‘আজ আমরা নয়, দেশে ফিরতে পারত আমাদের মৃতদেহ।’ ভয়ংকর এই কথাটা নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ফেরার বিমানে উঠতে উঠতে বলেছিলেন তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। এ কথার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলের নির্মম অভিজ্ঞতা। একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে ঢুকে ধর্ম ও বর্ণের দোহাই দিয়ে হত্যা করে ৫১ জন নিরীহ মানুষকে। মিনিট পাঁচেক এদিক–সেদিক হলে সেদিন এ হামলায় শেষ হয়ে যেতে পারত বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল, যাঁরা সেই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যাচ্ছিলেন। ঘটনা থেকে বাঁচার পরিপ্রেক্ষিতেই তামিমের ওই উক্তিটি। দেশে বসে আমরা যখন তাঁদের এই অভিজ্ঞতার কথা টিভি কিংবা অনলাইন স্ট্রিমিং করে জানছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল দুর্ধর্ষ কোনো থ্রিলার চলচ্চিত্র চলছে।
তিনজন সাংবাদিক বাস্তবে ঘটা এই থ্রিলার দেখেছেন একেবারে সামনে থেকে। তাঁদেরই একজন উৎপল শুভ্র। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক তিনি। ওই সফর কাভার করার জন্য বাংলাদেশের দলের সঙ্গে ওই সময় ছিলেন নিউজিল্যান্ডে। তাঁর লেখা নিউজিল্যান্ড: দুঃস্বপ্নের আগে ও পরে নামের বইটিতে সেই অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা তুলে এনেছেন তিনি। একই সঙ্গে ঘটনাটি খেলোয়াড়দের কীভাবে নাড়া দিয়ে গেছে, লিখেছেন তা-ও। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে উৎপল শুভ্র কেবল নিউজিল্যান্ডে ঘটে যাওয়া সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনাই দেননি, ঘটনার আগে ও পরে তাঁর দেখা নিউজিল্যান্ডের একটি পাঠও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আমাদের। মাত্র কয়েক মুহূর্তের একটি ঘটনা কীভাবে নিউজিল্যান্ড নামের দেশ এবং তার সম্পর্কে যাবতীয় ধারণাকে বদলে দিয়েছে, তার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা উঠে এসেছে বইটিতে।
একদল ক্রিকেটার, যাঁরা একটি দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই দলটি আকস্মিক এক ধাক্কায় কী আতঙ্ক ও অসহায়ত্বের ভেতরে পড়েছেন, বর্ণিত হয়েছে তার পুরোটাই। যেমন, এখানে তামিমকে তাঁর ছেলেকে ফোনে বলতে শোনা যায়, ‘জানো আরেকটু হলে বাবা আর থাকত না।’ কতটা অসহায় হলে একজন বাবার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে এমন আর্তনাদের স্বর? বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’ কিংবা ‘ওয়াল’ হিসেবে বিবেচিত মুশফিকের কান্নার সেই বর্ণনা ছুঁয়ে গেছে আমাদেরও। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে কয়েক মিনিট বেশি না লাগলে কিংবা গাড়িতে ওঠার আগে ড্রেসিংরুমের সেই মিনিট দুয়েকের ফুটবল খেলাটা না হলে গোটা ঘটনাটার চেহারা অন্য রকম হয়ে যেতে পারত হয়তো, এটুকু লিখতে লিখতে কেমন যেন আঁতকে উঠতে হয়। যা লিখছি তা আসলেই ঘটেছিল তো?
বইটি পড়তে পড়তেও বেশ কয়েকবার মনে জেগেছে এই প্রশ্ন। আসলেই এই সব ঘটনা ঘটেছিল, নাকি কোনো দুঃস্বপ্নের বর্ণনা? যেমনটা বইয়ের শুরুতে বলছিলেন উৎপল শুভ্র। এই সফরের শুরু থেকেই কোনোকিছু ঠিকভাবে এগোচ্ছিল না তাঁর। টস দেখাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলা লেখক অসুস্থতার জন্য টস দেখতে পারলেন না। এমনকি অসুস্থতার মধ্যে দেখতে লাগলেন উদ্ভট সব দুঃস্বপ্ন। ব্যাপারটা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, লেখক একপর্যায়ে নিজের মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে শুরু করেছিলেন। এ যেন শেষে যে গা ছমছমে থ্রিলার অপেক্ষা করছে তারই একটা আভাস। কিন্তু মানুষের তো সাধ্য নেই অমন বীভৎস ঘটনার আগাম ধারণা পাওয়ার। তার ক্ষমতা খুবই সামান্য। ফলে লেখক যখন লেখেন ‘নিউজিল্যান্ডকে প্রকৃতি দুহাত ভরে দিয়েছে। প্রতিটি শহরই তার মতো করে সুন্দর।’ তাঁকেই পরে আবার লিখতে হয়, ‘আমি হারিয়ে যাওয়া সেই নিউজিল্যান্ডের জন্য কাঁদছি।’
পুরো বইটি নিউজিল্যান্ডের সেই ঘটনাকে ধরেই এগিয়েছে। তবে লেখক যেহেতু ক্রীড়া সাংবাদিক, তাই এর পরতে পরতে রয়েছে ক্রিকেট। ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই তো লেখক লাভ করেছেন এই কিউই দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে যেমন রবার্ট বার্নসের মূর্তি এবং ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য রকম নবীনবরণ দেখার সৌভাগ্য দিয়েছে, তেমনি আবার দেখিয়েছে মুদ্রার উল্টোপিঠও, যেখানে আছে কেবল রক্ত ও হিংসা। আর আছে মানুষের ভয়ার্ত অসহায় মুখ।
সেই মুখগুলোর কথা পড়তে পড়তে, এই বইটি পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আপনিও কাঁদবেন, যেমন কেঁদেছি আমরা। এই বইটিকে তাই বলতে পারি নিউজিল্যান্ডের জন্য কান্নার দলিল। উৎপল শুভ্রকে ধন্যবাদ সত্য ঘটনার ওপর এমন মর্মস্পর্শী একটি পুস্তক রচনার জন্য।