>২৪ এপ্রিল ছিল কবি বেলাল চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে আয়োজন
বেলাল চৌধুরীর (১২ নভেম্বর ১৯৩৮–২৪ এপ্রিল ২০১৮) কবিতায় অন্তর্চাপের প্রাবল্য দৃশ্যমান। বাইরের উপর্যুপরি আঘাতে কবি নিজেকে গুটিয়ে নেন ভেতরমহলে। রক্তাক্ত হন প্রতিমুহূর্তে। এই পীড়ন আবার নির্মাণ করে অন্য মাত্রার সৌন্দর্য, জীবনের জটিলতা তাঁর কবিতায় ঝিল্লিমন্ত্রের পোশাক পরে। প্রিয়বিরহে ঝড় ওঠে বুকজুড়ে আর চারপাশে জ্বলে আগুনের শীতল শিখা। দাউ দাউ না হয়ে কোমলতার মধ্যেই সে আগুন তার গন্তব্য খোঁজে। রুপালি রণরোলে চাপা পড়ে হরিৎ আর্তি কারও। আর কেউ ডুবে থাকে কেতকী-কুসুমে। কেউ শোনে রাতের রোদন আর পাথরের বুকজুড়ে বাড়ে নক্ষত্রতৃষ্ণা। আয়নার সঙ্গে বেড়ে চলে মানুষের বাদবিসংবাদ। ঢাকার গলি-ঘুপচি, কলকাতার রাজরাস্তা, কোনারকের সুন্দরী কিংবা চিম্বুক পাহাড়ের চূড়া থেকে কবি উদ্ধার করে আনেন ধাতব শৈবাল, তামালাল চাঁদ। তাঁকে ফুল দেখার মাশুল দিতে হয় ভুল দেখে। তবে নীল কুয়াশায় দেহ ঢাকা পড়েছে বলে প্রতিনায়ক যতই স্বগতোক্তি করুক, শেষ পর্যন্ত তাঁর যাত্রা জরিপাড় মেঘের জমিন।
ষাট দশকের এই কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে নিষাদ প্রদেশে (১৯৬৪); বেলাল চৌধুরীর কবিতা (১৯৬৮); আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ (১৯৭৫); যুগলবন্দী—ভালোবাসার কবিতা (১৯৮২); স্বপ্নবন্দী (১৯৮৪); সেলাই করা ছায়া (১৯৮৫); জলবিষুবের পূর্ণিমা (১৯৮৫); প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি (১৯৮৬); কবিতার কমলবনে (১৯৯২); যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে (১৯৯৭); বত্রিশ নম্বর (১৯৯৭); ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭); প্রাণ কোকিলা (১৯৯৮); যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে (২০০৮); বিদায়ী চুমুক (২০১০); মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (২০১১)।
এসব বইয়ে তিনি বিচিত্রবিহারী। তাঁর কবিতা যেন অন্তর্বাস্তব এবং বহির্বাস্তবের সন্ধিস্মারক। কনফেশনাল কবিদের মতোই স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে তিনি উদ্যাপন করেন পরিপার্শ্ব:
যত মনে হয় তা নয় এই বিশ্ব,
প্রেম ও শান্তির হাসির
পেছনে
চিৎকারে বিশ্ব নিচ্ছে বাঁক
মানুষের চর্বির উপর নাচে শবদেহ;
যা মনে হয় তা’ নয় এই বিশ্ব
দিন ও রাত্রির ঘড়ির পেছনে
ক্ষরিত হচ্ছে স্বপ্নের সময়হীনতা
যেখানে চন্দ্র-সূর্য কোনো আলো পাঠায় না।
প্রয়োজন মেটে না এই বিশ্বের,
খাদ্য ও পানীয়ের স্বাস্থ্যের পেছনে
চোখ মারে নেংটি পরা নরখাদক;
ঢেঁকুর তোলে শর্ষে, গ্যাস ও দস্তার।
প্রয়োজন মেটে না এই বিশ্বের,
কোট এবং আলখাল্লার পেছনে
