কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

পিছিয়ে থাকার কথা বলে সে–ই আগে চলে গেল!

আজ কবি আপন মাহমুদের মৃত্যুদিন। আজ থেকে আট বছর আগে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন প্রথম দশকের সম্ভাবনাময় এই কবি।

‘যেটুকু পথ পেরোতে বন্ধুদের তিন মিনিট লাগত—তা অতিক্রম করতেই

আমার লাগত কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট—এভাবেই একদিন আমি খুব

পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম—পেছনে তাকালে আমাকে দেখতে পেত

না কেউ—পেছনে কেবল ঝরাপাতার ওড়াউড়ি, ফেল করা বালকের

মুখচ্ছবি... ’ [ দৌড়]

কবির মৃত্যুর পর তার কোনো কোনো কবিতার মানে যেন পাঠকের উপলব্ধিতে নতুনভাবে ধরা দেয়। ওপরের এই কবিতাটিও তেমনি ভিন্ন এক মানে নিয়ে হাজির হয় আমার কাছে। কবিতাটি আপন মাহমুদের। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে আচমকা মৃতের দেশে চলে গেছে সে। আপন আমার বন্ধু, আমাদের বন্ধু। তাকে নিয়ে লিখতে এত বছর পরও হাত কাঁপে! অবাক লাগে, দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গেল আপনের চলে যাওয়ার! বিশ্বাস হতে চায় না, যে নিজেকে সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকার কথা বলে, সে-ই চলে গেল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে।

ওর জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র একটি ‘সকালের দাঁড়িকমা’, যেখানে ‘মা ও প্রজাপতি সিরিজ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতাসহ বেশ কিছু চৌকস কবিতা রয়েছে। যা তরুণ কবিদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে আপন আমাকে বলেছিল, ‘হাত তুলেছি সাব এডিটর’ নামে একটি কবিতার বই করবে। ওই কবিতাগুলোতে তুলে আনার চেষ্টা করা হবে দীর্ঘদিন মফস্বল ডেস্কে কাজ করতে গিয়ে আপনকে যেসব মফস্বল সংবাদ সম্পাদনা করতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা। ওই বইয়ের জন্য লেখা কিছু কবিতাও তখন শুনিয়েছিল সে। কয়েক বছর আগে আপনের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে ‘আপন মাহমুদ সমগ্র’বের হয়েছে। সেখানে আছে কবিতাগুলো। আপনের কবিতাসমগ্র হাতে নিয়ে ভাবছিলাম, কে লিখবে আপনের না লেখা কবিতাগুলো!

মৃত্যুর বছরখানেক আগে থেকে মেডিটেশন করতে শুরু করেছিল আপন। ওর হার্টে সমস্যা ছিল, ওর বাবা ছিলেন ক্যানসারের রোগী, মা ছিলেন অসুস্থ। অথচ গোটা পরিবার নির্ভরশীল ছিল ওর একার আয়ের ওপর। আপনের ধারণা হয়েছিল, মেডিটেশন করে নিজের রোগ ভালো করবে এবং দূর করতে পারবে জীবনের সমস্ত ভার!

দুই.

আপনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় কীভাবে হয়েছিল মনে করতে পারি না। সম্ভবত ২০০৪-এর প্রথম দিকে শাহবাগ আজিজ মার্কেটের দোতলায় শামীমুল হক শামীমের ‘লোক’-লিটলম্যাগ চত্বরের সামনে কিংবা পিজির বহির্বিভাগের সামনে। ওই সময় এই দুজায়গা ছিল আমাদের প্রথম দশকের কবিদের নিয়মিত মিলনকেন্দ্র।


আপন আমার চেয়ে বয়সে বছর দেড়েকের বড় ছিল, এরপরও সে আমাকে ফেরদৌস ভাই বলে সম্বোধন করত। কেন এই সম্বোধন ছিল ঠিক বলতে পারব না। তবে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। আর সেই বন্ধুত্ব কতটা গভীর হয়েছিল তার প্রমাণও পেয়েছি বহুবার।


২০০৪ সালের শেষের দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে চাকরি শুরু করি আমি। ওই সময় সহকর্মী হিসেবে পাই আপন মাহমুদকে। প্রথম দিন মধ্যরাতে অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় কীভাবে ফিরব, এ নিয়ে যখন আমি দ্বিধান্বিত, তখন আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আপন। তার পরীবাগের ছোট্ট বাসায় নিয়ে যায় আমাকে। সেখানে দুজনের সঙ্গে শেয়ার করে টিনশেডের এক বাসায় থাকত সে। ভাবতে খুব অবাক লাগে, আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ঢাকায় থাকার জন্য সবচেয়ে স্ট্রাগল করতে হয়েছে আপন মাহমুদকে।

জীবিকার সন্ধানে সে ঢাকায় আসে ২০০৪ সালে। একটি জাতীয় দৈনিকে চাকরি হওয়ার আগপর্যন্ত ওর ঢাকায় থাকার কোনো ভালো জায়গা ছিল না, ওকে থাকতে হতো দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে, যিনি ছিলেন একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক। আপনকে ওই বাসায় রাতে ঘুমানোর জন্য ঢুকতে হতো লুকিয়ে, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে তারপর। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো রাত একটার আগে ওই বাসায় ঢুকতে পারত না আপন। দেখা যেত গেটের বাইরে পায়চারি করে সবার শুয়ে পড়ার অপেক্ষায় সময় পার করতে হচ্ছে তাকে। প্রথম দিকে ঢাকায় রাত কাটানোর জন্য এই ছিল যার সংগ্রাম, সে-ই আমাকে নির্দ্বিধায় এক রাতের জন্য আশ্রয় দিয়েছিল সেদিন!

