২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আমি যখন ঘুমানোর চেষ্টা করছি, তখন আমার টেলিফোন বেজে ওঠে। এত রাতে টেলিফোন বেজে ওঠা মোটেও স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু আমরা একটা অস্বাভাবিক সময় পার করছিলাম। তাই যেকোনো কিছুই প্রত্যাশিত ছিল। আমার অফিসের ব্যক্তিগত সহকারী মুজিবুল হক ফোনটি করেছিল। তখন তার কাজ ছিল কাপ্তাইয়ের একমাত্র টেলিফোন এক্সচেঞ্জটিতে বসে সমস্ত কলের নজরদারি করা। উত্তেজিত কণ্ঠে সে আমাকে বলল, ‘চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে এইমাত্র খবর এসেছে যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় ভীষণ লড়াই চলছে।’
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান খবরটি প্রচার করেছেন। ভীত হয়ে আমি জানতে চাইলাম ব্যাপারটা ক্যাপ্টেন হারুনকে জানানো হয়েছে কি না। মুজিবুল জানাল, বুথে যে বাঙালি সুবেদার ছিল, সে খবরটি জানাতে ছুটে গেছে।
আমি আমার স্ত্রীকে টেলিফোনে পাওয়া খবরটি জানালাম। ভীত হয়ে সে দ্রুত কোরআন শরিফ নিয়ে বসে পড়ল। বৃদ্ধা পরিচারিকা কান্না শুরু করে দিল। বেড়াতে আসা আমার স্ত্রীর চাচা মাথায় রুমাল বেঁধে মেঝেতে বসে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকলেন। আমাদের বাড়িটা হালকা কাঠামোর তৈরি ছিল। ছিল প্রচুর কাচের জানালা, যা বুলেট থেকে নিরাপদ নয়। আমি দ্রুত ঘুমন্ত বাচ্চাদের বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিলাম। বাসায় বাদশা নামের ১২ বছরের একটি পরিচারক ছেলে ছিল। ওকে বললাম সাবধানে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরে কী হচ্ছে তা দেখতে। কাছেই ছিল ইপিআরের অস্থায়ী শিবির। বাদশা সাবধানে মাথা তুলে আমাকে ঘটনার বর্ণনা দিতে লাগল। আমি ততক্ষণে ভীতভাবে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো প্রস্তুত করে চারদিকে খেয়াল করতে থাকলাম। আমার চাচাশ্বশুর অস্ত্র চালাতে জানতেন না। তাই তাঁকে রক্ষার দায়িত্বও আমার ওপর বর্তাল।
ওদিকে খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন হারুন চৌধুরী ছুটে যান ইপিআর শিবিরে। তিনি তখন সেকেন্ড ইন কমান্ড। মেজর পীর মোহাম্মদ কোনো কিছু আঁচ করতে পারার আগেই হারুন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। তবে কেউ হতাহত হয়নি। এনসিওদের অস্ত্র সংবরণ করিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে একটি বিশাল কক্ষে আটকে রাখা হয়। একদম প্রথম না হলেও ক্যাপ্টেন হারুন অবশ্যই অল্প কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার একজন, যিনি শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন—এই খবর পাওয়ামাত্র বিদ্রোহ করেছিলেন। ক্যাপ্টেন হারুন দ্রুত ও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিলেও তাঁর ওপর বড় দায়িত্ব এসে পড়ে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে কী হবে? ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা তখন হত্যাযজ্ঞে মেতেছে। তবে প্রদেশের সর্বত্র সে রকম অবস্থা তখনো হয়নি।
আমাদের বাড়ির চারপাশে ক্রমাগত বুটের শব্দে আমরা ভীত হয়ে পড়ি। অল্পক্ষণের মধ্যেই মেজর পীর মোহাম্মদের বাড়িটি ইপিআর জওয়ানরা ঘিরে ফেলে এবং তিনি গৃহবন্দী হন। বিদ্রোহ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং কাপ্তাইয়ে আমাদের জন্য পিছু ফেরার কোনো উপায় ছিল না। আমরা তখনো জানি না, ঢাকায় কী হচ্ছে। সবকিছুই হচ্ছিল জনাব হান্নানের কাছ থেকে পাওয়া একটিমাত্র টেলিফোন-বার্তার মাধ্যমে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করলাম, আমরা ভীষণ বিপদের মধ্যে আছি।
আমার টেলিফোন আবার বেজে উঠল। এবার রাঙামাটির ডেপুটি কমিশনার তৌফিক ইমাম। লাইনে তখন এত শব্দ যে কথা ঠিকমতো শোনা যাচ্ছিল না। তার মধ্যেই জানতে পারলাম, সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনী পূর্ণ শক্তি নিয়ে পিলখানায় ইপিআর কার্যালয় ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা চালিয়েছে। রাজারবাগের পুলিশ ওয়্যারলেস থেকে খবরটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুলনা ও কুমিল্লার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য যা যা করণীয়, তা-ই আমাকে করতে বলা হয়েছে। কেননা, রাঙামাটি বা অন্য কোনো জায়গা থেকে সাহায্য পাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করেছেন—চট্টগ্রাম থেকে পাওয়া এই খবরের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে উল্লেখ করলেন তৌফিক ইমাম। সেনাবাহিনী যখন ঢাকা আক্রমণ করেছে, তখন ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করার খবরটি আমার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। তৌফিক ইমামের সঙ্গে আলাপ শেষে আমি উপলব্ধি করলাম, আমরা অত্যন্ত বিপদের মধ্যে আছি এবং এই বিপদ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি একেবারে নগণ্য।
পাহাড় ও জঙ্গলঘেরা কাপ্তাই থেকে এই বিপদের মধ্যে দুটি শিশুসন্তান নিয়ে আমরা যে কোথাও পালিয়ে যাব, তা সম্ভব ছিল না। সারা দেশেই তখন আগুন জ্বলছে আর তাই যেখানেই যাই না কেন, পরিস্থিতি সর্বত্রই একই রকম খারাপ। আমরা নিয়তির হাতে বন্দী হয়ে পড়ি। আমি জীবনে কখনো এতটা অসহায় বোধ করিনি। এ অবস্থায় ২৬ মার্চ রাত দুইটার (২৫ মার্চ দিবাগত) কয়েক মিনিট পর আরেকটা ফোন এল। এক্সচেঞ্জ থেকে অপারেটর আমাকে জানাল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। আসলে তাৎক্ষণিক বিপদটা কেটে গেছে। কিন্তু আমরা অনেক বড় ও প্রলম্বিত বিপদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, যে ধরনের বিপদের মোকাবিলা জীবনে আমরা অনেকে কখনো করিনি। এক প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতি আমাকে ঘিরে ধরল। আমার স্ত্রী তখনো কোরআন পাঠ করছিল খানিকটা উচ্চস্বরে। বৃদ্ধ পরিচারিকার কান্না তখন থেমেছে। আমি তৌফিক ইমামকে ফোন করে ক্যাপ্টেন হারুনের বিদ্রোহের বিষয়টি জানালাম।
খানিক পর কেউ একজন দরজায় টোকা দিল। কিছুটা ভীত হয়ে আমি রাইফেলটি আঁকড়ে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’
নিচু স্বরে উত্তর ভেসে এল, ‘আমি মাস্টার ওয়াজিউল্লাহ।’ তিনি স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক। আমার খুব ভালো বন্ধু। আমরা প্রায়ই একসঙ্গে শিকারে যেতাম। দরজা খুলে দেওয়ার পর সন্তর্পণে তিনি ঘরে ঢুকলেন। আমি দরজা লাগিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলাম। মনে হচ্ছিল, তিনি শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছেন। তাঁর কাঁধে বন্দুক চাপানো। তিনি বললেন, ‘আমাদের সবার এখন ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে থাকাটাই নিরাপদ হবে। বাইরের অবস্থাটা দেখে আসি। পরিস্থিতিটা তো ভালোভাবে বুঝতে হবে।’
কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি রাইফেল ও টর্চলাইট নিয়ে মাস্টার ওয়াজিউল্লাহর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার বাসা থেকে ইপিআরের ক্যাম্প ১০০ মিটারের মতো। ৫০-৬০ জন লোকের ছোটখাটো ভিড় চোখে পড়ল। দেখলাম, ইপিআরের অবাঙালি জওয়ানদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের পিছমোড়া করে রাখা হয়েছে। তারা অসহায়ের মতো প্রাণভিক্ষা চাইছিল। আমাদের মতো তাদেরও জীবন মূল্যবান। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত থেকে টর্চলাইটটি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এর পরই আবার হইচই। ইপিআরের একজন অবাঙালি দৌড়ে পালিয়ে ঝোপের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে ধরে নিয়ে আসা হলো ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন হারুন তাঁর রিভলবারটি বের করে ওর বুকে ঠেকিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকটি ক্যাপ্টেনের পা জড়িয়ে ধরল। এ যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পেলেও কয়েক দিন পরই সে মৃত্যুবরণ করে।
পাকিস্তানি সৈনিকদের হত্যা করা সহজ ছিল না। কয়েক শ প্রাণঘাতী ৩০৩ বুলেট ছুড়তে হয়েছিল ব্যাংক ভবনের প্রথম তলায়। এখানে নিরস্ত্র, অনাহারী পাকিস্তানি এনওসিদের ইন্টার্নির জন্য রাখা হতো। গোলাগুলিতে ভবনের চেহারাটা জলবসন্ত রোগীর মতো হয়ে গিয়েছিল। তার পরও সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা জানত যে আত্মসমর্পণ করতে বাইরে এলেই দরজার সামনে তাদের হত্যা করা হবে। শেষ পর্যন্ত দুজন লোক সাহস করে টিনের চালের ছাদে গিয়ে ওঠে। তাদের একজন ছিল মোল্লা নামের এক বদমাশ লোক। তারা দু-তিনটা টিন তুলে ফেলে ভেতরে গুলি চালায়। অবশ্য অনাহারে ভেতরের লোকগুলো এমনিতেই কয়েক দিন পর মারা যেত। কয়েকজন বুদ্ধিমান লোক দ্রুত ভবনের ওপর নতুনভাবে আস্তর করে দিল, যেন বোঝা না যায় গুলি চালানো ও হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আর পাকিস্তানি সেনারা যে আসবে এবং শহরে যাকেই পাবে, তার ওপর প্রতিশোধ নেবে, সেটাও সবার জানা ছিল। ১৭টি মৃতদেহ সেতুর পেছনে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। নিকটবর্তী কুষ্ঠ হাসপাতাল থেকে মরণাপন্ন কুষ্ঠ রোগীদের এনে এখানে রাখা হতো।
ইপিআর ক্যাম্পে জড়ো হওয়া স্থানীয় লোকজন অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। এ রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, সে বিষয়ে কারোরই কোনো ধারণা ছিল না। রাতের অন্ধকার থাকতেই ইপিআরের লোকজন তাদের অস্ত্র ও ব্যাগ নিয়ে ট্রাকে চেপে কাপ্তাই ত্যাগ করে। পরে আমি মেজর রফিকের (লক্ষ প্রাণের বিনিময়ের লেখক) কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তিনি চট্টগ্রাম থেকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হারুনকে তাঁর বাহিনী নিয়ে যোগদান করার জন্য। আর তাই ক্যাপ্টেন হারুন দ্রুত কাপ্তাই থেকে চলে যান। চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে তিনি বন্দী পাকিস্তানি জওয়ানদের স্থানীয় পুলিশ ও জঙ্গি লোকজনের তত্ত্বাবধানে রেখে যান। যাওয়ার আগে তিনি কাপ্তাইয়ের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেননি আর কখনোই কাপ্তাইয়ে ফিরে আসেননি।
বাড়ি ফিরে আমি আমার এক বন্ধুর পরামর্শে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাপ্তাই বাঁধের অপর পাশে তাঁর বাড়িতে চলে যাই। যাওয়ার পথে মেজর পীর মোহাম্মদের বাড়ি ঘিরে রাখা ইপিআরের সদস্যরা আমাদের মাইক্রোবাস আটক করে। তবে আমাদের কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পেয়ে ছেড়ে দেয়। ওয়াজিউল্লাহর বাসায় গিয়ে যখন উঠলাম, তখন ২৬ মার্চ ভোর চারটা। আমরা দুজনই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করার পরপরই আমাদের দিক থেকেও বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে পরিণতি যে ভয়াবহ হবে, তা-ও আমরা বুঝতে পারছিলাম। অথবা গৃহযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে সেটা মোটেও সুবিধাজনক হবে না, তা-ও বুঝতে পারছিলাম।
মিসেস ওয়াজিউল্লাহ আমাদের চা, ডিম ভাজা ও খই পরিবেশন করলেন। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমে ঢলে পড়লাম। যখন চোখ মেললাম, তখন কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে নিচু পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে সূর্য আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সূর্যোদয় দেখলাম ঘরের ছোট্ট জানালাগুলো দিয়ে। আমরা যারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বিশ্বাসী ছিলাম, তাদের জন্য এই সূর্যোদয় বিরাট এক প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল।
সকালবেলা একজন আগন্তুক আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, যাকে আমি চিনতাম না। সে আমার কাছে জানতে চাইল, আমি শাহাবুদ্দিন সাহেবের রাইফেল নিয়ে এসেছি কি না। শাহাবুদ্দিন ছিলেন দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদ থেকে আসা এক মুসলিম, যিনি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে কাজ করতেন। জানালাম, আমি ওটা নিয়ে এসেছি। এ-ও জানতে চাইলাম, কেন এই তথ্য তাঁর দরকার। সে সংক্ষেপে জানাল, তারা অবাঙালিদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিচ্ছে। শাহাবুদ্দিনের কাছে গেলে তিনি জানালেন, তাঁর রাইফেলটি আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। লোকজন অবশ্য তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই তাঁকে হেনস্তা হতে হয়। আমি বুঝতে পারলাম, গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করা নয়, আমাদের হাজার হাজার অবাঙালিরও মোকাবিলা করতে হবে। বিহারি, দক্ষিণ ভারতীয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে অভিবাসীরাও আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। যাদের জ্ঞানগম্যি বেশ অল্প অথচ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তারাই এই শত্রু চিহ্নিত করেছিল।
আগন্তুকের সঙ্গে কথা শেষ করার পর আমি কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলাম। গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে গেলাম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যালয়ে। সেখানে স্টেশন ম্যানেজার শামসুদ্দীন আহমেদ ও অন্য প্রকৌশলীরা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। আমাকে দেখে তাঁরা হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। এর কারণ আমি আজও বুঝতে পারিনি। তবে আমরা একটা বিরাট বিপদের মধ্যে ছিলাম। টেবিলে রাখা রুটি ও বিস্কুট নিতে তাঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরা তখনো কেউই জানতেন না যে অবাঙালিদের বড় অংশই ছিল নিরস্ত্র। আর তাদের খুঁজে বের করার যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে, তার পরিণতি কী হতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁরা অন্ধকারে ছিলেন। কাপ্তাইয়ে তখন বাঙালিদের পাশাপাশি অনেক অবাঙালি বসবাস করত। অবাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী পাঠান ঠিকাদার ছিলেন, যাঁরা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ ও কর্ণফুলী পেপার মিলে কাজ করতেন। ওই আসরে দক্ষিণ ভারতীয় আবদুল্লাহ ও বিহারি আবদুর রহমান নামের দুজন অবাঙালি প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁরা বুঝতেও পারেননি যে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের মাথার ওপর খড়্গ ঝুলছে। যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হত্যাযজ্ঞের খবর একের পর এক আসতে থাকল, তখন আমাদের সামরিক হাইকমান্ড থেকে অবাঙালিদের শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ চলে আসে। আমি অবশ্য কয়েক দিন পর ব্যাপারটা জানতে পারি। এতে করে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে।
ফারুক আজিজ খান
অনুবাদ: আসজাদুল কিবরিয়া