জসীমউদ্‌দীনের ৪৫তম প্রয়াণবার্ষিকী আজ

তাঁর কবিতা বাংলার হৃদয়ের ভাষা

জসীমউদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬)।
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

‘আমার শহরের মানুষ ছিলেন কবি জসীমউদ্‌দীন। তাঁর সাথে আমার অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে। এই দরদী মানুষটির কথা মনে হলেই আমার শহর ফরিদপুরের কথা এসে যায়। অনেককাল হলো আমি কলকাতার বাসিন্দা। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে জসীমউদ্‌দীনের ছোট্ট শহর ফরিদপুরের কথা।’

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন তাঁর প্রিয় ‘সাধুদা’ কবি জসীমউদ্‌দীনকে (১৯০৩-১৯৭৬) এভাবেই ফিরে ফিরে মনে করেছেন আত্মকথা ‘তৃতীয় ভুবন’ ও নাসির আলী মামুন সম্পাদিত ‘জসীমউদ্‌দীন’ স্মারকগ্রন্থে।

জসীমউদ্‌দীনের নাম আসতেই মৃণাল সেনের যেমন তাঁর প্রিয় ফরিদপুরের কথা স্মরণে আসে, আপামর বাঙালিও তেমনি জসীমউদ্‌দীনের কবিতাপাঠে শুনতে পান বাংলার হৃদয়ের ভাষা। ৭৩ বছরের জীবনসাধনা ও সাহিত্য সৃজনে তাম্বুলখানা ও অম্বিকাপুর পেরিয়ে তিনি প্রবেশ করেছেন বৃহৎ বাংলার মাটি ও মানুষের পরানের গহিনে। এই অঙ্গীকারের বোধ থেকেই অতি অল্প বয়সে স্বদেশি আন্দোলনে তাঁর যুক্ততা— ‘১৯২০ দশকের গোড়ার দিক। দেশে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলছে। জসীমউদ্‌দীন তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ছেলেরা স্বদেশি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।জসীমউদ্‌দীনও এ সময় স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুল ছেড়ে দেন। তিনি সোজা চলে যান অসহযোগ আন্দোলনের কেন্দ্র কলকাতায়।’(জসীমউদ্‌দীন; কুদরত-ই-হুদা; প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮)

সারা জীবন তিনি মানুষে মানুষে মিলনের গান গেয়েছেন; তাই বুঝি ১৯২১ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার নামও হয় ‘মিলন-গান’।

ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা, দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাম্যগাথা সংগ্রাহক নিযুক্ত হওয়ার চেয়ে বড় ঘটনা বোধ করি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় কালজয়ী ‘কবর’ কবিতা প্রকাশ পাওয়া। ১৯২৭ সালে প্রথম বই ‘রাখালী’ প্রকাশিত হওয়ার দুবছর আগে ১৯২৫ সালে বিএ ক্লাসের ছাত্র জসীমউদ্‌দীনের এ কবিতা প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

‘রাখালী’-এর পর একে একে তাঁর বিচিত্র-অনন্য সৃষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম—

কবিতার বই: ‘নকসী কাঁথার মাঠ’, ‘বালুচর’, ‘ধানক্ষেত’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘রূপবতী’, ‘মাটির কান্না’, ‘সকিনা’, ‘সূচয়নী’, ‘মা যে জননী কান্দে’, ‘হলুদ বরণী’, ‘জলের লেখন’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’, ‘কাফনের মিছিল’।

শিশু-কিশোরসাহিত্য: ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘ডালিম কুমার’;
নাটক: ‘পদ্মাপার’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘পল্লীবধূ’, ‘গ্রামের মায়া’, ‘ওগো পুষ্প ধনু’, ‘আসমান সিংহ’।

উপন্যাস: ‘বোবা কাহিনী’, ‘বউ টুবানীর ফুল’; স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী: ‘যাঁদের দেখেছি’, ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’, ‘স্মৃতির পট’, ‘জীবনকথা’।

