জন্মদিন : সৈয়দ শামসুল হক

তারে কই বড় বাজিকর

সৈয়দ শামসুল হক
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।
এ তো হক ভাইয়েরই রচিত পঙ্ক্তি, সৈয়দ শামসুল হকের। কে আছে তারও চেয়ে বড় জাদুকর, যিনি প্রাণের গভীরে রুমাল নাড়তে পারেন! আমাদের কালে আমরা পেয়েছি তেমনি এক বড় বাজিকরকে, যাঁর নাম সৈয়দ শামসুল হক। জাদুকরের আছে জাদুর কাঠি, লেখকের আছে কলম, সৈয়দ হক নামের বাজিকরের সেই কলমের মন্ত্রণায় মোহাবিষ্ট হয়ে আছি, আকৈশোর। সত্তর দশকের দিনগুলোয়, কিংবা আশিতে, রংপুর নামের শহরে, যেখানে শীতের দিনগুলো ঢেকে থাকে ঘন কুয়াশায়, বর্ষায় ভেসে যায় শ্যামাসুন্দরী খালের দু–পার, বসন্তে মঞ্জরিত আমের শাখায় ডাকে কোকিল, টিনের চালের ওপরে; বিকেলে আসা দৈনিক ইত্তেফাক-এর সঙ্গে থাকা ঈদসংখ্যাগুলোর জন্য আকুল হয়ে থাকতাম, বিচিত্রা, সন্ধানী কিংবা রোববার—সেসব এলেই উপন্যাসের সূচিতে খুঁজতাম একটি নাম—সৈয়দ শামসুল হক।

তিনি থাকলেই কেবল ওই ঈদসংখ্যা ক্রয়যোগ্য। আগ্রহান্বিত করতেন রশীদ করিম, পরের দিকে হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক পাওয়া মানে মুখ স্বাদে ভরে যাওয়া, পেট অন্নে। জলেশ্বরী নামের কল্পিত জনপদের মানুষদের সম্মিলিত চেতনাপ্রবাহ, এও এক নতুন জিনিস তখন। এর আগে আমরা জানতাম, গল্পের কথক থাকেন একজন, কিন্তু তাঁর কথাসাহিত্যে পাচ্ছি গল্প বলছে ‘আমরা’, অনেকে মিলে, জলেশ্বরীর কতিপয় মানুষ, একযোগে। জলেশ্বরী মানে কুড়িগ্রাম, তাঁর সাক্ষাৎকার পড়ে, তার ‘হৃৎকলমের টানে’ নামের সংবাদ-এ প্রকাশিত কলাম, ‘মার্জিনে মন্তব্য’ কিংবা ‘গল্পের কলকব্জা’ নামে বিচিত্রায় প্রকাশিত কলাম পড়ে সে-কথা জেনে গেছি। সেই সত্তরের দশকে, আশিতে, যখন মুক্তিযুদ্ধ একটা নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ, তাঁর কলমে উঠে আসতে থাকল জলেশ্বরীর প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের আশ্চর্য গল্পগুলো। আমাদের মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে মেঘ, মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে কুয়াশা, আমরা আনমনা হয়ে পড়ছি, আমরা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। নিষিদ্ধ লোবান থেকে অন্তর্গত! অন্তর্গতকে তিনি বললেন ‘কথাকাব্য’। চোখ ভিজে ওঠে, চোখ ভেসে যায়, মানুষের চোখ, তা কেবল দেখবার জন্য নয়, কাঁদবারও জন্য।

