প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষের জীবন নিয়ে অনেকের অনেক কৌতূহল। তিনি নাকি বাসায় থাকেন না, বাসায় গেলেও তাঁকে পাওয়া যায় না। আজ তাঁর জন্মদিনে এ লেখায় থাকল অন্য এক ধ্রুব এষের অবয়ব।
তাঁর সদর দরজায় লেখা থাকে ‘পাখি উড়ে গেছে!’ নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ একসময় একটি লেখায় ধ্রুব এষ সম্পর্কে লিখেছিলেন এ কথা। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষকে নিয়ে অনেক কথা চালু আছে বাজারে। যেমন তাঁকে কোথাও পাওয়া যায় না, তিনি কোথাও যান না, এমনকি নিজের বাড়িতে সব সময় তালা লাগিয়ে রাখেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে ধ্রুব এষ—বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠায় যাঁর নাম দেখে দেখে চিনেছিলাম তাঁকে—তিনি কি অসামাজিক?
দীর্ঘদিন ধরে আমার মনে এ ধারণা ছিল যে ধ্রুব এষ বলে আসলে কেউ নেই, যেহেতু কোথাও তাঁকে পাওয়া যায় না।
আবার পাওয়া যে যায় না, তাই–বা বলি কেমন করে! বছর বছর তাঁর প্রচ্ছদে এত যে বই বের হয়, যিনি এত সব মনোরম প্রচ্ছদের জনক, তিনি না–মানুষ হবেন, এটা মানতেও মন সায় দেয় না।
কিন্তু ধ্রুব এষ—যাঁর নাম আমরা বইয়ের প্রচ্ছদে হামেশাই দেখি—ওই ব্যক্তির নাম কি আসলেই ধ্রুব এষ, নাকি এটা ছদ্মনাম? লেখক–শিল্পীরা তো ছদ্মনাম পছন্দ করেন। আমার মনের মধ্যে শিল্পী ধ্রুব এষকে নিয়ে অনেক কালই এসব দোলাচল ছিল।
তবে বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পে তিনি যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, সে বিষয়ে অনেক আগ থেকেই নিঃসংশয় ছিল আমার মন। তাঁর প্রচ্ছদের এমনই ট্রেডমার্ক আছে যে বইতে ধ্রুব এষের নাম না থাকলেও এটা যে তাঁর প্রচ্ছদ, তা ঠিকই চেনা যায়।
কম্পিউটার ব্যবহার করে, কেবল আলোকচিত্র ব্যবহার করে, আবার কখনো কেবল রং ছিটিয়ে যে অভাবিত সব প্রচ্ছদ করা যায়, গত তিন দশকে সেটা অনেকবারই প্রমাণ করেছেন ধ্রুব এষ। কতটা প্রচ্ছদ তিনি করেছেন এ পর্যন্ত?
সুনির্দিষ্টভাবে সেসবের তো লেখাজোকা নেই। তবে কথা প্রসঙ্গে ধ্রুব এষ জানালেন, ২০ হাজারের মতো প্রচ্ছদ তিনি করেছেন।
ধ্রুব এষের প্রচ্ছদের প্রতি আমার যেমন আকর্ষণ ছিল, তেমনি তাঁর প্রতিও আকর্ষণ কম ছিল না। সেই গত শতকের শেষাশেষি বা ২০০০ সালের শুরুতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তিনি লেখেনও। এ সময় একনাগাড়ে তাঁর কিছু লেখা পড়ে ফেললাম—ছড়া, কিশোর কবিতা ও উপন্যাস। একটা উপন্যাসের কথা তো এখনো মনে পড়ে, ‘জল–ঘাসের ঘটনা’। একটা মফস্বল শহরের দৈনন্দিন জীবনকে এত অপূর্ব ভাষায় এঁকেছেন তিনি এখানে!
এরপর থেকে তাঁর অনেক লেখাই পড়েছি। কোনোটা বেশি ভালো লেগেছে, কোনোটা কম ভালো। খারাপ কোনোটাই লাগেনি। তবে ব্যক্তি ধ্রুব এষের প্রতি ভালো লাগার পারদটা বরাবরই ছিল উর্ধ্বমুখী।
কেন?
এককথায় যদি উত্তর দিতে হয় তো বলা যাবে, ধ্রুব এষ এই ঢাকা শহরে এখনো গুপ্ত জীবন যাপন করেন বলে, করতে পারেন বলে। এই জটিল মেট্রোপলিটন নগরে এখনো তিনি আশ্চর্যরকম সরল জীবন অতিবাহিত করতে পারেন বলে।
তবে ধ্রুবদার প্রতি ভালো লাগার শুধু কি এই এটিই কারণ?
