>
চিলির কালজয়ী কবি পাবলো নেরুদার মৃত্যুদিন ২৩ সেপ্টেম্বর। প্রেম ও বিপ্লবের এই কবি তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর সম্প্রতি অভিযুক্ত হয়েছেন হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। নতুন এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বিশ্বের বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় কবির দিকে ফিরে দেখা। থাকছে তাঁর কবিতার অনুবাদও।
একটা কবিতা পাঠককে কীভাবে স্পর্শ করে, তার অনেকখানি নির্ভর করে জীবনের কোন পর্যায়ে, কী রকম মানসিক পরিস্থিতিতে কবিতাটা পড়া হয়েছে, তার ওপর। আমি যে পাবলো নেরুদার নামের সঙ্গে বিষাদময় শান্তির আভাস পাই, তার কারণ ২০০৬ বা ২০০৭ সালের একটা শীতের রাত। খুব বিধ্বস্ত, নিরেট আর অস্থির রাত ছিল সেটা। কোনো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থায় অন্তর্জাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে যখন পেলাম পাবলো নেরুদার কবিতা ‘আই ক্যান রাইট দ্য স্যাডেস্ট পোয়েম অব অল টুনাইট’, তখন থমকে গেলাম। আমার ভেতরের তোলপাড় শব্দের রূপ ধরে জ্বলজ্বল করছিল চোখের সামনে।
অকল্যান্ডে আমাদের ছোট কাঠের বাড়িটার দোতলার ঘরের জানালার কাছে বসে পড়ছিলাম মনে আছে। কবিতার প্রতিটা অক্ষর, যতিচিহ্ন, দুই শব্দের মধ্যিখানের শূন্যতা যেন তরল হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় আমার অস্থিরতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়াতে ছড়াতে শান্ত করছিল আমাকে। পড়ছিলাম ‘অ্যান্ড দ্য পোয়েম ফলস টু দ্য সোল অ্যাজ ডিউ টু গ্রাস...’। সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা তর্জমা করলাম ‘শিশিরের মতো হৃদয়ে ঝরে পড়ে কবিতা...’ এবং অবধারিতভাবে মনে এলেন জীবনানন্দ, ‘শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে...ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল...’।
সে সময় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারার মতো মনের অবস্থা ছিল না, কিন্তু চাইছিলাম কবিতাটার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যেতে, যেখানে আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব আর থাকবে না। পড়তে পড়তে একটা সময় বাংলায় অনুবাদ করতে শুরু করলাম কবিতাটার, চোখের পানিতে ল্যাপটপের মনিটর ঝাপসা দেখছিলাম, ঘরের ভেতরে অন্য কোনো আলো ছিল না। আমি লিখছিলাম, ‘রাতটা তারায় ভরা, আর তারারা নীল, কাঁপছে দূরে...’। বান্ধবহীন নীরব সেই রাতে কি-বোর্ডে টাইপ করার শব্দটুকু শিশিরের মতোই টুপটাপ ঝরেছিল। জানালার কাচে তখন চাঁদের আলো আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে চিরপরিচিত গাছের শাখারা অপরিচিতের মতো দুলছিল। যেন আমি পড়ব বলেই লেখা হয়েছে কবিতাটা, যেন আমার আগে কেউ কখনো পড়েনি।
পরবর্তী সময়ে এই নেরুদার স্মৃতিকথার শুরুতে পড়েছিলাম: ‘হয়তো আমার জীবন শুধু আমার মধ্যেই সমাপ্ত নয়, হয়তো অন্যদের জীবনও যাপন করেছি। এই পৃষ্ঠাগুলোর ওপর আমার যে লেখা রেখে যাচ্ছি, সেখান থেকে হেমন্তের উদ্যানে ঝরে পড়া হলুদ পাতারা মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে অথবা আঙুরখেতে ফসল তোলার মৌসুমের মৃত আঙুরেরা পবিত্র মদের ভেতরে নতুন জীবন খুঁজে পাবে। এই সমস্ত জীবন একত্র করেই আমার জীবন—কবির জীবনেরা...।’
মনে হয়েছিল, তাঁর ওই বহুপঠিত, বহু ভাষায় বহুবার অনূদিত কবিতাটা সে রাতে আমি যে একদম আনকোরাভাবে নিজের ভেতর অনুভব করব, নেরুদা তা আগেই জানতেন। এভাবে যাঁর সঙ্গে পরিচয়, তাঁকে আত্মার অংশীদার করে নেওয়া ছাড়া উপায় কী!