মনে পড়ে, আশির দশকে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে বসে মধ্যরাতে আমরা আবৃত্তি করে চলেছি সৈয়দ শামসুল হক থেকে, আমাদের বন্ধু নাট্যাভিনেতা তৌকীর আহমেদ মুখস্থ শোনাচ্ছে অন্তর্গত থেকে, শাকুর মজিদ শোনাচ্ছে পরানের গহীন ভিতর থেকে, ‘মানুষ এমন তয় একবার পাইবার পর, নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।’
তখন হয়তো কলেজে পড়ি, একদিন হাতে এসে গেল পরানের গহীন ভিতর। চমৎকার একটা ভূমিকা ছিল বইটিতে, সৈয়দ হক লিখেছেন, স্মৃতি থেকে লিখছি—‘আউলাবাউল চুল আর এলোমেলো কেশ কি চিত্তের ভেতরে অভিন্ন?’ তিনি লিখছেন, ‘গল্পের কলকব্জা’ কিংবা ‘মার্জিনে মন্তব্য’ নামের কলামে যে, একই গল্পে ক্রিয়াপদের কালের সমতা বজায় রাখতে হয়। প্রেজেন্ট ইনডিফিনিট টেন্সে বলা যায়, যেমন সে খায়, পড়ে, যায়, আমাদের মনে পড়ে, ইত্যাদি। আবার সাধারণ অতীতকাল দিয়ে বলা যায়, সে খেলো, সে পড়ল, সে গেল, আমাদের মনে পড়ল। পুরাঘটিত অতীত দিয়েও বলা যায়, সে খেয়েছিল, পড়েছিল, গিয়েছিল, আমাদের মনে পড়েছিল। চাইলে এমনকি ভবিষ্যৎ কাল দিয়েও লেখা যায় গল্প, যেমন সে যাবে, সে খাবে, আমাদের মনে পড়বে। জানালেন, বাংলা ভাষায় একমাত্র রবীন্দ্রনাথই এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন, যিনি গল্পে ক্রিয়াপদের কালের ঐক্য বজায় রেখেছিলেন প্রতিটি গল্পে। জানালেন, ভবিষ্যৎ কাল দিয়ে গল্প লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র—‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’।

হক ভাই-ই এ কথা বলেন যে সাহিত্য গুরুমুখী বিদ্যা। তাহলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। আর আমি কী করে ভুলব, ওই রংপুরেই অভিযাত্রিকের সাহিত্য সম্মেলনে গিয়েছিলেন তিনি, সৈয়দ শামসুল হক। আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম, তাঁকে বললাম, আপনি কলামে লিখেছেন, নতুন লেখকদের কর্তব্য হলো পড়া। পড়ার বাইরে আপনার কোনো উপদেশ তরুণ লেখকদের জন্য আছে কি? তিনি তার অননুকরণীয় বাকভঙ্গিতে বললেন, পড়ার বাইরে তরুণ লেখকদের জন্য আমার তিনটা উপদেশ আছে, পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে, বাংলাদেশে পড়ার মতো বই পাওয়া যায় না, তাদের আমি জিজ্ঞেস করি, কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটো পড়েছেন, কজন বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছেন?

আমি সেদিনই কলেজের বাংলার শিক্ষক মাহবুবা ম্যাডামের বাড়ি গিয়ে নিয়ে এলাম বঙ্কিম রচনাবলি, মধুসূদন কাব্যসমগ্র, সঙ্গে পেলাম মধ্যযুগের কবিতা, আলাওল রচনাবলি ইত্যাদি। ওই দিনই তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর প্রথম কবে এলেন, কীভাবে এলেন। তিনি বললেন, বাবার সঙ্গে এসেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, আমি রংপুরে প্রথম আসি একা, ট্রেনে, সন্ধ্যা নেমে আসছে পৃথিবীতে, আমি ট্রেন থেকে নামি রংপুর স্টেশনে, ভয় ভয় লাগছে, আমি তখন বালক, হঠাৎ কে যেন আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরল, তাকিয়ে দেখি, বাবা, আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে তিনি অন্য কামরায় আমাকে অনুসরণ করতে করতে এসেছেন। আমি সেদিন শিখলাম, গল্প কীভাবে বলতে হয়। সকালের গল্প সন্ধ্যায় কী করে বদলে যায়।
সেদিনই তাঁকে বললাম, আপনার সাক্ষাৎকারটি আমরা এখানেই একটা পত্রিকায় প্রকাশ করব, কীভাবে পাঠাব আপনাকে, ঠিকানা, তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে, বাড়ি নম্বর ৮, সড়ক নম্বর...., গুলশান, ঢাকা, আজও আমি সেই ঠিকানা ভুলিনি। আমার স্মৃতিশক্তি ভীষণ দুর্বল, কিন্তু এত দুর্বল নয় যে আমাদের সাহিত্যগুরুর ঠিকানা আমি ভুলে যেতে পারি।