কেঁপে ওঠে আগাছার মহাদেশ;
যেখানে ভূতের সঙ্গে সঙ্গমরত অপচ্ছায়া।
(‘হিচককের চোখ দিয়ে দেখা’)
হিচককের চোখে যে ভ্রমণে আমাদের নিয়ে যান কবি, তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সমকালীন পৃথিবীরই প্রতিরূপ। এমনটি তাঁর কবিতাভুবনের আরও নানা জায়গায়ই খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে বিশেষভাবে ‘ঘুম পাড়ানি ছড়া’ কবিতাটির কথা বলতেই হবে, যার শিরোভাগে উৎকলিত আছে ১৯৬৮ সালের ফরাসি ছাত্র বিপ্লবের দেয়াললিপির অংশবিশেষ R‘The more I make, Revolution, the more I want to make love’—It is forbidden to forbid.’ আর কবিতার শেষভাগে লেখা হয়েছে: ‘এই কবিতাটি ঢোল, মৃদঙ্গ, খোল-করতাল, খঞ্জনি ও একতারা সহযোগে পঠিতব্য।’ এবার দেখা যাক মূল কবিতাটির অংশবিশেষ:
‘কাকাতুয়া, বুলবুলি...উম উম হুঁম হুঁম উম উম বক বকম...বক বকম-বকম
বকম পায়রা...কোকিল ডাকে কুঁ...কুঁ...ফিঙে পাখি পুচ্ছ দোলায়...রকম
রকম রঙের মেল...লাল ল্লা লালা ল্লা ওঁম মণি পদ্যে হুম...হুম...হুম...হুমো
পাখি ঈঃ ঈঃ শ্ ধা্...ধপাধপ জংলী নাচ ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তি।’
হালকা চালে, ‘ওম শান্তি’র মোড়কে এখানে জাজ্জ্বল্য হয় দেশ-মহাদেশের রক্তাক্ত, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। কবিতার কাজও বোধ হয় তাই, শিল্পিত পরোক্ষতাকে শস্ত্র করে উদ্দিষ্টকে ব্যক্ত করা। তবে কবিতাকে কখনো হতে হয় একেবারে উদোম-আদিম। লাতিন আমেরিকার কর্কশ বাস্তব যেমন বাংলা কবিতায় এবং বিশ্বকবিতাতেও পরাবাস্তবের পরের ধাপ উপরন্তু নিরাবরণ, নিরাভরণ নতুন আয়তন তৈরি করেছে; তেমনি বেলাল চৌধুরীও তাঁর ‘অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে’ শীর্ষক দীর্ঘকবিতায় শকুন ও শিয়ালশাসিত সভ্যতার রিপোর্ট পেশ করেন পাঠকের দরবারে। এ কবিতায় দীর্ঘ বর্ণনার শেষে যখন দেখা যায়, কবিতাকথক ও তার সঙ্গী-সাথি সবার গন্তব্য কসাইখানা, তখন পাঠকও কাব্যিক প্রকরণের বাইরে গিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় যে এটাই তো তার স্বপ্নভুক সময়ের অনিবার্য ঘর।
বলা দরকার, সময়কে বেলাল চৌধুরী চিত্রিত করেন অনন্য মহিমায়। ফলে ‘হৃদয়ে বিষাদসিন্ধু’র মতো কবিতায় মধ্য আগস্টের শোকার্ত-নিষ্ঠুর প্রতিবেশকে স্বদেশের বিধ্বস্ত সমকাল ও কৃষ্ণ-ভবিষ্যতের সঙ্গে অন্বিত করেন কবি । বিষাদসিন্ধুর মর্সিয়া-স্বভাব আলোচ্য কবিতায় নিজের মতো করে প্রয়োগ করেন তিনি।
দশদিক উদ্ভাসিত করে আকাশ-চেরা বজ্রনিনাদের তুমুল গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে উঠল মেদিনী পলক মাত্র। কয়েক লহমার মধ্যেই আবার সূচীভেদ্য নৈঃশব্দ্য, পরমুহূর্তেই দিগি¦দিকে তখন ধ্বনিত হতে থাকল হায় হায় রব, আকাশে বাতাসে নদীর স্রোতে, রাতে মোহনার প্রান্তদেশে, গাছগাছালির নিঃশব্দ নড়াচড়ায়, পত্রপল্লবের ফিসফিসানিতে, মানুষের মর্মবিদারী বুকফাটা উচ্চারণে, নীরব অশ্রু মোচনে শুধু হায় হায় আর হায় হায়।