তিনি চিলির কবি, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং একজন বিপ্লবীও—এই সাধারণ তথ্যগুলো আগেই জানতাম। তবে যে ‘পাবলো নেরুদা’ নামে সবাই চেনেন তাঁকে, ওই নামটা, পরে জেনেছিলাম, নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সে। জন্মের পর তাঁর নামকরণ হয়েছিল রিকার্দো নেফতেলি রেইজেস বাসোয়ালতো। ১৯৭১ সালে প্যারিস রিভিউ একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। সেখানে রিটা গিবার্ট নেরুদার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি নাম বদল করলেন, আর ‘পাবলো নেরুদা’ নামটাই কেন বেছে নিলেন? উত্তরে নেরুদা বলেছিলেন, লেখালেখির বিষয়ে তাঁর বাবার অস্বস্তি ছিল, যিনি মনে করতেন এসব ধ্বংস ডেকে আনবে। নাম পরিবর্তন ছিল তাঁর প্রথম আত্মরক্ষামূলক কাজ।
কোনো রোদেলা দুপুরে, যখন আমার প্রিয় মানুষেরা আশপাশে, যখন আমাদের একত্রিত অবস্থানের প্রমাণ দিতে দিতে আকাশ-বাতাসে মিলিত হাসি আর কথারা ভেসে যাচ্ছে, তখন যদি নেরুদার ওই কবিতা প্রথম পড়তাম, কেমন লাগত জানি না। কিন্তু খুব অবাক লাগে ভাবলে যে কীভাবে ১৯২৩ সালে সান্তিয়াগোর ১৯ বছর বয়সের নেরুদার অনুভূতি মিলে যায় ১৯৪২ সালে বরিশালের ৪৩ বছর বয়সের জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে! সে সময় দুজনই তাঁরা জীবিত, একই পৃথিবীর মানুষ। আর ওই সময় পৃথিবীতে আমার অবস্থানের কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি, অথচ আরও অনেক দশক পরে যখন এই কবিরা কেউ আর নেই, তাঁদের কবিতার শিশিরবিন্দুর আর্দ্রতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, এভাবেই কোনো কোনো মূহূর্তে একটা বিন্দুতে মিলে যাই আমরা।
নেরুদার মৃত্যুর পর ১৯৭৪ সালে তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছিল স্প্যানিশ ভাষায়, পরে ১৯৭৭–এ প্রকাশিত হয় এর ইংরাজি অনুবাদ। জন্মানোর পর থেকে কত রকম অভিজ্ঞতার পলি জমে জমে আমরা বেড়ে উঠি। জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা, মুহূর্ত এবং সংযোগ আমাদের নিয়তি নির্ধারণ করে। যদি নেরুদা ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক মাসের মাথায় তাঁর মায়ের মৃত্যু না ঘটত, তিনি কি অন্য রকম কেউ হতেন? সারা জীবন কী তীব্রভাবে বিভিন্ন নারীর কাছে ভালোবাসা খুঁজেছেন, মায়ের আদরে বড় হলে কি এ রকমটা হতো? স্মৃতিকথার শুরুতে আছে চিলির জঙ্গলের কথা। বর্ণনা পড়ে মনে হয় যেন একটা সমান্তরাল পৃথিবীতে ঢুকে গেছেন তিনি: ‘আগ্নেয়গিরির নিচে, তুষার আচ্ছাদিত পাহাড়ের পাশে, বিশাল হ্রদগুলোর মাঝে, সুগন্ধি, নিশ্চুপ, জটিল চিলির জঙ্গল...ঝরা পাতায় আমার পা ডুবে যায়, গাছের ভঙ্গুর ডাল আমার পায়ের তলায় চড়চড় করে ওঠে, অতিকায় রাউলিগাছগুলো সর্বশক্তিতে অভ্যুত্থিত হয়। হিমশীতল জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা পাখি উড়ে এসে ডানা ঝাপটায়, সূর্যহীন গাছের ডালগুলোতে বসে। তারপর তার লুকানো জায়গা থেকে সানাইয়ের মতো গেয়ে ওঠে...লতাগুল্মের বনজ গন্ধ, ঔষধির গাঢ় গন্ধ আমার নাকের ভেতরে ঢুকে অস্তিত্ব ভাসিয়ে নিয়ে যায়...।’ পড়তে পড়তে বুঝতে পারি, কীভাবে তাঁকে ঘিরে থাকা প্রতিটা স্থির ও চলমান অস্তিত্ব, তাদের শব্দ–গন্ধ অবারিত এবং অত্যন্ত শারীরিকভাবে তাঁর ধমনিতে রক্তের মতো প্রবাহিত হতো। গাছেদের, পাখিদের প্রতি যেমন, তেমনি একটা পাথর বা মাটি খুঁড়ে বের করে আনা একটা মাকড়সার প্রতিও সমান আগ্রহী তিনি।
