তালেবানের কাছে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর আফগানিস্তানে লেখক–শিল্পী–সাহিত্যিকদের অবস্থা এখন কেমন? আফগান ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ঢুঁড়ে সে কথা জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
আতঙ্ক আর আনন্দ কি পাশাপাশি হাত ধরে চলতে পারে? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আফগানিস্তানের মানুষের হয়েছে উভয়সংকট দশা। তাদের এখন এক হাতে আতঙ্ক, আরেক হাতে আনন্দ নিয়ে চলতে হচ্ছে। কেউ কেউ খানিক আনন্দিত এ জন্য যে মার্কিন সৈন্যরা বিদায় নিয়েছে। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে তারা যে নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা থেকে নিস্তার তো মিলল!
একই সঙ্গে অনেকেই আতঙ্কিত এ কারণে যে এবার দেশটার দখল নিল তালেবান! তারা কি শান্তিতে থাকতে দেবে? গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে তালেবান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, তখন নানাভাবে মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। বিশেষত নারীদের তো তারা মানুষই গণ্য করেনি। এসব বেশি দিন আগের কথা নয়। তাই তালেবান শাসনের ভীতিকর সেসব স্মৃতি এখন চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে আফগানদের অন্তরে।
আফগানিস্তানের মানুষের ভয়, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তার নমুনা দেখা গেল ১৫ আগস্ট, কাবুল বিমানবন্দরে। সেদিন হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিল এখানে। বিমানবন্দরের আশপাশে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে লেগে গেল যানজট। সবাই ছুটছে বিমানবন্দরে। দেশ ছেড়ে পালাতে চায় তারা। যে যেভাবে পারছে, উঠে পড়ছে বিমানে। কেউ জানালা দিয়ে, কেউ বা বিমানের চাকা ধরে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম রিয়া নোভাস্তির একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেল, উড়ন্ত বিমান থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়ে গেলেন দুজন। বলা বাহুল্য, তাঁরা মারা গিয়েছিলেন। ওদিকে, পাকিস্তান সীমান্তে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত অবস্থা। শত শত মানুষ সীমান্তপথে চাইছেন দেশ ছাড়তে।
কাবুল এখন অচেনা। অচেনা গোটা আফগানিস্তান। বিশাল বিশৃঙ্খলার সময় যা যা হওয়ার কথা, তার সবই হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কেমন আছেন আফগান লেখক–কবি–সাহিত্যিক–শিল্পীরা?
ভালো যে নেই, তা কি আর মুখে বলতে হবে!
৪ আগস্টের কথা। তখনো কাবুল দখলে নিতে পারেনি তালেবান। এর মধ্যেই দক্ষিণের শহর চোরায় ঢুকে কবি ও ইতিহাসবিদ আবদুল্লাহ আতেফির বাড়িতে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা। প্রথমে হাত–পা বেঁধে, সারা রাত নির্যাতন চালিয়ে এবং শেষে গুলি করে আবদুল্লাহ আতেফিকে হত্যা করে তারা। উরুজগান প্রদেশের গভর্নর মোহাম্মদ ওমর সিরজাদ রেডিও আজাদির কাছে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু আতেফির কী অপরাধ ছিল, কেউ তা জানে না। তিনি কবিতা লিখতেন, ইতিহাসচর্চা করতেন, শিল্প–সাহিত্যের কথা বলতেন, সৌন্দর্যের কথা বলতেন। সম্ভবত এসবই ছিল তাঁর অপরাধ। তবে তালেবানের মুখপাত্র ক্বারি ইউসুফ আহমাদি বলেছেন, আতেফির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন।
আতেফির হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করলেও গত ২৮ জুলাই তাঁরা যে ফজল মোহাম্মদ নামের এক কৌতুকাভিনেতাকে হত্যা করেছেন, সেটা অবশ্য অস্বীকার করেননি। হয়তো এই হত্যাও অস্বীকার করতেন তালেবান মুখপাত্র, কিন্তু বিপত্তি বাধিয়েছে এক ভিডিও ক্লিপ। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তালেবান পাশবিক প্রহার চালাচ্ছে ফজল মোহাম্মদের ওপর। আরেক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ফজলের মৃতদেহ। ভিডিও দুটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরই মূলত হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে তালেবান।
ফজল মোহাম্মদ বাস করতেন কান্দাহারে। তিনি ছিলেন আফগান পুলিশ কর্মকর্তা। শখের বসে অভিনয় করতেন। এই অভিনয়ই তাঁর কাল হলো। শখের দাম মেটাতে হলো জীবন দিয়ে। আফগান সংবাদমাধ্যম গান্ধারা বলছে, অন্তত ১২টি জেলায় সমাজকর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক ও শিল্পীকে হত্যা করেছে তালেবান।
ফজলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কান্দাহারের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে বরফশীতল নীরবতা। থমথমে মুখ আর আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে ঘরের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছেন শিল্প–সাহিত্য অঙ্গনের লোকজন। সব সময় শঙ্কা, এই বুঝি নিজের পালা এল! কান্দাহারের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল বলেন, ‘বাড়ি থেকে শিল্প–সাহিত্যের সব বই লুকিয়ে ফেলেছি। দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলেছি শিল্পকর্মগুলো। এসব রাখা আমাদের জীবনের জন্য এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারা (তালেবান) এগুলো একদম সহ্য করতে পারে না। ঘরের ভেতর এসব দেখামাত্র তারা আমার পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে।’
এরপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এই শিক্ষক। বলেন, ‘আতঙ্কে আছি, ভীষণ আতঙ্কে আছি। ভয়ে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে এসে থাকে। ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো। এভাবে আসলে বাঁচা যায় না। আমরা উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে গিয়ে পড়লাম!’
এই ভীতিকর সময়ে সৌন্দর্যসাধকেরা যখন নিপীড়নের মুখোমুখি, সে সময় আফগানিস্তানের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা কীই–বা করতে পারেন?
তাঁরা কি দেশ ছেড়ে পালাবেন? সবাই তো পালাতে পারবেন না। মাতৃভূমি ছাড়তে অনেকের বিবেকই সায় দেয় না। তবু কেউ কেউ ভাবছেন, এই মুহূর্তে জীবন বাঁচানোই প্রধান কাজ। কিন্তু যাঁরা এমন ভাবছেন, তাঁরা দেশ ছাড়বেন কী করে? বিমানবন্দরগুলোয় ফ্লাইট যে বন্ধ। বেশির ভাগ দূতাবাসে ঝুলছে তালা!
এমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কাবুলে মার্কিন দূতাবাস খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে আফগান আমেরিকান আর্টিস্ট অ্যান্ড রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন। ১৩ আগস্ট সংগঠনটির ওয়েবসাইটে বলা হয়, আফগানিস্তানের লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা এখন নিজ দেশে নিরাপদ নন। নিরাপদ নয় সাধারণ মানুষও। ভয়ে, আতঙ্কে শুধু কান্দাহার ও হেরাত থেকেই কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারা এখন কোথায় যাবে? এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ থাকায় তাদের জীবনের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যেকোনো মূল্যে কাবুলে দূতাবাস খোলা রাখা এবং আফগান শরণার্থীদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করতে সাহায্য করা।
সংগঠনটির কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি শিল্পী–সাহিত্যিকদের জন্য ‘আর্টিস্ট ভিসা’ চালু করারও আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া নারী, শিশু, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যও আলাদা ভিসা চালু করার অনুরোধ করেছেন তাঁরা।
এসব অনুরোধ, উপরোধ, আহ্বানই বলে দেয়, প্রগাঢ় অমানিশার মধ্যে রয়েছেন আফগান লেখক–শিল্পীরা। তাঁদের ভালো না থাকার আরও একটি প্রমাণ তিন–চার দিন ধরে আর্তনাদ করছে ফেসবুকের দুনিয়ায়। সেটি একটি চিঠি। লিখেছেন আফগানিস্তানের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা কারিমি।
চিঠিতে কারিমি লিখেছেন, ‘দুনিয়ার উচিত হবে না আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। আফগান নারী, শিশু, শিল্পী ও চলচ্চিত্রকারদের হয়ে আপনার কণ্ঠ ও সমর্থন আমাদের দরকার।’
জন্মভূমির শিল্পী-সাহিত্যিক আর সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ছুঁয়ে গেছে দ্য কাইট রানারখ্যাত আফগান–আমেরিকান লেখক খালেদ হোসাইনিকেও। আফগান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সরব রয়েছেন টুইটারে। প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু না কিছু লিখছেন। ১৬ আগস্ট তিনি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আপনারা যতটা সম্ভব আফগান শরণার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন।’
পরের দিন তিনি পরপর দুটি টুইট করেছেন। একটিতে লিখেছেন, সাইগনের পতনের পর ইন্দো–চীন অভিবাসন ও শরণার্থী সহায়তা আইনের মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থীকে বিশেষ মর্যাদায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আফগান শরণার্থীদের জন্য এখন তেমনটাই করা উচিত।
পরের টুইটে তোপ ঝেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আসল প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আফগানিস্তানের এই মানবিক সংকটে আমেরিকা এখন কী করবে? তারা আফগানিস্তানে যেসব পুরুষ, নারী এবং শিশুদের ফেলে এল, তাদের এখন কে রক্ষা করবে?
খালেদ হোসাইনির টুইটের নিচে রিটুইট করেছেন নোবেলজয়ী পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই। তিনি লিখেছেন, ‘তালেবানরা শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল, এটা দেখে আমি যারপরনাই ধাক্কা খেয়েছি। আফগানিস্তানের নারী, শিশু, সংখ্যালঘু মানুষ ও মানবাধিকার সমর্থকদের জন্য আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে।’
শেষ পর্যন্ত আফগান লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভাগ্যে কী ঘটবে এবং পুরো আফগানিস্তানের ভাগ্যেই বা কেমন দিন লেখা আছে, সেসব এখনো অজানা। মাত্রই ক্ষমতায় বসেছে তালেবান। এ সময় আফগান লেখক–শিল্পী–সাহিত্যিকদের থমথমে মুখ এবং বরফশীতল নীরবতা–পরিস্থিতির কি পরিবর্তন হবে, নাকি ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠবে?
প্রশ্নগুলোর জবাব জানতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, গান্ধারা, হাইপার অ্যালার্জিক ও আওয়া ওয়েবসাইট