শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বলছিলেন, ‘মনোয়ার, দুর্ভিক্ষ হলে সে ছবি আঁকা যায়, নিরন্ন মানুষের হাহাকার ছবিতে দেখানো যায়। কিন্তু পাকিস্তানি শোষণের সময় মনের দুর্ভিক্ষ চলছে—এটা তো কোনো ছবিতে আঁকা যায় না।’ মৃত্যুর দুদিন আগে মুস্তাফা মনোয়ার হাসপাতালে শিল্পাচার্যকে রং-তুলি এগিয়ে দিতেই তিনি কাগজের গায়ে কালো রঙে, কাঁপা হাতে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মুখ এঁকেছিলেন, সেই ছবি এ প্রদর্শনীতে রয়েছে। ছবিটির শিরোনাম ‘টু ফেসেস’। শিল্পাচার্য মুখ দুটি এঁকে সেদিন যেন আগামী দিনকে জানিয়ে দিলেন, এসব নতুন মুখই গড়ে তুলবে নতুন বাংলাদেশ।
নিসর্গ আর এই জনপদের মানুষকে ছবি আঁকার বিষয় করে তুলেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশের চিত্রকলার পথিকৃৎ তিনি। পরিবারের সদস্যদের শিল্পচর্চায় তিনি কখনো জোর করে যুক্ত করেননি। শিল্পীসুলভ মনোজগৎই তাঁদের টেনে এনেছে শিল্পের ভুবনে। জয়নুলের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের এ প্রদর্শনীর আয়োজন। শিরোনাম ‘শিল্পাচার্যের প্রসারিত শিল্পাঙ্গন’। শিল্পকর্মের সংখ্যা ৭০। শিল্পাচার্যের আঁকা মৌলিক শিল্পকর্মের সংখ্যা ১৭।
প্রদর্শনীর সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী শিল্পচার্যের মেজো ছেলে খায়রুল আবেদিনের মেয়ে মানিজে আবেদিনের ছবি নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করতে পারি। মানিজে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া থেকে চিত্রকলায় স্নাতক সম্মান সম্পন্ন করেছেন। তিনি পেশাদার শিল্পী। স্টুডিওভিত্তিক শিল্পরচনার বাইরে ভিডিও আর্ট ও পারফর্মিং আর্ট নিয়ে আগ্রহ রয়েছে তাঁর। এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার শিল্পরচনায় মানিজের আগ্রহ দেখা যায়।
জয়নুলের সর্বশেষ কাজের পর থেকে মানিজের কাজের শুরু। জয়নুলের মুখাবয়বে চৌকোনা জ্যামিতির প্রকাশের সঙ্গে মানিজের মুখাবয়বে ছন্দ-আশ্রিত রেখার ব্যবহারে ঐক্য খুঁজে পাবেন দর্শক।
মাসুদ মিজান জয়নুলের ভ্রাতুষ্পুত্র মিজানুর রহিমের ছোট ছেলে। চারুকলার স্নাতক হয়ে বাণিজ্যিক শিল্পকলার ইলেক্ট্রনিক সংস্করণ ওয়েব ডিজাইনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাতারে বসবাস করছেন।
জয়নুলের পরিবারের সদস্যরা শিল্পচর্চার অঙ্গনে কেউ কেউ জাতীয় পর্যায়ে উপস্থিত থাকলেও অনেকেই শখের বশে ছবি এঁকেছেন। শিল্পাচার্যের তিন ছেলের কেউই পেশাদার শিল্পী নন। বড় ছেলে সাইফুল আবেদিন স্থপতি, মেজো ছেলে খায়রুল আবেদিন ও ছোট ছেলে মইনুল আবেদিন বর্তমান প্রদর্শনীর জন্য শখের বশে ছবি এঁকেছেন। জয়নুলের আঁকা ‘টু ফেসেস’ ছবি থেকে অনুকরণ করে জলরঙে ছবি এঁকেছেন তাঁরা। ছবির শিরোনাম একই—‘টু ফেসেস’। মিজানুর রহিম ছাপচিত্র মাধ্যমে বিশেষ করে লিথোগ্রাফে সিদ্ধহস্ত। কালি ও অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর ছবি দুটি ছাপচিত্রের করণপদ্ধতির সঙ্গে মিলে যায়। মিজানুর রহিমের শিল্পভুবন শিল্পাচার্যের নিসর্গকেন্দ্রিক বিষয় নির্বাচনের বাইরে জ্যামিতি ও আলোছায়ার যুক্ততায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা পেয়েছে।
আবদুর রাজ্জাক বিবাহসূত্রে আবেদিন পরিবারের সদস্য। জয়নুলের সেরা ছাত্র হিসেবে তিনি প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর শিল্পীজীবনের শেষার্ধে এসে ছবিতে আধা বিমূর্ত ও একেবারে বিমূর্তরীতির আঁকায় মনোযোগ দেন। ছাপচিত্র ও ভাস্কর্য—দুটি মাধ্যমেই তিনি পারদর্শী ছিলেন। এ প্রদর্শনীর এচিং মাধ্যমের কাজ ‘স্ট্যান্ডিং ফিগার এচিং’ ছবিটি তাঁর ছাপচিত্রের উদাহরণ।
জুনাবুল ইসলাম শিল্পচার্যের আপন ছোট ভাই, চারুকলা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। শিল্পাচার্যের আগ্রহে কাপড়ে বাটিক মাধ্যমে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী হন। জয়নুলের মতো তিনি বাস্তবরীতির নির্মাণে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁদের সবার ছবিতে বর্ণিল হয়ে উঠেছে এই প্রদর্শনী।
এবার আমরা জয়নুলের আঁকা ছবি নিয়ে কথা বলতে পারি। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর নিয়ে আঁকা কালি ও তুলির চারটি ছবিতে চিত্রতলের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিত মনে হয়। সাবলীল ও দ্রুত রেখার তুলি চালনায় জয়নুল পৌঁছে যান রেনেসাঁস শিল্পীদের কাতারে। কালো কালির রেখায় অবনীন্দ্রনাথ ও যামিনী রায়ের প্রভাব স্পষ্ট বোঝা যায়।
জন্মশতবার্ষিকীতে জয়নুল আবেদিন আমাদের চিরচেনা বাংলাকে নতুন করে দেখান। জয়তু জয়নুল। গত ২৮ ডিসেম্বর প্রদর্শনী শুরু, শেষ হবে ১১ জানুয়ারি।