ভালোবাসা খুব ধীর বিষয়। আস্তে আস্তে অস্তিত্বের সঙ্গে মিশতে মিশতে শিকড় মেলতে থাকে। তাই আমি বহুদিন ওই এক কবিতাতেই মগ্ন ছিলাম। এর সূত্র ধরে ডব্লিউ এস মারউইনের অনুবাদে নেরুদার টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড আ সং অব ডেসপেয়ার পড়েছি। জেনেছি মারউইনের করা ইংরেজি অনুবাদ আমার প্রথম পড়া সংস্করণের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এই কবিতাগুলো তীব্রভাবে শারীরিক এবং একই সঙ্গে বিষণ্ণ। আমার স্মৃতিতে তাই একজন বিষণ্ণ প্রেমিক হিসেবেই তিনি প্রথমে হাজির হন।
অথচ নেরুদা তো বিপ্লবীও ছিলেন। প্রেমিক ও বিপ্লবীর ভেতর কোনো বিরোধ দেখি না আমি। নেরুদাও সে রকম বলেছিলেন ১৯৬৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চিলির কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনে লড়ার সময় নিজের বক্তৃতায়: ‘আমি কখনো মনে করিনি আমার জীবন কবিতা ও রাজনীতি—এই দুই ভাগে বিভক্ত, আমি চিলির একজন নাগরিক, যে কয়েক দশক ধরে আমাদের রাষ্ট্রীয় অস্ত্বিত্বের সঙ্গে জড়িত দুর্ভাগ্য ও বিগ্রহকে জেনেছে এবং এ দেশের মানুষের প্রতিটা আনন্দ ও বেদনার অংশীদার হয়েছে। তাদের কাছে আমি অপরিচিত নই, তাদের ভেতর থেকেই এসেছি, আমি জনগণের অংশ। আমি শ্রমজীবী পরিবার থেকে এসেছি...এবং কখনো ক্ষমতাধরদের দলে ছিলাম না, সব সময় আমি অনুভব করেছি, আমার পেশা হলো কাজ ও কবিতার মাধ্যমে চিলির মানুষের সেবা করা। আমি বেঁচে আছি তাদের রক্ষা করার গান গেয়ে।’
কিছুদিন আগে প্যারিস রিভিউ-এ মার্ক এস্নারের লেখা একটা নিবন্ধ পড়ছিলাম। নাম ‘নেরুদার প্রতিরোধের কবিতা থেকে আমরা কী শিখতে পারি’ (হোয়াট উই ক্যান লার্ন ফ্রম নেরুদা’স পোয়েট্রি অব রেসিস্ট্যান্স)। এখানে বলা হয়েছে এখনকার ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে, যখন সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদ আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, নেরুদার কবিতা তখন কতটা প্রাসঙ্গিক। গত শতকের ত্রিশের দশকে মাদ্রিদ পৌঁছে সমাজকর্মী ও শিল্পী বন্ধুদের সংস্পর্শে সঞ্জীবিত হয়েছিলেন নেরুদা। অথচ স্পেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সে সময় চলছিল অদ্ভুত টানাপোড়েন। ঐতিহাসিক গ্যাব্রিয়েল জ্যাকসনের ভাষায়, ‘ত্রিশের দশকের স্পেন একই সঙ্গে ছিল মৃতপ্রায় রাজতন্ত্র, অমসৃণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশ এবং তীব্র রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত যুদ্ধক্ষেত্র।’ হিটলার আর মুসোলিনির ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের ফ্যাসিস্টরাও সরাসরি ও উগ্রভাবে জানান দিচ্ছিল নিজেদের অস্তিত্ব।