অবশ্যই নয়, আরও এক শটা কারণের কথা একনাগাড়ে লেখা যাবে। সেসব আর না লিখি, কেবল লিখে রাখি এই কথাটুকু: ধ্রুব এষ খুব ভালো পাঠক। প্রচুর পড়েন। এবং কোনো একজনের লেখা পড়ে ভালো লাগলে ওই লেখককে ফোন করে সেটি জানাতেও কসুর করেন না।
আজকের এই সময়ে, যখন সর্বদাই লাভ–ক্ষতির হিসাব নিয়ে মত্ত আমরা, সেই সময়ে এমন মানুষকে ভালো না বেসে কারও কি উপায় থাকে!
ধ্রুবদাকে আমিও সেইভাবে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি।
প্রথম যেবার গিয়েছিলাম তাঁর সেই পুরানা পল্টনের বাড়িতে, বহু অলিগলি ঘুরে যেতে হয়েছিল, মনে আছে। সে সময়, সেই যাত্রাপথে একটি কথা উঁকি দিয়েছিল মনে—ধ্রুব এষ কোথায় থাকেন?
পাঠক, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, এর মধ্যেই ধ্রুব এষকে ‘ধ্রুবদা’ বলে সম্বোধন করে ফেলেছি আমি! আমার মতো অনেকের কাছেই তাঁর একটিই পরিচয়—ধ্রুবদা।
তাঁকে নিয়ে কথা পাড়তে গিয়ে অনেক কিছুই তো মনে আসছে। অনেক বছর আগে, প্রথম যেবার গিয়েছিলাম সেই পুরানা পল্টনের বাড়িতে, বহু অলিগলি ঘুরে যেতে হয়েছিল, মনে আছে। সে সময়, সেই যাত্রাপথে একটি কথা উঁকি দিয়েছিল মনে—ধ্রুব এষ কোথায় থাকেন?
বিকেল–সন্ধ্যার গোধূলি মিইয়ে গেলে আমরা ধ্রুব এষের বাসায় গেলাম। পুরোনো একটি বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দরজা খুলে দিলেন ধ্রুব এষই। তখন প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখে আমার যা মনে হয়েছিল, ও মা, এই নাকি ধ্রুব এষ, এ তো হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে পড়া সেই মিসির আলি!
দরজা খোলার পর ধ্রুবদার ঘরের মধ্যে ঢোকা গেল। টিমটিমে আলো জ্বলছে ঘরে। তো সেই ঘরকে পাশ কাটিয়ে আমরা উঠে গেলাম একটু ওপরে, পুরোনো বাড়িতে যেমন এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি থাকে, তেমন সিঁড়ি ভেঙে বিশালাকার এক ছাদে। শুনেছি, সন্ধ্যার পর এই ছাদেই ধ্রুব এষের আড্ডা জমে ওঠে। কেবল নির্বাচিত কিছু লোকজনই অংশ নেন ওই আড্ডায়। এবং আড্ডাটি এমনই জমাট হয় যে স্বয়ং সন্ধ্যাও জমে যায়। সেদিন গিয়েও সে কথার প্রমাণ মিলল। দেখলাম একটা আস্ত সন্ধ্যা ধোঁয়াশা হয়ে কীভাবে রাতের কোলে ঢলে পড়ছে! তো সেই আলো–অন্ধকারে আমার কেবল মনে হলো, এটা কি ধ্রুব এষ? তাঁর চেহারা আর কথাবার্তার মধ্যেই তো রয়েছে মিসির আলির মতো রহস্য। এ ছাড়া ধীর লয়ে নাকি সুরে তিনি যেমন করে কথা বলেন, তাতে মিসির আলির মতো যুক্তিও কি নেই? আছে তো। তাই সামনাসামনি দেখার শুরুতে এই মানুষটাকে আমার মিসির আলিই মনে হলো।
পরে আরও কয়েকবার ধ্রুবদার তল্লাটে (পড়ুন: বাসায়) যাওয়া হয়েছে। এবং প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, আমি বসে আছি মিসির আলির সামনে।
আজ ১৭ জানুয়ারি ‘মিসির আলিরূপী’ সেই ধ্রুব এষের জন্মদিন। সকালে উঠেই ফোন মারফত প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম তাঁকে, আজ কততম দাদা?