অস্থির-উন্মূল জীবন বেলাল চৌধুরীকে তাঁর লেখাপত্র গোছগাছ করার সুস্থিতি দেয়নি। ফলে তাঁর লেখাপত্র সবই ছিল নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সম্প্রতি জার্নিম্যান বুকস থেকে বেলাল চৌধুরীর কবিতা নামে একটি বই বের করেছি আমরা।
কবি হিসেবে বেলাল চৌধুরীর শক্তমত্তা সম্বন্ধে সেই ১৯৮৫ সালেই স্পষ্ট করে বলেছিলেন শামসুর রাহমান। এই কবির কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য ছিল, ‘বেলাল চৌধুরী কখনো খুব বেশি লেখেন না, কিন্তু যখনই লেখেন তখনই তিনি কাব্যানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি কখনো কবিতার বাঁধা সড়কে হাঁটেন না, একটু অন্যরকম লিখতে চেষ্টা করেন।’
আমৃত্যু ‘অন্যরকম’ভাবেই লিখে গেছেন বেলাল চৌধুরী। তাঁর কবিতার ব্যতিক্রমী ভূগোলে একত্রে পঙ্ক্তিবদ্ধ হয়েছে জীবন ও শিল্পের অনিবার্য সারাৎসার, যাকে দহনের শৈল্পিক লিপিকাও বলা যাবে।
প্রাণের পত্রাবলি
বেলাল চৌধুরীকে লেখা ভারতীয় লেখকদের অপ্রকাশিত চিঠি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি
বেলাল
দেবাশিস বসু একজন কবি এবং একসময় মাসিক কৃত্তিবাস-এর অফিস চালাতো, তুমি দেখলে চিনবে। ছোট্টখাট্টো চেহারা কিন্তু আসলে ধানী লঙ্কা। মালখা নগরের বসু, জীবনে কোনোদিন দেখেনি অবশ্য, তীর্থ দর্শনের মতন একবার সেখানে যেতে চায়। তুমি একটু ব্যবস্থা করে দিও।
ওর কাছে ডলার বেশি নেই। কেনাকাটির জন্য কিছু টাকা লাগতে পারে। এখানে পরিশোধযোগ্য, এমন কিছু টাকা ওখানে কি ওকে দিতে পারবে?
সবাই ভালো আছ নিশ্চয়ই
সুনীলদা
২২.৩. ৯২
সাগরময় ঘোষের চিঠি
৭ মার্চ ১৯৯৭
সবিনয় নিবেদন,
দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যার (১৪০৪) জন্য আপনার কাছে একটি কবিতা প্রার্থনা করছি। কাজের সুবিধার্থে, কবিতাটি ৩১ মে ১৯৯৭-এর মধ্যে আমাদের হাতে আসা প্রয়োজন। আশা করি আপনার সহযোগিতা পাব।
নমস্কারান্তে
সাগরময় ঘোষ
সম্পাদক
দেশ
শ্রী বেলাল চৌধুরী
বি. দ্র.: স্থান সংকুলানের জন্য কবিতাটি অনধিক পঁচিশ পঙ্ক্তির মধ্যে কাম্য।
রাতুল দেববর্মনের চিঠি
শ্রদ্ধেয় বেলালদা,
কেন যে আপনার সাহচর্য চাই বোঝাতে পারব না। সুতরাং ১১ই মার্চ পর্যন্ত বইমেলা চলবে। গাজী ভাইকে নিয়ে ১-২-৩ মার্চ যে কোনোদিন চলে আসবেন আশা রাখছি। এখানকার মানুষ আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
ত্রিপুরা দর্পণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-রাতুলের যৌথখামার নামেএকটি হাতে লেখা কবিতার বই প্রকাশ করেছে।