১৯৩৬ সালের ১৭ জুলাই হিটলার ও মুসোলিনির মদদে ফ্যাসিস্ট সেনানায়ক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে সামরিক বিদ্রোহে স্পেনে গৃহযুদ্ধ বেধে গেল। ফ্রাঙ্কোর বাহিনী দ্রুত মাদ্রিদের দিকে এগোচ্ছিল, যেখানে নেরুদা এবং তাঁর বন্ধুরা থাকতেন। তাঁরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদবিরোধী একটা দল গড়ে তুলেছিলেন, যাঁরা তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা কার্ভান্তেস থেকে শুরু করে লোরকার বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়িত করে জনগণকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করতেন। গণতান্ত্রিক সৈন্যদের জন্য একটা ছোট পত্রিকাও বের করতেন তাঁরা। যাঁদের অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তাঁদের জন্য দলের একজন লেখাগুলো পড়ে শোনাতেন। এ পত্রিকায় আন্তোনিও মাচাদো ও রাফায়েল আলবার্তির মতো লেখকেরাও লিখেছেন। যুদ্ধের এক মাসের মাথায় লোরকাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং যখন তাঁর অপরাধ জানতে চাওয়া হয়েছে, নির্বাহী কর্মকর্তা জবাবে বলেছেন, ‘অন্যরা পিস্তল দিয়ে যা পারেনি, সে তার কলম দিয়ে সেই ক্ষতি করেছে।’ এর তিন দিন পর লোরকাসহ আরও তিন বন্দীকে একটা জলপাইগাছের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনায় নেরুদার অস্তিত্ব নাড়া খেয়েছিল। তাঁর কাছে লোরকা ছিলেন মূর্তিমান কবিতা। তাই বন্ধুর মৃত্যুর ভয়াবহতা ছাপিয়েও নেরুদার মনে হয়েছিল, ফ্যাসিস্টরা কবিতাকেই হত্যা করেছে। তিনি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিলেন, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব ছিল না। তাঁর কবিতার ভাষা বদল হয়েছিল। বিষণ্ন প্রেমের কবিতা, যা ফ্যাসিজমের বাস্তবতাকে এত দিন অগ্রাহ্য করে ছিল, তা ছেড়ে এবার তিনি লিখতে শুরু করলেন অনেক বেশি সোজাসাপ্টা, সাহসী ও জ্বলন্ত ভাষায়, যার মাধ্যমে তাঁর হৃৎস্পন্দনের শব্দ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা আরও বিস্তৃত পাঠক দলের মর্মে পৌঁছাবে। সে সময় যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় একুশটা কবিতা লিখেছিলেন তিনি, যা তাঁর বই স্পেন ইন আওয়ার হার্ট-এ (হৃদয়ে স্পেন) আছে।
সেই ১৯৩৬ সালে লেখা কবিতাগুলো বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক ডামাডোলে। যেমন ২০০৫ সালে হ্যারল্ড পিন্টার সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর তাঁর বক্তৃতায় এবং ২০১৮ সালে মার্টিন লুথার কিং দিবসে লেখক অ্যালেক্সান্ডার কোয়াম যে কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, সেটা পাবলো নেরুদার, ‘আই অ্যাম এক্সপ্লেইনিং আ ফিউ থিংস’ (আমি কিছু কৈফিয়ত দিচ্ছি)। কবিতাটা ছিল:
আর এক সকালে, সেই সবকিছু পুড়ছিল
এক সকালের বনফায়ার
মাটি থেকে সটান লাফিয়ে
গ্রাস করল মানুষকে,
আর তারপর থেকে আগুনকে,
বারুদকে তারপর থেকে, এবং অতঃপর রক্ত।
উড়োজাহাজ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমির মালিক দস্যুরা,
অঙ্গুরি আর রাজকন্যাদের প্রভু দস্যুরা,
কালো ধর্মভাইদের নিয়ে দস্যুরা এল আকাশপথে
আশীর্বাদ ছিটাতে ছিটাতে শিশুহত্যার জন্য।