ধ্রুবদা বললেন, ‘৫৬ বছর হলো। শোনো, এখনই আমি বাসা থেকে পালাব। সবাই ফোন করা শুরু করেছে। কেউ কেউ বাড়িতেও চলে আসতে পারে, তাই এখন আমি পালাব।’
এই ঢাকায় ধ্রুব এষকে পছন্দ করেন, এমন কিছু মানুষ তো আছেনই। তাঁরা জন্মদিনে শিল্পীর কাছে আসতে চাইবেন, এ তো স্বাভাবিকই। কিন্তু জনমানুষ থেকে যিনি নিজেই পালাতে চান, তাঁকে খুঁজে পায় সাধ্য কার।
ধ্রুব এষ এমনই। নিজেকে গুপ্ত করে রাখতে চান সব সময়। বাসায় থেকেও কোনো কোনো সময় ফোন বন্ধ করে গুপ্ত হয়ে থাকেন। তখন সচরাচর কেউ পায় না তাঁকে।
: আপনি গোপনে থাকতে ভালোবাসেন বলেই কি হুমায়ূন আহমেদ আপনার সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ধ্রুব এষের বাসার দরজায় লেখা থাকে, পাখি উড়ে গেছে!
: স্যার এটা এমনিই লিখেছিলেন। আমার বাসায় এমন কিছু লেখা থাকে না।—বললেন ধ্রুব এষ।
তাঁর উত্তরে পর পরের প্রশ্নটিও এসে গেল ঠোঁটের আগায়, আপনাকে নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, ঘরের ভেতরে থাকলেও আপনি নাকি সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখেন?
: না, এখন এমন করি না। এটা করতাম অনেক আগে। তখন আমরা এলিফ্যান্ট রোডে থাকতাম—আমি, ইমতিয়ার শামীম আর শওকত আলী তারা। তো যে বাসায় থাকতাম, সেখানে ঢোকার দুটো পথ ছিল—বইরে দিয়ে ঢোকা যেত এবং ভেতর দিয়ে আরেকটা পথ ছিল, সেটা দিয়েও ঢোকা যেত। তাই মাঝেমধ্যেই আমরা বাইরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখতাম। এ ঘটনা থেকেই এসব ছড়িয়েছে।
এসব কারণেই হয়তো ধ্রুব এষের জীবনযাপন নিয়ে অনেকের কৌতূহল রয়েছে।
সুনামগঞ্জের উকিলপাড়ার ভূপতি এষের বড় ছেলে ধ্রুব এষ ১৯৮৫ সালে তখনকার ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের (এখন চারুকলা অনুষদ) ছাপচিত্র বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু কেন এখানে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন, শিল্পী হওয়ার আশায়, তাই না? এমনই তো হওয়া উচিত।
চমকপ্রদ বিষয় হলো, ধ্রুব এষ সেভাবে শিল্পী হতে চাননি। তিনি যা হতে চেয়েছিলেন তা হলো—প্রচ্ছদশিল্পী। তাঁর কথায়, ‘আমি প্রচ্ছদশিল্পীই হতে চেয়েছি। আমি একজন চূড়ান্ত ভালো পাঠক। এ থেকেই প্রচ্ছদশিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। প্রচ্ছদশিল্পী হওয়ার জন্যই আমি সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলাম।’
: আপনার বাবা কি চেয়েছিলেন আপনি ঢাকা চারুকলায় ভর্তি হন?
: না, বাবা চাননি। কারণ, তিনি জানতেন আমি ঢাকায় গেলে তিনি আমাকে হারিয়ে ফেলবেন। হয়েছিলও তাই।
চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ধ্রুব এষ। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তাঁর আইডল ছিলেন আফজাল হোসেন—কথায় কথায় এটা তিনি নিজেই স্বীকার করেন। আর বলেন নিজের জীবনের রংবেরঙের কথা। এবং সেই সব কথার মধ্য থেকে আমরা আবিষ্কার করি এক গুপ্ত ধ্রুব এষের মুখ, যাঁকে আমার বারবার মিসির আলি মনে হয়।
ধ্রুব এষের ছড়ানো–ছিটানো জীবন, ঘর–দরজা, বিছানাপত্র দেখে আপনারও মিসির আলির কথা মনে হতে পারে। তবে যদি সেটি না হয়, তার জন্য আমাকে দায়ী করবেন না নিশ্চয়!