২ মে বাংলার কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ। তাঁর স্মরণে এবং সত্যজিৎসংক্রান্ত দুর্লভ লেখায় এই আয়োজন
সংগ্রহ ও ভূমিকা জামিল বিন সিদ্দিক
সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁর একটি অগ্রন্থিত লেখা।
কলকাতার সাময়িকী অমৃতর শারদীয় সংখ্যায় একসময় সত্যজিৎ রায়ের লেখা থাকত নিয়মিত। তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহতে সেসব লেখার প্রায় সব কটিই সংকলিত হয়েছে। তবে কোনো কারণে ‘পরিচালকের কাজ’ শিরোনামের এ লেখা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। এর একটি কারণ হয়তো লেখাটিতে লেখকের নাম ছিল একেবারে নিচে। এটি প্রথম সংকলিত হয়েছিল শারদীয় অমৃত ১৩৭০ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়।
এখানে সমকালীন বানানরীতি বজায় রাখা হয়েছে।
ছাত্রাবস্থায় কোনো ভালো ছবি দেখলে একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে জাগত। প্রশ্নটি হলো—এই ভালো ছবির কোন কোন ভালো জিনিসটির জন্য পরিচালক দায়ী? ভালো অভিনেতা ভালো অভিনয় করবেন, এতে আর আশ্চর্য কী? ভালো ক্যামেরাম্যান তাঁর কাজ ভালোভাবেই জানেন, যেমন জানেন ভালো শিল্পনির্দেশিক; এখানে পরিচালকের কারসাজি কোথায়? শব্দ গ্রহণের উৎকর্ষের জন্যই বা পরিচালক কোন বাহবা নিতে পারেন? আর সম্পাদনা? তার জন্য তো অভিজ্ঞ সম্পাদক রয়েইছেন। পরিচালকের কাছে তাঁর নতুন করে শেখার কিছু আছে কি?
আমি অনুমান করি, আজও হয়তো অনেকের মনে এই ধরনের প্রশ্ন জাগে। কিন্তু একটু ভেৰে দেখলেই বোঝা যাবে যে এককভাবে এই সব কলাকুশলী যতই দক্ষ হোন না কেন, কোনো একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধিনায়কের নির্দেশ না পেলে এঁদের বিভিন্নধর্মী প্রয়াসকে সুসংবদ্ধভাবে একত্র করে একটা ছবির কাজে প্রয়োগ করা অসম্ভব। উপরন্তু, কোনো ছবির কাজের শেষে সমগ্র ছবির চেহারাটি কেমন দাঁড়াবে, তাঁরই মানসকল্পিত রূপটি পর্দায় প্রতিফলিত হোক, এই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
অভিনেতা যতই উঁচু দরের শিল্পী হোন না কেন, কোন দৃশ্যে তাঁর অভিনয়ের মাত্রা কী হবে, সেটা বিচার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, যেহেতু সমগ্র ছবির কল্পনাটি তাঁর নয়, পরিচালকের। পরিচালক নিজে দক্ষ অভিনেতা না হলেও অভিনয়ের রীতি আকারে–ইঙ্গিতে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর থাকা চাই। অভিনয়ের দোষগুণও তাঁকে বিচার করতে হয় এবং দোষ হলে সে দোষ সংশোধনের উপায় জানতে হয়।
পরিচালকের দ্বিতীয় কাজ হলো, কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি দৃশ্যকে দেখতে হবে, সেটা বিচার করা। দৃষ্টিকোণ নির্বাচনের ভুলে ভালো অভিনয়ও মাঠে মারা যেতে পারে, সুলিখিত নাটকীয় দৃশ্য পর্দায় নিষ্প্রাণ মনে হতে পারে। এইখানে ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন এসে পড়ছে। ক্যামেরাযন্ত্রের ব্যবহার হাতেনাতে না শিখলেও, ক্যামেরার দৌড় কতখানি, তার বিভিন্ন লেন্সের কী ব্যবহার, কী বিশেষত্ব; ক্যামেরা এগোনো-পেছোনোর প্রয়োজন কখন, তার সার্থকতা কী—এই সব জানতে হবে।
শব্দযন্ত্রীর কাজও পরিচালকের নির্দেশের অপেক্ষা রাখে। শব্দ গ্রহণের যান্ত্রিক সমস্যায় তাঁর কোনো হাত নেই। তবে কোন দৃশ্যে কোন শব্দ কীভাবে ব্যবহার হবে, সে জ্ঞান পরিচালকের থাকা দরকার। স্টুডিওর কৃত্রিম পরিবেশে তোলা দৃশ্যকে আশ্চর্য বাস্তব ও বিশ্বাস্য করে তোলা যায় শব্দের ব্যবহারে।
সবশেষে সম্পাদনার কাজে পরিচালককে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়; কারণ, সম্পাদনাই চলচ্চিত্রে গতি ও প্রাণসঞ্চার করে। অসংলগ্ন কতগুলি শট ও দৃশ্যকে কীভাবে পরপর জোড়া দিতে হবে, তার মোটামুটি ইঙ্গিত চিত্রনাট্যেই দেওয়া থাকে। কিন্তু সব সময়ে সেসব ইঙ্গিত অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ না করে প্রয়োজন বুঝে কিছু অদলবদল করতে হয়। পরিচালক সম্পাদকের পাশে থেকে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সেই সব পরিবর্তন করেন।
অভিনেতা, ক্যামেরাম্যান, শিল্পনির্দেশক, মেকআপম্যান, সম্পাদক—এঁদের সকলকেই যেমন পরিচালক নির্দেশ দেন, তেমনি আবার সময় সময় এঁদের ব্যক্তিগত মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য নিতেও কসুর করেন না। এই কারণেই শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্র-রচনায় একটা যৌথশিল্পের দিক থেকেই যায়। তাই সব সময়েই কোনো ছবি ভালো হলে তার জন্য বাহবা পরিচালকের সঙ্গে সঙ্গে কলাকুশলীদেরও আংশিকভাবে প্রাপ্য।