আর শিশুদের রক্ত গড়াল রাস্তায় গোলমাল ছাড়াই,
শিশুর রক্তের মতন।
শেয়াল যাদের শেয়ালও ঘৃণা করবে
পাথর যাতে শুকনো কাঁটাগাছও পারে না
দাঁত বসাতে,
কালসাপ যারা কালসাপের কাছেও ঘৃণ্য।
তোমার সঙ্গে মুখোমুখি আমি দেখেছি
স্পেনের রক্ত জলোচ্ছ্বাসের মতোই উথলে উঠছে
একটা ঢেউই তোমায় ডোবাবে
ছুরি-চাকু এবং অহংসমেত।
বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কেরা;
দেখো আমার মরা বাড়ি; ভাঙা স্পেনকে দেখো:
প্রতিটা ঘর থেকে বইছে পোড়া ধাতুর নালা
ফুলের বদলে স্পেনের প্রতিটা রন্ধ্র থেকে স্পেন
আবির্ভূত হয় আর
প্রতিটা মৃত শিশুর থেকে চক্ষুষ্মাণ রাইফেল
আর প্রতিটা অপরাধ থেকে জন্মায় বুলেট
যারা একদিন খুঁজে নেবে তোমার
বুকের ঠিক মাঝখানটিকে।
এবং তোমরা জানতে চাইবে: কেন তার কবিতা
স্বপ্ন আর পাতার কথা বলে না
আর বলে না তার দেশজ আগ্নেয়গিরির কথা।
এসো আর রাস্তাগুলোয় রক্ত গড়ায় দেখো।
এসো আর দেখো
রাস্তায় রক্ত গড়ায়।
এসো আর দেখো রক্ত
গড়ায় রাস্তায়!
চে গুয়েভারা ১৭ বছর বয়সে তাঁর প্রথম প্রেমিকাকে নেরুদার কবিতা শুনিয়েছিলেন। তারপর সারা জীবন ধরে এই কবির লেখা সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন। সিয়েরা মায়েস্ত্রার গেরিলা যুদ্ধের সময় বিকেলবেলায় চে তাঁর সৈন্যদেরকে নেরুদার ‘ক্যান্ত জেনেরাল’ থেকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি যখন বলিভিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হন, তখন তাঁর স্ত্রীর জন্য নিজের কণ্ঠস্বরে রেকর্ড করে এসেছিলেন নেরুদার প্রেমের কবিতা। আর ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে বলিভিয়ায় আহত চে যখন ধরা পড়েন এবং পরদিন সিআইএ যখন তাঁকে হত্যা করে, সেই সময় এই বিপ্লবীর ব্যাকপ্যাকে পাওয়া গিয়েছিল সবুজ রঙের নোটবুক। সেখানে চারজন কবির লেখা উনসত্তরটা কবিতা ছিল, যার বেশির ভাগই নেরুদার লেখা।
নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথায় খুব অদ্ভুত একটা ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তখনো তিনি কিশোর। একবার হার্নান্দেজ উপজাতিদের একটা দলের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করছেন। তখন আধো ঘুমে অস্পষ্টভাবে টের পেলেন খড়ের বিছানার ওপরে একটা অপরিচিত শরীর এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। ভয় পেয়েছিলেন তিনি, শ্বাস বন্ধ করে শুনেছিলেন এগিয়ে আসা শরীরের নিচে খড়ের খসখস শব্দ। তারপরে অমসৃণ, কড়া পড়ে যাওয়া একটা হাত এসে পড়েছিল তাঁর গায়ের ওপর, কোনো নারীর হাত: ‘আমার ভ্রু, চোখ, সারা মুখে আদর বোলাচ্ছিল। একটা লোভাতুর ঠোঁট আমার ঠোঁটে লেগে ছিল, তার সারা শরীর একদম মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমার ওপরে উঠে এসেছিল। ধীরে ধীরে আমার ভয় রূপান্তরিত হলো তীব্র সুখের অনুভূতিতে...।’
