তাঁরা লিখতেন, ছবিও আঁকতেন

ফেলুদার কথা উঠলেই মানসচোখে ভাসে চোয়াল শক্ত এক যুবকের স্কেচ। পাঠকের মনে ফেলুদার এমন ছবি এঁকে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজেই। সৃষ্ট চরিত্র দেখতে কেমন হবে, সেটিও কল্পনা করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়—বাংলা সাহিত্যের এই তিন মহিরুহের মধ্যে একটি মিল আছে। তা হলো, তাঁরা যেমন লিখতেন, তেমনি ছবিও আঁকতেন। অধুনা বাংলাদেশেও লেখকদের মধ্যে ছবি আঁকার শখ দেখা যায়। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক অথবা কবি নির্মলেন্দু গুণের আঁকা ছবির তো আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনীও হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুবতারাদের মধ্যেও এমন গুণের দেখা মেলে।

সিলভিয়া প্লাথের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
সিলভিয়া প্লাথের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
সিলভিয়া প্লাথ

সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩)
আমেরিকান এই লেখিকা সাহিত্যের বেশ কয়েকটি ধারায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি একাধারে উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতা লিখেছেন। কিন্তু শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি সিলভিয়া প্লাথ। স্থানীয় স্মিথ কলেজে শিল্পকলা নিয়েই পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। শৈশবে বিভিন্ন পোশাকের নকশা তৈরির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল। তবে স্মিথ কলেজে পড়ার সময় বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে আঁকাআঁকি শুরু করেন তিনি। এ সময় তিনি তেলরং ও কালি-কলম ব্যবহার করে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। একসময় তিনি নাকি ভেবেছিলেন, নিজের লেখার সঙ্গেই প্রকাশিত হবে এসব ছবি। তবে সেটি আর শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারেননি সিলভিয়া প্লাথ। নিজের বেশ কয়েকটি প্রতিকৃতিও এঁকেছিলেন তিনি, এঁকেছিলেন বিমূর্ত বা প্রায় বিমূর্ত ছবিও।

লুইস ক্যারলের আঁকা ছবি ‘অ্যালিস’। ছবি: সংগৃহীত
লুইস ক্যারল

লুইস ক্যারল (১৮৩২-১৮৯৮)
শিশুদের জন্য এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন লুইস ক্যারল। অ্যালিসের রোমাঞ্চকর পৃথিবীটা কেমন হবে দেখতে, সেটিও ছবিতে দেখিয়েছিলেন ক্যারল। কলম ও কালিতে জীবন্ত করে তুলেছিলেন অ্যালিসের অভিযান। বলা হয়ে থাকে, আঁকিয়ে হওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল লুইসের। কিন্তু অ্যালিসের গল্পের জন্য যেসব ছবি তিনি এঁকেছিলেন, সেগুলোকে তাঁর ঠিক জুতসই মনে হয়নি। পরিজন ও বন্ধুদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে নতুন করে ছবি আঁকানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন লুইস। পরে নতুন ছবিগুলোই বইয়ে ছাপা হয়েছিল। তবে নিজের গল্পের ছবি আঁকিয়েদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন লুইস ক্যারল, দিতেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ।

হেনরি মিলারের জলরঙে আঁকা ছবি। ছবি: সংগৃহীত
হেনরি মিলার

হেনরি মিলার (১৮৯১-১৯৮০)
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী মার্কিন লেখক হেনরি মিলার। ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’-এর এই রচয়িতা সারা জীবনে জলরঙে দুই হাজারেরও বেশি ছবি এঁকেছেন। কথিত আছে, ১৯২০-এর দশকে এক শিল্পী বন্ধুর সঙ্গে নিউইয়র্কের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রথম ছবি আঁকায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন মিলার। তখন ঘটনাক্রমে একটি শিল্প প্রদর্শনী দেখেন তিনি। এরপরই ধীরে ধীরে তুলি হাতে নেওয়া শুরু করেন মিলার। তিনি নিজের শিল্পীসত্তার সন্তুষ্টির জন্য ছবি আঁকতেন। একটি ছবি আঁকায় সৃষ্টির যে আনন্দ, সেটি উপভোগ করতেন তিনি। হেনরি মিলারের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপে।

রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের আঁকা প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত
রুডিয়ার্ড কিপলিং

