মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

জীবনানন্দের গল্পের নিরানন্দ জীবন

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—২২ অক্টোবর ১৯৫৪) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—২২ অক্টোবর ১৯৫৪) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

জীবনানন্দ দাশের গল্প বা উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ধরা পড়ে সেটি হচ্ছে, তাঁর রচনাগুলো প্রায়ই আত্মজৈবনিক উপাদান এবং দাম্পত্য ও দাম্পত্যবহির্ভূত সম্পর্কের টানাপোড়েনে, প্রেম-অপ্রেমে—দাম্পত্যক্লান্ত নর-নারীর অতৃপ্ত জীবনের যন্ত্রণায় বিধুর। অসফল প্রেম, অতৃপ্ত দাম্পত্য, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তাঁর গল্পগুলোকে পৌনঃপুনিকতায় ক্লান্ত করলেও পাঠক তাঁর জীবনবেদনার আরেকটি দিকের সন্ধান পান, যা সাধারণত জীবনীকারেরাই দিতে পারেন। জীবনানন্দের কবিতার বাইরে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের অজানা নেই যে ১৯৩০ সালে বিয়ে করার পর থেকে টানা কয়েক বছর বেকার ছিলেন তিনি। সে সময় যেকোনো উপায়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টায় মরিয়া জীবনানন্দ কবিতা লেখার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস লিখে কিছু আয় করতে চেয়েছিলেন। কারণ, কবিতা লিখে যে আয় হয়, তার চেয়ে গল্প-উপন্যাসের বাজারদর সে সময়ও ছিল অনেক বেশি। ১৯৩১ সালে বেকার অবস্থায় তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রীর জন্মের পরই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন এবং তিন বছরে শ খানেক গল্প ও আটটি উপন্যাসও লিখে রেখেছিলেন। তবে সেগুলোর কোনোটিই কেন কোথাও ছাপতে দেননি, সে এক বিস্ময়! যেখানে কবিতা লেখা হলেই সেটি পত্রস্থ করার বিষয়ে তাঁর কোনো কুণ্ঠা বা দ্বিধা ছিল না, সেখানে দীর্ঘদিনের শ্রমের ফসল গল্প বা উপন্যাসগুলো নিভৃতে রেখে দেওয়া কি তবে ছিল তাঁর সংশয়জাত? কোথাও প্রকাশিত না হলেও কিছু লেখা তিনি নিশ্চয়ই কাউকে পড়তে দিয়েছিলেন, তেমনই কেউ হয়তো বলেছিলেন যে তাঁর গল্পে কোনো প্লট থাকে না। সে কারণেই ৩২ সালের ১৪ এপ্রিলের দিনলিপিতে সাফাই হিসেবে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার গল্প এবং লেখাগুলো প্লটবিহীন এই অভিযোগ প্রসঙ্গে: জীবনটাই তো প্লটবিহীন, কেবল চক্রান্তকারীরাই ষড়যন্ত্র [প্লট] করে।’
তাঁর দিনলিপির এই মন্তব্য থেকে ধারণা করতে পারি, কোনো নিস্পৃহতা কিংবা প্রচারবিমুখতা নয়, কারও কোনো বিরূপ মন্তব্যের কারণেই হয়তো তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন। অথচ আমরা জানি, উপন্যাস প্রকাশের উদ্দেশ্যে দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন জীবনানন্দ। জানা যায়, দেশ সম্পাদক জীবনানন্দের লেখা ছাপতে রাজি থাকলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কখনোই লেখা পাঠাননি তিনি। প্রবল অর্থকষ্টের সেই দিনগুলোয় ভালো সম্মানী দেওয়া পত্রিকায় কেন তিনি তাঁর গল্পগুলোর কোনোটিই ছাপতে দেননি, এর কারণ বোধ হয় সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে তাঁর নিজের সংশয়। তাঁর হয়তো ধারণা হয়েছিল, দেশ সম্পাদক মৌখিকভাবে রাজি হলেও পড়ার পর ছাপবেন না। ভূমেন্দ্র গুহর বই জীবনানন্দ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য থেকে জানা যায়, কবির মৃত্যুর পর তাঁর মাল্যবান উপন্যাসটি দেশ-এ ছাপানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সাগরময় ঘোষ পাণ্ডুলিপিটি ‘কয়েক মাস ধরে নেড়েচেড়ে দেখে বলেছিলেন, “জীবনানন্দ বড় কবি, কিন্তু ঔপন্যাসিক নন।”’ মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে আবিষ্কৃত জীবনানন্দের একটা প্রধান উপন্যাস সম্পর্কে সম্পাদকের এই মন্তব্যই প্রমাণ করে, নিজের লেখা নিয়ে কবির সংশয় একেবারেই অমূলক ছিল না।