আবার এই একই মানুষকে নিয়ে কিছুদিন আগে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটা লেখা পড়লাম, যার শিরোনাম ‘পোয়েট, হিরো, রেপিস্ট’। গার্ডিয়ান–এর এই লেখার উৎসও তাঁর স্মৃতিকথা। নিজের স্মৃতিকথায় নেরুদা লিখেছেন ১৯২৮ সালে শ্রীলঙ্কা থাকাকালীন গৃহপরিচারিকার সঙ্গে ঘটানো তাঁর অপকর্মের কথা। গত প্রায় চল্লিশ বছর ঘটনাটা চোখের সামনে থেকেও উপেক্ষিত হয়েছে। এই উপেক্ষার কারণ নিয়ে আমি ভাবি। তখন কি সমাজ অন্য রকম ছিল? বিষয়টা সাদা চামড়ার উচ্চশ্রেণির কারও সঙ্গে ঘটেনি বলে পাশ কাটানো হয়েছিল? সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনের কারণে ঘটনাটা আলোচিত হচ্ছে।
স্মৃতিকথায় নেরুদা বলেছেন, প্রতিদিন মেয়েটা তাঁর বাথরুম পরিষ্কার করতে আসত। তাঁর বর্ণনায় মেয়েটা কখনো দেবী, কখনো বন্য কেউ, কখনো অন্য কোনো অস্তিত্ব, অন্য পৃথিবীর কিছু। নেরুদা লিখেছেন, ‘এক সকালে, আমি সবটুকু চাইলাম। জোর করে তার কবজি ধরে রেখে আমি তার চোখের দিকে চেয়ে থাকলাম। তার সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো ভাষা আমার ছিল না। তাকে আমার বিছানায় নিয়ে এলাম আর সে ভাবলেশহীনভাবে আমার সঙ্গে এল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নগ্ন শুয়ে ছিলাম আমার বিছানায়। তার সরু কোমর, ভরাট নিতম্ব, উপচানো পেয়ালার মতো স্তনে তাকে হাজার বছরের পুরোনো দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যের মতো লাগছিল। সেটা ছিল এক পুরুষ ও মূর্তির মিলন। সারাটা সময় তার চোখ সম্পূর্ণ খোলা ছিল, আর সে ছিল একদম নিঃসাড়। সে আমাকে ঘৃণা করেই ঠিক করেছে। এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কখনো হয়নি।’
এ ঘটনা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম আমি। এ জন্য না যে এটা অবিশ্বাস্য। মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। একজন মানুষের ভেতরে কত হাজার হাজার মানুষ লুকিয়ে থাকে, আমি জানি। তবু সেই প্রথম পাঠে যে খান খান হয়ে ভেঙে যাওয়া, একলা, বিষণ্ণ নেরুদাকে আমি অনুভব করেছি, আমার অস্তিত্বে মিশতে দিয়েছি, তার সঙ্গে তাঁর এই নতুন রূপ কীভাবে মেলাব, আমি জানতাম না। হয়তো জগতের নিয়মই এমন, যা কিছুই নিটোল, সম্পূর্ণ, পবিত্র, কোনো না কোনোভাবে তা ক্ষয়ে যায়, দাগ লাগে আর আমরা একটু একটু করে নিজেদের হারাতে থাকি। দেবযানীর মতো বুঝতে থাকি: ‘হায় সখা, এ তো স্বর্গপুরী নয়, পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়...’।
আবার এ-ও সত্যি যে এই ঘটনার কথা নিজের স্মৃতিকথায় যদি না লিখতেন নেরুদা, আমরা কেউ এ সম্পর্কে জানতেও পারতাম না। তাঁর প্রেমিক, নায়ক এবং বিপ্লবীর ভাবমূর্তিই কেবল অক্ষুণ্ন থাকত। তিনি যখন বলেন, ‘সে আমাকে ঘৃণা করেই ঠিক করেছে। এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কখনো হয়নি’, আমি তাঁর অনুশোচনা টের পাই। মানুষের কোন অপরাধ ক্ষমার যোগ্য, কোন পরিস্থিতিতে, তার মাপকাঠি একেকজনের কাছে একেক রকম। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত গার্ডিয়ান পত্রিকার শিরোনামটাই ঠিক আছে: ‘পোয়েট, হিরো, রেপিস্ট’—এই সব কটাই তাঁর পরিচয়। এক পরিচয়ের কারণে অন্য পরিচয় মিথ্যা হয়ে যায় না। তবু শিশিরের মতো হৃদয়ে ঝরে পড়ে তাঁর কবিতা আর মনের ভেতর গুনগুনিয়ে ওঠে: ‘আমি তাকে আর ভালোবাসি না সত্যি, তবে হয়তো তাকে ভালোবাসি। প্রেম কত সাময়িক আর ভুলে যাওয়া অসীম।’