রুডিয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬)
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের বোম্বে (অধুনা মুম্বাই) শহরে জন্ম কিপলিংয়ের। তাঁর শৈশবের বেশ কিছুটা সময় কেটেছিল ভারতে। সেই ছাপ দেখা যায় কিপলিংয়ের লেখালেখিতেও। ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর রচয়িতা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিপলিংয়ের বাবা ছিলেন একজন ভাস্কর। সেই হিসেবে তাঁর পারিবারিক বলয়েই ছিল শিল্পের ছোঁয়া। তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন চিত্রশিল্পী। ১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বইয়ে লেখার পাশাপাশি ছিল আঁকাও। গল্পের সঙ্গে সংগতি রেখেই ছবিগুলো এঁকেছিলেন রুডিয়ার্ড কিপলিং।

মার্ক টোয়েনের আঁকিবুকি। ছবি: সংগৃহীত
মার্ক টোয়েন

মার্ক টোয়েন (১৮৩৫-১৯১০)
তাঁর আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেনস। মার্ক টোয়েন ছদ্মনামে লিখতেন তিনি। নিজের লেখা পাণ্ডুলিপিতেই আঁকিবুঁকি করতেন তিনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তানদের খুশি করার জন্যই এই কাজ করতেন মার্ক টোয়েন। পাশাপাশি নিজের সন্তুষ্টির জন্য তিনি আঁকতেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্যই ছবি আঁকতেন আমেরিকার অন্যতম জনপ্রিয় এই লেখক।

কৈশোরের প্রেমিকা এলমাইরা রোইস্টারের প্রতিকৃতি ও অ্যাডগার অ্যালান পো-এর নিজের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
অ্যাডগার অ্যালান পো

অ্যাডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯)
কৈশোরে কে না প্রেমে পড়ে! অ্যাডগারও পড়েছিলেন, ভালোভাবেই পড়েছিলেন। কথিত আছে, কৈশোরের প্রেমিকা এলমাইরা রোইস্টারের প্রতিকৃতি দিয়ে ছবি আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। রহস্য রোমাঞ্চ ছোটগল্প ও কবিতা লেখার পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই আঁকতেন পো। পেনসিলে আঁকা তাঁর তিনটি স্কেচ বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। অনেকে বলেন, ওই ছবিগুলোতে নিজের, একসময়ের প্রেমিকা এলমাইরা ও স্ত্রী ভার্জিনিয়ার প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলেছিলেন পো। ১৯৩০-এর দশকে ইতালিতে এই ছবিগুলো প্রদর্শিতও হয়েছিল। তবে শুধু ব্যক্তির প্রতিকৃতি নয়, আঁকায় প্রকৃতির সৌন্দর্যও ফুটিয়ে তুলেছিলেন অ্যাডগার অ্যালান পো।

জর্জ বার্নার্ড শর আঁকা ছবি। ছবি: সংগৃহীত
জর্জ বার্নার্ড শ

জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০)
আইরিশ নাট্যরচয়িতা জর্জ বার্নার্ড শ ১৯২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন। পড়াশোনায় অনিয়মিত ছিলেন তিনি। লন্ডনে প্রায় তিন বছর শিল্পসমালোচক হিসেবে কাজ করেছিলেন। নাটকের প্রয়োজনেই কস্টিউম ও মঞ্চ নকশার কাজ করতে হতো জর্জকে। শখের বশে ক্যামেরায় ছবিও তুলতেন। এ ছাড়া নাটকের প্রয়োজনে তিনি অনেক কার্টুন ও ক্যারিকেচার এঁকেছিলেন। বেশির ভাগ কাজ কলম ও কালিতে করেছেন বার্নার্ড শ। তবে জলরঙেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ রচয়িতা।

দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনা হাস্যরসাত্মকভাবে এঁকে রাখতেন এইচ জি ওয়েলস। ছবি: সংগৃহীত
এইচ জি ওয়েলস

এইচ জি ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬)
সায়েন্স ফিকশনের কিংবদন্তি লেখক এইচ জি ওয়েলস। তাঁর পুরো নাম হারবার্ট জর্জ ওয়েলস। ব্রিটিশ এই লেখকের লেখা উপন্যাসের তালিকায় আছে ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ ও ‘দ্য টাইম মেশিন’-এর মতো সৃষ্টি। ছবি আঁকতেন ওয়েলস। তবে বিষয়টিকে কখনো খুব গুরুত্ব দিয়ে করেননি তিনি। ওয়েলস নিজের কাছে সব সময় একটি ডায়েরি রাখতেন, তাতেই চলত আঁকাআঁকি। মূলত দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনাই তিনি হাস্যরসাত্মকভাবে এঁকে রাখতেন। শতাধিক ছবি এঁকেছেন ওয়েলস।

তথ্যসূত্র: ভাইস, প্রিন্টম্যাগ, স্যালন, লুইস ক্যারল ডট অরগ, হেনরি মিলার ডট ইনফো, বিবিসি ও নোবেল প্রাইজ ডট অরগ