আপন মাহমুদ
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ঢাকায় থাকার জন্য সবচেয়ে স্ট্রাগল করতে হয়েছে আপন মাহমুদকে। জীবিকার সন্ধানে সে ঢাকা আসে ২০০৪ সালে। একটি জাতীয় দৈনিকে চাকরি হওয়ার আগপর্যন্ত ওর ঢাকায় থাকার কোনো ভালো জায়গা ছিল না, ওকে থাকতে হতো দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে, যিনি ছিলেন একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক। আপনকে ওই বাসায় রাতে ঘুমানোর জন্য ঢুকতে হতো লুকিয়ে, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে তারপর। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো রাত একটার আগে ওই বাসায় ঢুকতে পারত না আপন। দেখা যেত গেটের বাইরে পায়চারি করে সবার শুয়ে পড়ার অপেক্ষায় সময় পার করতে হচ্ছে তাকে। প্রথম দিকে ঢাকায় রাত কাটারনোর জন্য এই ছিল যার সংগ্রাম, সে-ই আমাকে নির্দ্বিধায় এক রাতের জন্য আশ্রয় দিয়েছিল সেদিন!
‘আপন মাহমুদ সমগ্র’–এর প্রচ্ছদ

তিন.

আপন মাঝেমধ্যে কথা বলত অনেকটা কবিতা আবৃত্তির ঢঙে, মনে হতো যেন কোনো মঞ্চনাটকে সংলাপ আওড়াচ্ছে। ওর এই কবিতা আবৃত্তির ভঙ্গিতে কথা বলা আমাদের কারও কারও কাছে ছিল হাসির খোরাক। তবে এটুকু বুঝতে পারতাম, ওর ওভাবে কথা বলার মধ্যে থাকত তীব্র আবেগ আর বিষণ্ণতা। ওই সময় দেখতাম নিজের গ্রাম লক্ষ্মীপুরের কড়াইতলার কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে উঠছে।

২০১০ সালে টাঙ্গাইল কবিতা উৎসবে গিয়েছিলাম আমি আর আপন। ওখানে দেখা হয় দেশের ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবির সঙ্গে। ওই যাত্রাটা আমাদের জন্য ছিল যেমন আনন্দের, তেমনি দুর্ভাগ্যেরও। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরোটা সময় আড্ডায় আড্ডায় বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে দুপুরে খাওয়ার পর। আড্ডায়-আনন্দে আমরা এতটাই মেতে উঠেছিলাম যে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে শিশুদের জন্য বানানো দোলনায় দোল খেতে থাকি আর লোহার তৈরি পাতে পিছল খাওয়ার চেষ্ট করি।

আর বিপত্তি ঘটে এ সময়টায়। আপন পা পিছলে পড়ে যায়, এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায় পা। আমার সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল এটা ভেবে, ওই দুর্ঘটনার আগেও ওর মুখে যে প্রাণখোলা হাসি ছিল, মুহূর্তেই সেই মুখ হয়ে উঠেছিল বিষণ্ন। সেদিন আমার টাঙ্গাইল থাকার ইচ্ছা থাকলেও ওখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আপনকে নিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়। এরপর মাসখানেক ভাঙা পা নিয়েই তাকে অফিস করতে হয়েছিল।

চার.

২০১১ সালে কথাপ্রকাশ থেকে বের হয় আপন মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘সকালের দাঁড়িকমা’। বইটি খুব সহজেই তরুণ কবিতাপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে আপন ‘ইত্তেফাক’–এ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিল। মনে পড়ছে ওই সাক্ষাৎকারটি যেদিন ছাপা হয়, আমি সেদিন গিয়েছিলাম মধুপুরের শালবনে। ওই দিন হঠাৎই মোবাইলে আপনের কল আসে, জানতে চায় ‘ইত্তেফাক’ দেখেছি কি না। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকাটা যেন অবশ্যই দেখি। ঢাকায় ফিরে পত্রিকাটা দেখব বলে লাইন কেটে দিই।

পরে অবশ্য ঢাকায় ফিরে আর পত্রিকা দেখার কথা মনে থাকে না। আপন আমাকে আবার ফোন দিয়ে মনে করিয়ে দেয় পত্রিকাটি দেখার কথা। পরে আমি ওই সংখ্যাটি সংগ্রহ করে দেখি সাক্ষাৎকারে আপন তার প্রিয় বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছে আমার নাম।

সাক্ষাৎকারটিতেই আপন আরও বলেছিল, ‘সমকালীন সাহিত্য নিয়ে, রাজনীতি হচ্ছে। সাহিত্য নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা যত বড় লেখকই হন না কেন আমার চেয়েও খারাপ। লেখক হওয়ার চেয়ে “মানুষ” ভালো। পৃথিবীর জন্য ভালো মানুষ দরকার।’

পৃথিবীর জন্য যে ভালো মানুষের প্রয়োজনের কথা আপন বলেছিল, তা আসলে সে নিজেও যেন হতে চেয়েছিল। কোনো সাহিত্যিক কেওয়াজে তাকে কখনো দেখা যায়নি। তবে সমসাময়িক অনেক সাহিত্যিক–কোন্দলই আপনকে যে মানসিকভাবে পীড়িত করেছিল, তার উক্তি থেকেই এটা টের পাওয়া যায়! আপন জাগতিক সব হিসাব–নিকাশের ঊর্ধ্বে গিয়ে শুয়ে আছে তার প্রিয় গ্রামের মাটিতে, কড়াইতলায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনের কবিতাও অনেক তরুণের কাছে অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠছে। আপনের কবিতার যথাযথ মূল্যায়ন হোক—এটাই কামনা করছি।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com