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—২২ অক্টোবর ১৯৫৪)

তাঁর গল্পগুলো পড়তে পড়তে নিজের অজান্তে পাঠককে ঢুকে পড়তে হয় এক বিষণ্ন জগতে, সেখানে গোলকধাঁধার মতো ঘুরপাক খেতে হয় ব্যর্থ প্রেম, দারিদ্র্য আর অতৃপ্ত দাম্পত্যের নিরানন্দ পরিবেশে। লেখকের কাছে প্রেমের মাহাত্ম্য ও আবেদন, স্বাদ ও পরিপূর্ণতা—কিছুই চরিতার্থ না হওয়ার যে অন্তর্জ্বালা, সেই বঞ্চনাবোধ তিনি কখনোই বিস্মৃত হননি। তাঁর বেশির ভাগ গল্পেই স্বামীটি বেকার কিংবা দরিদ্র, স্ত্রী সচ্ছল পরিবারে লালিতা, স্বামী উদাসীন ও সদা অভিযোগপ্রবণ। স্বামীটির বিবাহ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা কখনোই সুখকর হয় না, ফলে সেও হয়ে পড়ে সংসারবিমুখ। এমনকি স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে দাম্পত্য প্রেমের মোহভঙ্গের পর স্বামীটি তার প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে অতৃপ্ত প্রেমের কথা ভেবে দগ্ধ হয় মর্মবেদনায়।
জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে যাঁদের জানা, সেই পাঠকেরা তাঁর গল্পের স্বামী চরিত্র ও ব্যক্তি জীবনানন্দকে আলাদা করতে চেয়ে ব্যর্থ হতে পারেন। কারণ, গল্পগুলোয় নিজেকে লুকোনোর কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি, কিংবা স্ত্রী লাবণ্যর জন্য রাখেননি কোনো ছদ্মবেশের সুযোগ। আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দের বিয়ে হয়েছিল ১৯৩০ সালে, আর তিনি নিভৃতে গল্প লেখা শুরু করেন ১৯৩১ থেকেই। সে কারণেই তাঁর কিছু গল্পের শুরু হয় তিক্ত বাসর রাত দিয়ে, কয়েকটি গল্পে থাকে তাঁর প্রাক-বিবাহ প্রেমের সরাসরি ইঙ্গিত, আবার কোনোটিতে থাকে যৌনতার খোলামেলা সন্নিবেশ।
এখানে বলা প্রয়োজন, জীবনানন্দের প্রাক-বিবাহ প্রেমে তিনজন নারী তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। একজন মনিয়া নামের কিশোরী, আরেকজন তাঁর মামাতো বোন লীলাময়ী। তবে তাঁর সবচেয়ে পরিপূর্ণ প্রেম, সামাজিকভাবে অগ্রহণীয় হলেও, উদ্ঘাটিত হয়েছে তাঁর কাকা অতুলানন্দের দ্বিতীয় মেয়ে শোভনার সঙ্গে। এঁর ডাকনাম বেবি। দিনলিপিতে জীবনানন্দ বহুবার তাঁকে উল্লেখ করেছেন ‘বি-ওয়াই’ নামে, পরে আরও সংক্ষিপ্তভাবে শুধু ‘ওয়াই।’ এই ওয়াইকেই ঝরা পালক বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ‘কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধনে।
শোভনার সঙ্গে জীবনানন্দের মেলামেশা কখনোই পছন্দ করেননি শোভনার মা সরযূবালা। ম্যাট্রিক পাসের পর শোভনা যখন কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে আসেন, তখনো এই খুড়তুতো বোনের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন জীবনানন্দ। এই প্রেম যদি কোনো মুসলমান ঘরে হতো, তাহলে তার পরিণতি কী হতো, জানি না; কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষাপটে একটি হিন্দু কিংবা ব্রাহ্ম পরিবারে খুড়তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম বা বিয়ের কথা ভাবাই যায় না। অথচ জীবনানন্দ এই সামাজিক বাধা মেনে নিয়েও ভুলতে পারেননি শোভনাকে, তাই সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য শোভনা ঘুরেফিরে এসেছেন তাঁর গল্পে। জীবনানন্দের গল্পের এই একতরফা আত্মজৈবনিক উপাদান পুনরাবৃত্তিতে ভারাক্রান্ত হলেও পাঠকের ওপর তুলে দেয় এক অতৃপ্ত পুরুষের জীবনের যন্ত্রণার ভার।
