১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের একটি দলের সঙ্গে ঢাকায় আসেন সত্যজিৎ রায়। কলকাতার সাময়িকী উল্টোরথ ও সিনেমা জগৎ এই সারস্বত ভ্রমণ নিয়ে দুটো প্রতিবেদন ছেপেছিল। এখানে রইল তার প্রাসঙ্গিক অংশ।
[...] আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। মনের আবেগে কত কথাই তো এই চিঠিতে লিখে চলেছি। কলম আমার কিছুতেই থামতে চাইছে না।
আজ আবার এই ঢাকায় বসেই স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তা-ও আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে। সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে আরও অনেকে এলেন। শহীদ দিবসে ঢাকার ছাত্রলীগ যাঁদের নিমন্ত্রিত করে এনেছিল, তাঁরা প্রত্যেকে। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে শুধু একজন ঢাকায় আসতে পারেননি। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নির্ধারিত এই তারিখে কলকাতায় তাঁর পারিবারিক কাজ ছিল বলে আসতে পারেননি। আর সবাই এসেছেন। শ্যামল মিত্র, অমল মুখার্জি, সুমিত্রা মুখার্জি, বরুণ বক্সী ও আমাদের টুলু দাস। ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেলিম আবার বঙ্গবন্ধুর ভাগনে, এই তথ্য বঙ্গবন্ধুকে সেলিমের সম্বোধন থেকেই বুঝলাম, ‘মামা, গান শুনবেন?’
শেখ সাহেবের সরল স্বীকারোক্তি, ‘কেন শুনব না? গানই যদি না শুনতে ইচ্ছে করে তবে তো আমি ইয়াহিয়া খান হয়ে যাব।’
‘আমি সব জানি। ওরা তোমাদের জন্য যা করেছে, সেই ঋণ তোমরা পিঠের চামড়া দিয়েও শোধ করতে পারবে না।’
একটুখানি হাসির গুঞ্জরন। একে একে প্রত্যেকে একটি করে গান শোনালেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু সবার প্রশংসাতেই সমান পঞ্চমুখ। শ্যামল মিত্রকেই দেখলাম সবচেয়ে বেশি কথা বলতে। সত্যজিৎবাবু একরকম চুপচাপই ছিলেন। ফটোগ্রাফার টুলু দাস সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাদা ছবি তুলতে চাইলেন। শেখ সাহেব জবাব দিলেন, ‘আলাদা কেন, সবাই আসুন, গ্রুপ ছবি তুলি।’
তারপর চায়ের পালা। বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে সকলকে চা পরিবেশন করলেন। চায়ের আসরে ছাত্রলীগ সদস্য ও বাংলাদেশের নামী কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ শেখ সাহেবকে বললেন, ‘জানেন, পশ্চিম বাংলার এঁরা স্বাধীনতাসংগ্রামের এই নয় মাস আমাদের জন্য অনেক করেছেন।’
শেখ সাহেব সোজাসুজি জবাব দিলেন, ‘আমি সব জানি। ওরা তোমাদের জন্য যা করেছে, সেই ঋণ তোমরা পিঠের চামড়া দিয়েও শোধ করতে পারবে না।’
শুনে অবাক হলাম। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই পরিমাণ সরল স্বীকারোক্তি আমরা ভারতীয়রা ভাবতে পারি কি?
সিনেমা জগৎ, মার্চ ১৯৭২