আগরতলায় এসে বিস্তারিত আলোচনা হবে। অবশ্যি আসবেন। নমস্কার-শুভেচ্ছা রইল।
রাতুল
২৫.০২. ০২
আগরতলা
বেলাল চৌধুরীকে লেখা ভারতীয় লেখকদের এই অপ্রকাশিত চিঠিগুলো তারিক সুজাত ও পিয়াস মজিদের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
বেলাল–বৃত্তান্ত
আজন্ম বাউন্ডুলে কবি বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে রয়েছে অজস্র গল্প। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তাঁর সমসাময়িক অনেক কবি–লেখকই তাঁদের বিভিন্ন লেখায় বেলালের জীবনের অনেক কাণ্ড, অনেক ঘটনা লিখে গেছেন। সে রকম দুটি ঘটনা।
কুমিরের ব্যবসায়ী কলকাতা শহরে
ষাটের দশকের কলকাতা শহরে যখন প্রথম কবি বেলাল চৌধুরীর আবির্ভাব, তখন পশ্চিম বাংলার সারস্বত মহলে এই বোহেমিয়ান মেজাজের কবিকে নিয়ে রটে গিয়েছিল নানা গুঞ্জন। পরে যা রীতিমতো কিংবদন্তিতে রূপ নেয়। তখন এমনও শোনা যেত, পূর্ববাংলা থেকে তিনি জাপানে গিয়েছিলেন কুমিরের ব্যবসা করতে। সে ব্যবসা নাকি ভালোই চলছিল। কিন্তু পরে একদিন সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি শেষমেশ আশ্রয় নিতে চলে আসেন কলকাতা শহরে! অবশ্য তাঁর আজীবনের সুহৃদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, জাহাজডুবি আদৌ হয়নি। কুমিরশিকারি জাহাজ কলকাতার খিদিরপুর বন্দরে থামালে বেলাল চৌধুরী নিরুদ্দেশের টানে সেখানেই নেমে পড়েন, ‘পাসপোর্টটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে’ মিশে যান কলকাতার কবির দঙ্গলে। তখন কলকাতা শহরে আড্ডাবাজ হিসেবে তাঁর এতটাই নামডাক ছিল যে এমন কথাও রটে যায়, কখন বেলাল চৌধুরী হাজির হন সে কথা ভেবে বাড়িতে ভাত রান্নার সময় দুমুঠো চাল বেশিই দেন অনেকে!
দুর্দান্ত পাঠক
তরুণ বয়স থেকেই বেলাল চৌধুরী ছিলেন রীতিমতো গ্রন্থপিপাসু। তাঁর পাঠের পরিধি ছিল ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের খবরাখবর রাখতেন নিয়মিত। সংগ্রহ করতেন বিদেশি বইও। কবিতা-কথাশিল্প বা সাহিত্যিক বিষয়ের বাইরেও ইতিহাস কি বিজ্ঞান নিয়েও পড়াশোনা করতেন। কমলকুমার মজুমদার সম্পাদিত অঙ্কভাবনা পত্রিকার জন্য গণিতবিষয়ক লেখা তিনি অনুবাদও করেছিলেন। পাবলো নেরুদার মেমোয়ার্স বা আত্মস্মৃতি গ্রন্থের কথা ঢাকার অনেক লেখক প্রথম শুনেছিলেন তাঁরই মুখে। আর কমলকুমার মজুমদারের বইপত্র যখন ঢাকায় তো বটেই, এমনকি কলকাতা শহরেও দুর্লভ, সেই সময়ে নিজের সংগ্রহ থেকে ঢাকার তরুণ লেখকদের তিনি বিলিয়ে দিয়ে পড়িয়েছেন সেসব বই।
সূত্র: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্ধেক জীবন এবং তারিক সুজাত ও পিয়াস মজিদ সম্পাদিত প্রাণের পত্রাবলি: বেলাল চৌধুরীকে লেখা দুই বাংলার কবি–লেখকদের পত্রগুচ্ছ