাসের ঘোলা প্রিজমের ভেতর দিয়ে দেখে লেখার পরে লেখায় তা বলে যেতে থাকা অর্ধোন্মাদ লেখক পিটার হান্ডকেকে বাঙালি পাঠক, বিশেষ করে লেখালেখি সিরিয়াসলি করতে চান যাঁরা, তাঁর ভুল ও তাঁর ঠিকটাসহই পূর্ণাঙ্গরূপে আবিষ্কার করবেন এইবার, এই আশা রাখলাম।