‘সুইডিশ একাডেমি আপনাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে’

নোবেল পাওয়ার পর কেমন ছিল তাঁদের প্রতিক্রিয়া

কদিন আগে আবদুলরাজাক গুরনাহ যখন তাঁর নেবেল জয়ের সংবাদ শোনেন, তখন তিনি ছিলেন রান্নাঘরে। নোবেলজয়ী সাহিত্যিকেরা নিজেদের নোবেল জয়ের সংবাদ পেয়েছিলেন কীভাবে? অন্তর্জাল ঘেঁটে জানাচ্ছেন শিমিন মুশশারাত

নভেম্বরের একটি হিম হিম রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল, ১৯১৩ সাল। শান্তিনিকেতন। মিনার্ভা মোটর গাড়িতে চড়ে কবি যাচ্ছেন চৌপাহাড়ি বনের দিকে। সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ও দুজন বিদেশি অতিথি। উদ্দেশ্য বীরভূমের বিখ্যাত শাল, পিয়ালগাছ দেখা। পোস্ট অফিস পেরিয়ে যাওয়ার সময় এক লোক দৌড়ে এসে হাতের টেলিগ্রামটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কর্তা, আপনার জন্য!’ পরে পড়বেন ভেবে কবি টেলিগ্রামটা জোব্বার পকেটে রাখলেন। লোকটা তখন বলল, বার্তাটা ভীষণ জরুরি, লন্ডন থেকে এসেছে জোড়াসাঁকোতে। সেখান থেকে কবির জামাতা নগেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন। সঙ্গীদের কৌতূহল মেটাতে খাম ছিঁড়ে কাগজটা বের করলেন তিনি। তাতে লেখা, ‘সুইডিশ একাডেমি আপনাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে।’ লেখাটা তিনবার পড়লেন কবি, তবু ভ্রম বলে সন্দেহ হতে লাগল। তিনি জানতেন, বন্ধু টমাস মুর সুইডিশ একাডেমিতে গীতাঞ্জলি পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সত্যিই নোবেল পুরস্কার পাবেন তা কল্পনাতেও আসেনি। ফলে লেখাটায় আবারও চোখ বুলিয়ে এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টেলিগ্রামটি ছেলের হাতে দিলেন।

বাড়ি ফিরতেই রবিবাবুকে স্বাগত জানালেন বহু ছাত্র-শিক্ষক। চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম আর ভিড়ভাট্টায় কেটে গেল তিন দিন। এরপর দম ফেলার ফুরসত মিলতেই বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখলেন কবি।

সুইডিশ একাডেমি এই প্রথমবার পশ্চিমা কবি-সাহিত্যিক গণ্ডির বাইরে এসে রবিঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল। তাতে পশ্চিমাদের মধ্যে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা গিয়েছিল। এমনটা ঘটেছিল দ্য গুড আর্থ–এর লেখক পার্ল এস বাকের নোবেল পাওয়ায়। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, ‘তিনি (বাক) নোবেল পেলে যে কেউ পেতে পারে।’ যদিও পার্ল এস বাক ছেচল্লিশ বছর চীনে ছিলেন, তবু চীনের বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁর পুরস্কারটি পাওয়া নিয়ে অসন্তোষ জন্মেছিল। কারণ, তিনি শ্বেতাঙ্গ। চীনের জীবনযাপন ও মানুষকে নিয়ে লেখার জন্য একজন ‘বহিরাগত’ লেখক পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার পেলেন, এটা তাঁরা ঠিক মেনে নিতে পারেননি। তবে পার্ল এস বাকের বই পড়ে পরবর্তীকালে অনেক পশ্চিমা পাঠকের মনে চীনের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি জন্মেছে।

জন স্টাইনব্যাক, অফ মাইজ অ্যান্ড ম্যান–এর লেখক নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়েছিল বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে লেখা উপন্যাসের জন্য, বলা হয়েছিল, লেখকের সরস লেখায় সমাজ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। তবে তাঁর নোবেল পাওয়া নিয়ে একটি সুইডিশ পত্রিকা লেখে, সেবার কোনো উপযুক্ত প্রার্থী না থাকায়, মন্দের ভালো হিসেবে নোবেল দেওয়া হয়েছে স্টাইনব্যাককে। এমনকি তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি নিজেকে নোবেল পাওয়ার উপযোগী ভাবেন কি না, তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে তিনি তা মনে করেন না।