ভ্রমণকাহিনি: ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরীর দেশে’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’, ‘জার্মানির শহরে-বন্দরে’; গানের সংকলন: ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, ‘গাঙের পাড়’, ‘জারী গান’, ‘মুর্শিদী গান’; ফোকলোর: ‘বাঙালীর হাসির গল্প ২ খণ্ড’।

কবিজীবনের উষাকালেই রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ—‘জসীমউদ্‌দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ আর স্কুলপড়ুয়া জসীমের কবিতা পড়ে নজরুল চিঠি লিখে বলেছিলেন—‘ভাই শিশুকবি, তোমার কবিতা পেয়ে সুখী হলুম।’

জসীমউদ্‌দীন প্রায় শত বছর আগে লেখা তাঁর অমর ‘কবর’ কবিতায় বলেছিলেন—‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিমগাছের তলে/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’

‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯)-এর ভূমিকা লিখেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ই এম মিলফোর্ড এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আর দীনেশচন্দ্র সেন এক লিখিত আলোচনায় এই মহত্তম, জনপ্রিয় কাহিনিকাব্য সম্পর্কে সংগতই বলেন, ‘“নক্সী কাঁথার মাঠ”-এ এমন অনেক কথা আছে, যাহা বাঙ্গালার আর কোনো কবি এভাবে লিখিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ। “নকসী কাঁথার মাঠ”-এর কবি দেশের পুরাতন রত্ন-ভান্ডারকে নূতনভাবে উজ্জ্বল করিয়াছেন, সঙ্গে সঙ্গে অনাগত রাজ্যের বার্তা বহিয়া আনিয়াছেন।’

জসীমউদ্‌দীন তাঁর কবিতা, কথাসাহিত্য, নাট্যরচনা, শিশু-কিশোরসাহিত্য, গীতি সংগ্রহ—সর্বত্রই লোকবাংলার আত্মাকে বাঙ্ময় করেছেন। পল্লি তাঁর সৃষ্টির প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে। কিন্তু তাই বলে ‘পল্লীকবি’র খণ্ডিত বিশেষণ তাঁর প্রাপ্য নয়। তিনি আবহমান বাংলার গীত স্বভাবকে তাঁর সাহিত্যের রূপরীতিতে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখা ‘নদীর কূল নাই কিনার নাইরে’, ‘আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না’ কিংবা ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা’র মতো গান গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন, শচীন দেববর্মনের মতো সংগীতগুণী। বাংলার পথেপ্রান্তরে, নদী ও জনপদে ঘুরে বেড়িয়ে যেমন আসমানীদের দুঃখকথাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তেমনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শাণিত-কণ্ঠে রুখেও দাঁড়িয়েছেন। তাই ১৯৬৭ সালে রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের পাকিস্তানি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ষাটের দশকজুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন এক সংগ্রামী কবিকণ্ঠ। বাংলার নিরীহ মানুষের সঙ্গে এখানকার সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলোও পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার স্বীকার হয়েছে। তারই একটি হলো সাভারের ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথ। জসীমউদ্‌দীন তাঁর ‘ধামরাই রথ’ নামের কবিতায় ধরে রাখলেন অনির্বাণ একাত্তরকে—
‘পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ,/
এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ/
শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে,/
একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।’

‘তুজম্বর আলি’ ছদ্মনামে মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা তাঁর কবিতাগুচ্ছ সংকলিত আছে ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলি’ বইয়ে।

জসীমউদ্‌দীন প্রায় শত বছর আগে লেখা তাঁর অমর ‘কবর’ কবিতায় বলেছিলেন—
‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিমগাছের তলে/
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’

আর আমরা বলি, কবরের কোটর থেকে যিনি আমাদের জয়ী জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেন, সেই কবি চির-অম্লান; জসীমউদ্‌দীন তাঁর নাম।