আমাদের দেশে যে ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত, আসলে তা প্রাক-বৈশাখী। সেই প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া আর বর্ষণের হাত ধরে হয় বর্ষ বদলের প্রস্তুতি। আজকাল আবহাওয়ার টালমাটাল অবস্থা। পৃথিবীজুড়েই তাল কেটে গেছে, তাই চৈত্রের কোনো কোনো আগুনঝরা দিনের শেষে প্রবল বেগে যে বাতাস আছড়ে পড়ে গাছের মাথায়, ঘর-দরজা- জানালায়, সেই চেনাজানা কালবৈশাখী এখনো হানা দেয়নি রোদে পোড়া চৈত্রের এই শহরটিতে। এমনকি চৈত্র মাসের শেষের দিকেও নয়। তবে বৈশাখের দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিনেই ঝড়ের তাণ্ডবে নেচে উঠল ক্লান্ত-শ্রান্ত শহর। কিছুক্ষণের জন্য নগরবাসীর দহনজ্বালা জুড়াল। কী ভাঙে, কী উড়ে যায় এই আশঙ্কার চেয়ে ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির ছোঁয়াই মনে হলো বেশি কাম্য তখন। ধুলোর ঝাপটাকে উপেক্ষা করে আকাশের প্রমত্ত রূপেই নয়ন মুগ্ধ। সেই ঝড়ে ফ্ল্যাটবাড়ির একফালি বারান্দার কটা ফুলের টব ভেঙে চুরমার, কটা গাছ উল্টে গেছে, সেসবের হিসাব পরদিন সকালবেলার জন্য না হয় তোলা থাক।
আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে চিরাচরিত নিয়মে গ্রীষ্ম আসবেই। সেচের সুবিধা থাকলেও মাঝেমধ্যে চাষের জমিতে ফাটল ধরবে, খালবিলও শুকিয়ে চৌচির হবে। কিন্তু এই উত্তাপের মধ্যেও প্রকৃতির শুভাশিস রয়েছে। এই সময়ে আকাশের এক প্রান্ত থেকে যে কালবৈশাখী ধেয়ে আসে, সেই ঝড় শুধু ধুলোই ওড়ায় না, সমুদ্র থেকে মেঘও তাড়িয়ে আনে। বজ্র গর্জনের চারদিক কাঁপিয়ে একসময় শুরু করে স্নিগ্ধ বর্ষণ। তৃষিত খালবিল, প্রান্তর তৃষ্ণা মেটে, মানুষ, পশুপাখি সবাই হাঁফ ছাড়ে।
কালবৈশাখী নিয়ে গান-কবিতা লেখা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু এর উপযোগিতা শুধু কাজে না, আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে এর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঝড়ের পিছু পিছু যে বর্ষণ তার ওপর এখন নির্ভরশীল আমাদের চাষাবাদের অনেক ফসলি জমি। কালবৈশাখী না এলে প্রলম্বিত হয় খরার করাল ছায়া, প্রকৃতিবিদেরা জানেন, গ্রীষ্মের প্রথম দিকের অনাবৃষ্টি চাষের জন্য কত ক্ষতিকর। তাই সময়মতো কালবৈশাখীর আগমনেরও উপকারিতা অনেক, যদিও ঝড়ের তাণ্ডবে মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা, পুষ্প, পাখির প্রচুর ক্ষতি হয়। কালবৈশাখীর কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা লেখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পতিসর, শাহজাদপুর, শিলাইদহ থেকে বোলপুর শান্তিনিকেতনে কবির কালবৈশাখীর অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ। ১৮৯২ সালের গ্রীষ্মের এক বিকেলে কবি তাঁর দুই বন্ধুকে শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখাতে তালবনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমন সময় হঠাৎ এক টুকরো কাল নিরীহ মেঘ ভীষণ মূর্তি ধারণ করে সারা আকাশ ছড়িয়ে যায়। দেখতে না দেখতে সেই মাঠে একটি ঝড় প্রবল গর্জনে তাদের মাথার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কবি পরদিন সেই ঝড়ের সন্ধ্যার বিবরণ দিয়েছেন ইন্দিরা দেবীকে এমনি ভাষায়, ‘ধুলোয় এমনি অন্ধকার হয়ে এল যে পাঁচ হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়তে লাগল। মনে হলো বাতাস পেছন থেকে ঘাড় ধরে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে—দৌড় দৌড়।...! মাঠ সমান নয়। এই ঝড়ের বেগে চলা আরও মুশকিল। পথের মধ্যে আবার পায়ে কাঁটাসুদ্ধ একটা শুকনো ডাল বিঁধে গেল।... যা হোক, একটা খুব শিক্ষা লাভ করেছি। হয়তো কোনো দিন কোনো কাব্যে কিংবা উপন্যাসে বর্ণনা করতে বসতুম একজন নায়ক মাঠের মধ্য দিয়ে ভীষণ ঝড় বৃষ্টি ভেঙে নায়িকার মুখচ্ছবি স্মরণ করে অকাতরে চলে যাচ্ছে—কিন্তু এখন আর এমন মিথ্যে কথা লিখতে পারব না।’
অমল হোম গ্রীষ্মের শান্তিনিকেতনের এক বিকেলের কালবৈশাখীর বর্ণনা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। বৈকালিক চা পান সবে শেষ হয়েছে, এমন সময় ঘোর কালবৈশাখী মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। দিগদিগন্ত ধুলোয় ঢেকে ছুটে এল ঝড়। দেখি, সেই ঝড়ের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে আসছেন—তাঁর বেশবাস, তার শ্মশ্রুকেশ উড়ছে, জোব্বাটা চেপে ধরেছেন বাঁ হাতে, আর ডান হাতে চেপে ধরেছেন চোখের চশমাটা। আরেকটু এগিয়ে আসতেই শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে তিনি গাইছেন— ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।’ বারান্দাতে উঠে দিনেন্দ্রনাথকে তাঁর এই সদ্য লেখা গানটি ধরিয়ে দিলেন। তারপর নামল বৃষ্টি মুষলধারে। কবির কণ্ঠে সেদিন গানের বান ডেকেছিল।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, চিঠিপত্র পড়ে মনে হয়, তিনি যেন অপেক্ষা করে থাকতেন কখন আসবে কাঙ্ক্ষিত কালবৈশাখী। শিলাইদহে জানালায় বসে দেখতেন কালবৈশাখীর দাপুটে আবির্ভাব, ‘ধূসর পাংশুল মাঠ, ধেনুগন ধায় ঊর্ধ্বমুখে/ ছুটে বনে চাষি/ ত্বরিতে নামায় পাল নদীপথে ত্রস্ত তরী যত/ তার প্রান্তে আসি।’
২
শুধু রবীন্দ্রনাথই নয়, কালবৈশাখীর ঝড় তেড়ে এলে আমাদের অনেকেই পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার ঝড়ে আম কুড়ানোর কথা মনে পড়বে ‘বৈকালের দিকটা হঠাৎ/ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল’ অপু-দুর্গা দুজনেই সোনামুখী তলায় আম কুড়াতে ছুটছিল। ‘ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদি বা শোনা যায় ঠিক কোন জায়গা বরাবর শব্দ, হইল—তাহা ধরিতে পারা যায় না দুর্গা আট-নয়টি আম পেলেও ছোটাছুটির পর অপু পেলে মাত্র দুটি। একটু পরেই চারদিক ধোয়াকার করে মুষলধারে বৃষ্টি নামিল।’ হঠাৎ ঝটিকাসুদ্ধ অন্ধকারে আকাশের এ প্রান্ত হইতে লকলকে আলো জিহ্বা মেলিয়া বিকট অট্টহাসির রোল তুলিয়া এক লহমায় ও প্রান্তের দিকে ছুটিয়া গেল ক্কড় ক্কড় কড়াও শব্দে বাজ পড়ল। ভৈরবী প্রকৃতির উন্মত্ততার মাঝখানে ধরা পড়া দুই অসহায় বালক-বালিকার চোখ ঝলসে গেল নীল বিদ্যুতের তীব্র ঝলকে। ভয়ে এবং শীতে কাতর অপুকে দুর্গা তার আরও কাছে টেনে শেষ আশ্রয়ের সাহসে বারবার আবৃত্তি করিতে লাগিল—‘নেবুর পাতা করমচা, যা বৃষ্টি ধরে যা— ভয়ে তাহার স্বর কাঁপিতেছিল।’ অপু-দুর্গা ঝড় থামলে ভাইবোন বাড়ি ফেরে বিজয়গর্বে, শুধু আমই নয়, একটি ঝুনো নারকেল ও নারকেলের মরা ডাল হাতে নিয়ে। এত ঝড়-ঝাপটার পরও দুজনের মুখ ‘বৃষ্টি ধোয়া জুঁই ফুলের মত সুন্দর দেখাইতেছিল।’
গ্রীষ্মের উত্তাপে বাতাস তেতে ওঠে। ভৌতিক বাতাসে প্রান্তরের যেখানে সেখানে ধুলোর ঘূর্ণি বাউলের মতো নেচে উঠছে। খেজুরগাছের তলায় বসলে ঠান্ডা ছায়া মেলে না উত্তপ্ত এই নিদাখে তালগাছেরও সে একই অবস্থা। দুটিরই শুকনো খরখরে ছবি। তাল-খেজুরের দিকে তাকালে মনে পড়বে সুকুমার রায়কে ‘গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা।
মেঘ যেটুকু মাঝেমধ্যে দেখা যায়, সেই ‘হালকা মেঘের পানসে ছায়া’। চৈত্র মাসের শেষের থেকেই কাকের বাসা বাঁধার তাড়া। অধ্যবসায়ী কাক ঠোঁটে পাতা কামড়ে তাদের ডালে বসে আছে। আর কদিন পরই সে মা হবে—
বোশেখি কাক। তারপর একদিন হঠাৎ দেখা যাবে কালবৈশেখে ঝড়ে কাকের বাসা ভেঙে মাটিতে গড়াগড়ি। কোথাও বা কাকের ছানা ঝড়ের তাণ্ডবে গাছের নিচে মরে পড়ে আছে। আর্তনাদ করে মা আর বাবা কাক ঘুরে ঘুরে উড়ছে আশপাশে। কালবৈশাখীর মর্মান্তিক কৌতুকেরও যে শেষ নেই।
গ্রীষ্ম ঋতুর স্বর রুদ্র, কবির ভাষায় মৌনীতাপস। দয়ামায়া, নিষ্ঠুরতা মেশানো এক প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই ঋতু। কত কর্তব্য কাজের বোঝা এই আপাত কঠোর ঋতুটির মাথায়। গাছের ডালে ডালে তাকে সাজাতে হয় সবুজ পাতা, ফলাতে হয় কত রসাল ফল, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল। ফোটাতে হয় পদ্ম, জবা, টগর, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল আর পলাশ ফুল। নদী-সমুদ্র থেকে বাষ্প টেনে নিয়ে ছড়াতে হয় মেঘের পালক’ আর ছোটাতে হয় প্রমত্ত কালবৈশাখী, তা না হলে রোদে ভাজা জমি ঠান্ডা হবে কী করে, দখিনা বাতাসই বা বইবে কেন?
সময় ফিরে আসে না—সবাই জানে। কৈশোর, যৌবন ফিরে আসে না। কিন্তু ঋতুচক্র ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে—গ্রীষ্মও দেখা দেয় বারবার আর এরই সঙ্গে কালবৈশাখীও ফিরে আসে প্রতিবছর। আবহাওয়াচক্র যদি সম্পূর্ণ ধসে না যায়, তবে ফিরেও আসবে আরও বহুদিন। আসবে প্রতিবছর হয়তো এই সময়েই আজও যেমন আসে, ‘আকাশ-ঢাকা জটিল কেশে ভীষণ বেশে’—পুরোনো বছরের সব আবর্জনা দূর করতে।