এবার আসা যাক যাঁদের নোবেল পাওয়ায় পাঠক-সমালোচক-বুদ্ধিজীবী সবাই আনন্দিত হয়েছেন, এমন একজন সাহিত্যিকের কথায়। কলম্বিয়ান লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে পুরস্কারটি দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর একজন রিপোর্টারকে বলেন, তাঁর বিশ্বাস, সুইডিশ একাডেমি তাঁকে পুরস্কারটি দিয়ে শুধু তাঁকে নয়, সমগ্র লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি সম্মানজ্ঞাপন করেছে। ঠিক এ রকমভাবে চেক প্রজাতন্ত্রে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট। সাইফার্ট যখন পুরস্কারটি পান, তাঁর বয়স তখন ৮৩ বছর। তিনি সংবাদটি পান হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। সুইডিশ রাষ্ট্রদূত পরে জানান, নোবেল পাওয়ার খবর জেনে কবি দারুণ আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে তাঁর স্ত্রী মারিয়া অতটা খুশি হননি। এক সাক্ষাৎকারে মারিয়া জানান, কবি সুস্থ থাকলে তিনি এর চেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন। নিজের দেশে গভীরভাবে সমাদৃত সাইফার্ট চেকোস্লোভাকিয়ার বাইরে তেমন পরিচিত ছিলেন না। প্রধান কারণ ভাষার ব্যবধান। তবে পরবর্তী সময়ে তাঁর অনেক কবিতা অনূদিত হয়েছে এবং প্রায় ৩০ খণ্ডের কাব্যসমগ্র প্রকাশ হয়েছে।

ইয়োসিফ আলেক্সান্দ্রভিচ ব্রডস্কি একটি চীনা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, সঙ্গে ছিলেন জন লে ক্যারে। তখন এক বন্ধু হুট করে এসে জানান, নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রডস্কি। প্রথমেই তিনি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নেন খবরটি সঠিক কি না। তারপর একটি হুইস্কি নিয়ে পিয়ানোবাদক আলফ্রেড ব্রেনডেলের বাড়ি যান। একান–ওকান হাসি নিয়ে উত্তেজিতভাবে তিনি বলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল রাশিয়ান ও আমেরিকান—দুটো পরিচয়েই তিনি পুরস্কারটি পেয়েছেন। কারণ, রুশ সাহিত্যের লেখক হলেও তিনি আমেরিকার নাগরিক। একজন সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, পুরস্কারের ৩৪০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে তিনি কী করবেন? উত্তরে ব্রডস্কি বলেন, ‘খরচ করব।’

টনি মরিসনের বন্ধু রুথ সিমনস সকাল সাতটায় মরিসনকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। রুথের কথা বিশ্বাস না করে তিনি ফোন রেখে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফোন করেন রুথ। মরিসন জিজ্ঞেস করেন, তিনি এ খবর কোথায় শুনলেন। রুথ উত্তর দিলেন, ‘দ্য টুডে শো’–এর ব্রায়ান্ট গামবেল এর কাছে! এবার টনি মরিসন ভাবলেন, সত্যিই?

নোবেল পাওয়ার খবরে এমন অবাক হয়েছিলেন নেভার লেট মি গোর লেখক কাজুও ইশিগুরো। লন্ডনে তাঁর প্রকাশকের অফিসে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি যদি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতাম যে এমন কিছু ঘটতে পারে, তাহলে সকালে অন্তত চুল ধুয়ে বের হতাম।’

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ। দক্ষিণ–পূর্ব ইংল্যান্ডে তাঁর বাড়ির রান্নাঘরে বসে গুরনাহ সুইডিশ একাডেমি থেকে ফোন পান। সংবাদটি পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হন তিনি। বলেন, এত বড় একটা উপহার আর এত অসাধারণ লেখকদের তালিকা থেকে তাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছে, বিষয়টি এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না!

সূত্র: স্ক্রল ডটইন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, এপি নিউজ ডটকম, মিফোরাম ডট ওআরজি, ইন্টারভিউ ম্যাগাজিন ডটকম, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, আল–জাজিরা ডটকম