‘বিবাহিত জীবন’ গল্পের সতীর সঙ্গে শোভনা বা বেবির দুর্দান্ত মিল দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয় পাঠককে। শোভনা আর সতী এখানে যেন মিলেমিশে এক হয়ে আছেন। সমাজনিষিদ্ধ এই বিয়ের প্রসঙ্গে ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পে তিনি লেখেন, ‘সতীর সঙ্গে বিয়ের প্রশ্ন প্রথম থেকেই উঠতে পারে না।’ এখানে সতীও তাঁদের মধ্যে বিয়ে যে অসম্ভব, সেটা স্বীকার করে বলে, ‘...তোমার বিয়ে আমার সঙ্গে হতে সমাজে যখন ঠেকে, অন্য যে কোনো ভালো জায়গায় যাতে তা হয়, সব সময়ই আমি সেই কামনা করেছি...।’
‘আকাঙ্ক্ষা-কামনার বিলাস’ গল্পেও ‘ওয়াই’ তথা শোভনা লুকিয়ে আছেন কল্যাণীর ভেতর, ‘...কল্যাণী তাকে খুবই ভালোবাসে বটে কিন্তু তবু সামাজিক বিধি-ব্যবস্থাকে প্রমথ অনেকবার উপেক্ষা করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত একবারও সাহস পেল না,...।’
‘গ্রাম ও শহরের গল্প’-এর শচী যে ‘ওয়াই’, সেটি তাঁর এক উপন্যাসের ভেতরের মলাটে লিখেও রেখেছিলেন তিনি। শচী কলকাতাবাসী এক সফল ব্যবসায়ীর অসুখী স্ত্রী, আর অবিবাহিত সোমেন বেকার দরিদ্র কবি। গল্পে শচী সোমেনকে প্রস্তাব দেয় শহরের জনারণ্য থেকে গ্রামের আগের সেই রোমান্টিক জীবনে পালিয়ে যেতে; অবশ্য গল্পে সেটি আর ঘটেনি। জীবনানন্দ তাঁর অসফল প্রেমের খণ্ডিত স্বপ্নের বাতায়নের ভেতর দিয়েই দেখতে চেয়েছিলেন একসময়কার প্রেমিকা ও প্রেমকে। অবশ্য কলকাতায় ‘ওয়াই’র সঙ্গে পরবর্তী সময়ে তাঁর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাই ১৯৩১ সালের ১৫ আগস্টে লেখা দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘ওয়াই: তার খবর কী? ...কোনো চিঠি নেই, কিছু নেই...একটা রোমান্টিক পরিবেশে তাকে কল্পনা করতে পারি আমি: চুমু এবং সে রকম কিছু—এমনকি দুই বছর আগেও (সে) আমার কাছে ছিল জীবনমৃত্যু: কিন্তু এখন!’ স্মরণ রাখতে হবে, যেদিন দিনলিপিতে এ কথা লেখা হয়, এর ঠিক এক বছর তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন জীবনানন্দ। আরেক দিনের দিনলিপিতে পাওয়া যায়, ‘ওয়াই’-এর মতো গ্রামের এক মেয়ের ভালোবাসা তাঁর জীবনকে ভরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সে যে অনেক দূরে।
জীবনানন্দ একদিকে যেমন নিজের প্রেমিকাকে তাঁর গল্পে বিভিন্ন নামে বারবার উপস্থিত করেছেন, অন্যদিকে তাঁর অসুখী দাম্পত্যের মূল পাত্রী লাবণ্যকে কোনো রাখঢাক না করে সন্নিবেশ করেছেন নানাভাবে। মাল্যবান উপন্যাসের উৎপলার বাইরেও তাঁর গল্পের অনেকগুলোতেই বারবার হানা দিয়েছেন লাবণ্য দাশ, একই ভূমিকায়। ‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পের হেম, ‘মা হবার কেনো সাধ’-এর শেফালী, ‘শাড়ি’-এর উষা, ‘কোনো গন্ধ’-এর কাঞ্চনমালা, ‘বত্রিশ বছর পর’-এর স্বর্ণ, ‘চাকরি নেই’-এর নির্মলা—এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে এসব স্ত্রীরা স্বামী উৎপীড়নকারী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত। এমনকি ‘নষ্ট প্রেমের কথা’-তে মোহিতের বউ হয়ে আসার দিন থেকেই সুরূপা নিজমূর্তি ধারণ করে, কিংবা ‘বাসর রাত’-এর মনিকা প্রথম দিন থেকেই স্বামীর সঙ্গে শুরু করে দুর্ব্যবহার; কিংবা ‘সুখের শরীর’ গল্পে ‘বউকে ঘরে আনার পর থেকেই’ যেমন ‘নিরুপম এ রকম পথহারা পথ-উদাসী হয়ে’ যায়।
গল্পের স্বামী-উৎপীড়ক ও স্থূল রুচিসম্পন্ন স্ত্রী-চরিত্রগুলোকে তিনি এঁকেছেন নিদারুণ নির্মমতা ও প্রবল বিদ্বেষে। একজন নিরুপায় মানুষ যখন কলমের মতো একটা ক্ষুরধার অস্ত্র চালাতে পারে, সেই অস্ত্র নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব প্রতিপক্ষের ওপর। জীবনানন্দ ঠিক এই কাজটি করেছেন তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে। ‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পে শেফালী, ‘পাতা-তরঙ্গের বাজনা’–এর টিবি রোগী মালতী বা ‘তিমিরময়’ গল্পের জ্যোৎস্না চরিত্রের বেলায় এ রকমই দেখা যায়। ‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পের হেম ইডেন কলেজের ছাত্রী, তার জ্যাঠামশাই সচ্ছল, বিয়ের পর তার জন্য আলাদা স্নানঘর তৈরি করে দেয় স্বামী অমূল্য, অথচ অমূল্যর সেই স্নানঘর ব্যবহারের অনুমতি নেই। এই আক্রোশ থেকেই হেমকে পরিণত করা হয় কুরূপা হয়ে যাওয়া এক সূতিকা-রোগীতে, তাকে দেখায় ‘কৃমির মতো’, ‘মাকড়সার পায়ের মতো’, ‘কুয়াশার পেতনির মতো’। হেম গানের চর্চাও করত, তখন ‘গায়িকার এপাশে-ওপাশে চারপাশে তাই পঁচিশ-ত্রিশ হাতের ভেতর কোনো লোকজনের গন্ধ নেই, দুটো বাছুর, একটা শিংভাঙা গোরু, একটা পাঁচ কিলো ছাগল আর দু-চারটা শালিক ইতস্তত চরছে মাত্র।’ গল্পে স্ত্রীর প্রতি এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যঙ্গ করার পর এমনকি মুসলমান বা খ্রিষ্টান হয়ে হেমকে ডিভোর্সের হুমকিও দিয়েছে তার স্বামী। স্মর্তব্য, জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্যও ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন, পিতৃহীনা মেয়েটির অভিভাবক ছিল তার জ্যাঠামশাই এবং লাবণ্যও গান গাইত। হেমকে লাবণ্যের জায়গায় টোটেমের মতো স্থাপন করে জীবনানন্দ উপর্যুপরি যেন তিরবিদ্ধ করেছেন তাকে। এ রকম বিদ্বেষ আরও টের পাওয়া যায়। সমাজতত্ত্ববিদেরা হয়তো লক্ষ করছেন যে আজকাল অসুখী দাম্পত্যের চেয়ে বিচ্ছেদ শ্রেয়তর বলে আলাদা জীবন বেছে নিচ্ছেন অনেকেই, কিংবা তার বিকল্প হিসেবে পরকীয়া প্রেমের মধ্যে কেউ খুঁজে নিচ্ছেন নিরুপায় আশ্রয়। অথচ সেই সময়কার সমাজে এর কোনোটিই সহজ ছিল না।
অতৃপ্ত প্রেম আর অসুখী দাম্পত্যের এ রকম জীবন্ত খতিয়ান বলেই কি তাহলে জীবনানন্দ তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলো বাক্সবন্দী করে রেখে গিয়েছিলেন, নাকি সেগুলোর গুণমান নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর? তবে এ ক্ষেত্রে সেসব খামতি শোধরানোর চেষ্টা না করে একই ধাঁচে প্রায় একই বিষয় নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে ফেলে রাখার ব্যাপারটিও যুক্তির বিচারে টেকে না। কবিতার তুলনায় তাঁর কথাসাহিত্য নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি; কিন্তু তাঁর কাব্যের দুর্ভেদ্যতার বিপরীতে তাঁর গল্প-উপন্যাসের অধিকতর বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে, বর্তমান সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে হয়তো পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করা যায় জীবনানন্দের জীবনবেদ ও বোধের নিরানন্দ ভূমি।