কিংবা তাঁর বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা! আহ, কবিতার কামড়ে অস্থির যুবার জন্য এ যেন নিজেকেই খুঁজে পাওয়া, আয়নায়—
‘ক্যামুকে খাজনা দাও সম্মান সুবাদে,
আর ক্লেদজ কুসুমে ক্রমে ভরে ওঠে
ত্রৈমাসিক কবিতার পাতা কলকাতায়।
বেনোজলে বুড়িচাঁদ।’
ক্লেদজ কুসুম, বোদলেয়ারের, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে, পড়ার বইয়ের মতো মুখস্থ করে ফেলি, বাংলা একাডেমির ভাঁড়ার থেকে সস্তায় কিনে আনি আলবেয়ার কামু, আর বেনোজলে বুড়িচাঁদ? জীবনানন্দ দাশ হেফজ করতে হয় অবিরাম। তারপর প্রতিজ্ঞা করি, তাঁরই ভাষায়—
‘জন্মে জন্মে বারবার
কবি হয়ে ফিরে আসব এই বাংলায়।’
তারপর পাঠ করি তাঁর উপন্যাস স্মৃতিমেধ, নাট্যশালায় গিয়ে দেখি সে উপন্যাস অবলম্বনে রচিত ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’—যেখানে শহীদের স্ত্রী জিনাত মহল প্রশ্ন করে, ‘রাজাকারকে তোরা ক্ষমা করে দিতে পারিস, আমি স্বামী বানাতে পারি না? রাজাকারকে তোরা মন্ত্রী করতে পারিস, আমি স্বামী বানাতে পারি না?’ বুকের ভেতরে ওঠে ঝড়, হৃদয় রক্তাক্ত হয়!

মঞ্চে গিয়ে দেখি নুরলদীনের সারাজীবন—
‘যখন আমার দেশ ঢেকে যায়
দালালেরই আলখাল্লায়
নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়...
জাগো বাহে কুনঠে সবায়।’
আর যখন তাঁর রচিত ঈর্ষার নাট্যায়ন দেখি নাগরিকের প্রযোজনায়, এলোমেলো হয়ে যাই, ভেঙেচুরে যাই। পাতার পর পাতা সংলাপ, অতি অল্পসংখ্যক চরিত্র, কিন্তু পুরো মিলনায়তন শ্বাস বন্ধ করে শোনে সেই কবিতার স্তোত্র, অভিভূত হওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকে না।
এমনি করে, কবিতা দিয়ে, কথাসাহিত্য দিয়ে, কাব্যনাট্য দিয়ে, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কলাম দিয়ে একটা মানুষ হয়ে ওঠেন আমাদের কালের সবচেয়ে রংদার, সবচেয়ে উজ্জ্বল সাহিত্যগুরু, সবচেয়ে ক্ষমতাবান জাদুকর, যিনি তার অবিনাশী জাদুর কলম দিয়ে আমাদের পরানের গহিন ভিতরে নেড়ে চলেন শিল্পের রুমাল। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫-এ জন্ম যাঁর, ২০১৪-এ ৭৯ পূর্ণ করলেন, ৮০তম বর্ষে দিনযাপন এখন তাঁর, সেই সৈয়দ শামসুল হককে আমরা কী গুরুদক্ষিণা দেব, শুধু এই দীনহীন পঙ্ক্তিমালা ছাড়া!
কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই বলা যাবে, সৈয়দ শামসুল হক, আপনি আমাদের প্রণতি গ্রহণ করুন, গ্রহণ করুন অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা—আপনি দীর্ঘজীবী হোন, অক্ষয় হোক, অনিঃশেষ হোক আমাদের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ।