৯ মার্চ ছিল শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ৯০তম জন্মদিন। পোস্টার ডিজাইনেও ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনত্বের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তিনি। জন্মদিন উপলক্ষে এই শিল্পীর পোস্টারশিল্পের সুলুক সন্ধান।
শিল্পীর প্যালেট তাঁর মনের দর্পণ। প্যালেটে তুলি ঘষতে ঘষতে, স্প্যাচুলা চালাতে চালাতে চিত্রকর ভাবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আবার ক্যানভাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়, এই প্যালেটকেই কি তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীর পোস্টারে আনা যায় না? আর সেটিই যদি করতে হয়, তাহলে এই প্যালেট যে আমার ‘সোনার বাংলা’র সেটি কি বোঝানো দরকার না? কাইয়ুম চৌধুরী হয়তো সেটিই ভাবছিলেন ১৯৮৯ সালে চতুর্থ এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের পোস্টার আঁকতে গিয়ে!
গৎবাঁধা ২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি কিংবা ২০ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি মাপের বাইরে গিয়ে লম্বাটে এক সোনালি প্যালেট, নানা রঙের আরও অনেক প্যালেটের স্তূপের ওপর রাখা। পোস্টারের নিচের দিকে অ্যাসিমিট্রিক টাইপোগ্রাফির একটু আভাসে বাংলা ও ইংরেজিতে এই শিল্পযজ্ঞের প্রয়োজনীয় তথ্য। স্পেসকে একদম ছেড়ে দিয়ে প্রতীক ও টাইপোগ্রাফি ব্যবহার করে কাইয়ুম চৌধুরী যে সোনালি পোস্টার তৈরি করলেন, তাতে আধুনিক গ্রাফিক ডিজাইনের কতকগুলো গুণ চোখে পড়ে?
সীমার মাঝে অসীমকে ধরতে পারা, স্পেসের সর্বোত্তম ব্যবহার, দুই ভাষার টাইপোগ্রাফির সাযুজ্য তৈরি করা, সর্বোপরি জুতসই প্রতীকের ব্যবহারের মাধ্যমে হাজার শিল্পীর মূল সত্তাকে এক পোস্টারে তুলে ধরা—এমন আধুনিক গ্রাফিকশিল্প নিশ্চয়ই হাতে গোনা।
চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী চিত্রকলারই পাঠ নিয়েছিলেন জয়নুল-কামরুল-সফিউদ্দিনের চারুকলা স্কুলে। গ্রাফিক ডিজাইনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণ তাঁর হয়নি। কিন্তু সফল গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়ার জন্য যে ‘দেখবার’ এবং ‘দেখাবার’ চোখ দরকার, সেটি তাঁর ছিল। আর কাজ করতে করতেই, শেখাতে শেখাতে, ঠেকতে ঠেকতে কাইয়ুম তাঁর নিজের গ্রাফিক ডিজাইন স্কুলটি গড়েছিলেন প্রায় ছয় দশকের নিরলস প্রচেষ্টায়।
পোস্টারে প্রচারণাই লক্ষ্য। জনগণকে কিছু জানানোই এর মূল কাজ। কাইয়ুম শুধু এই জানান দেওয়ার পোস্টারে আগ্রহী ছিলেন না। অমন পোস্টারে মানুষ একবার দেখেই তাকে ছেড়ে হেঁটে চলে যাবে। কাইয়ুম চান তাঁর পেইন্টিংয়ের সামনে মানুষ যেমন দাঁড়িয়ে ভাবে, ঠিক সেভাবে পোস্টারের সামনেও দাঁড়াবে ও ভাববে। টাইপোগ্রাফি আর ক্যালিগ্রাফির খেলা দেখেই বিমোহিত হবে মানুষ, পোস্টারের রং, প্রতীক কিংবা মোটিফ গেঁথে নেবে মনে।
পোস্টারের ভাষ্য হবে আন্তর্জাতিক, তবে এর ভাবমূল থাকবে বাংলার মাটিতে প্রোথিত।
বাংলার মাটিতে আমরা কী বিছাই? শীতলপাটি। আর বাংলার পুকুরে খালে ফোটে জাতীয় ফুল ‘শাপলা’। যদি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে বাংলার মাটিতে দাঁড় করাতে হয়, তবে পাটির ওপর একটি শাপলা আর আমাদের আলংকারিক নকশাকেই তো বসিয়ে দেওয়া যায়! কাইয়ুম সেটি করলেন ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৮১-এর পোস্টারে। সেকালের চলচ্চিত্র উৎসবের পোস্টারে ফিল্ম, ফিল্ম রিল কিংবা ফিল্মস্পুলের ছবি থাকতই। কাইয়ুম একটুকরো ফিল্ম ভাঁজ করে লাল-সবুজের শাপলা বানিয়ে দিলেন। আর তার নিচে রাখলেন অলংকারের মতো নকশি ক্যালিগ্রাফি।
বাংলার নকশাকে বিশ্বের কাছে নিয়ে যাওয়া আর বিশ্বকে বাংলার কাছে নিয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে কাইয়ুমের বাহন ছিল শিল্পকলা একাডেমির এশিয়ান বিয়েনাল। ১৯৮৩ সালের দ্বিতীয় বিয়েনালে তিনি পোস্টারে আনলেন বাংলার নকশি পিঠার সরলীকৃত ফর্ম। সোনালি চাকতির ওপর সবুজ–কালো–নীলের কিউবিক প্যাটার্ন আর তার ওপর লাল রঙের গ্রিড, যা কিনা তাঁতের সুতার বুনোটকে স্মরণ করায়। আবার সেই বিয়েনালেই তিনি ১৯৯১ সালের পঞ্চম আসরের পোস্টারে নিয়ে এলেন নানান দেশের পাখি—নীল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর হাতে ছিঁড়ে লাগানো স্ক্রিন আর তার ওপর পাঁচটি পাখি। নিচে অ্যাসিমেট্রিক টাইপোগ্রাফির ব্যবহারে বাংলা আর ইংরেজিতে তথ্যসম্ভার। মাঝখানে কনট্যুর লাইনে লেখা ৫ (পাঁচ)। লেয়ারিং আর ওভার প্রিন্টিংয়ের মজা যদি কেউ পেতে চান তো এই পোস্টার তাঁর সামনে ঝুলিয়ে রাখলেই চলবে।
আবদুল্লাহ আল-মামুনের রচনা ও নির্দেশনায় থিয়েটারের প্রযোজনা কোকিলারার পোস্টারে ফেরদৌসী মজুমদারের তিনটি ফটোগ্রাফ তিন লেয়ারে বানিয়ে কাইয়ুম বের করে আনলেন একই অভিনেতার অভিনীত তিনটি চরিত্রের রূপ। গ্রাফিক ডিজাইনারকে তাঁর মুদ্রণযন্ত্রের সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হয়। যন্ত্রকে না চিনলে প্রিন্ট হবে কী করে? যন্ত্রকে ঠকিয়ে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রত্যাশিত সুন্দরকে বের করাই গ্রাফিক ডিজাইনারের যুদ্ধের লক্ষ্য। সব ছাপিয়ে আবার সেটি হতে হবে যোগাযোগযোগ্য ও নান্দনিক। গ্রাফিক ডিজাইনে এমন এক অস্ত্র লেয়ারিং আর ওভার প্রিটিং। ফটোগ্রাফ, লেয়ারিং আর স্ক্রিনের ব্যবহারে অল্প কথায় পুরো গল্প বলে ফেলা কাইয়ুমের অতি পছন্দের কাজ—সাময়িকীপত্রের প্রচ্ছদে এবং মাঝেমধ্যে প্রচ্ছদের কাজেও তাঁর এই ডিজাইন প্রক্রিয়ার ব্যবহার ছিল।
মুখচ্ছবি ব্যবহার করে অসংখ্য প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম। কখনো তা বঙ্গবন্ধুর, অথবা রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীর, আবার কখনো নানা গুণীজনের। এ কাজে কখনো তিনি ব্যবহার করেছেন ড্রয়িং, কখনো–বা ফটোগ্রাফ। লক্ষ্য ছিল পোস্টারটিতে ব্যক্তির ‘ভাব’কে প্রতিভাত করা। ১৯৯৩ সালে করা পোস্টার ‘পুরুষোত্তম তুমি পিতা আমার’-এ সাদা স্পেসের মধ্য থেকে কালো কালির আঁচড়ে বের করে আনা বঙ্গবন্ধুকে দেখে চোখে জল আসে, আবার উদ্দীপ্তও হই। আবার ২০০০ সালের রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীতে পেছনে টকটকে লাল সূর্যের ওপরের লেয়ারে কবিগুরুর সিপিয়া টোনের বয়সকালের মুখচ্ছবি ‘জাতীয় পর্যায়ে’ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কবির জন্মবার্ষিকীকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
কাইয়ুম চৌধুরীর পোস্টারশিল্প তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মুখচ্ছবি। সমাজ ও তার পরিবর্তন, দেশ ও তার অবস্থান এবং সর্বোপরি মানুষ ও তার জীবনকে দর্শকের সঙ্গে যোগ করার কাজটি কাইয়ুমের পেইন্টিং বা ড্রয়িংয়ে যতটাই বিমূর্ত, পোস্টারে ততটাই মূর্ত। ২০০২ সালে করা ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’–এ সন্তানসহ ভীত মা–বাবার পেছনে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মাঝখানে জেগে থাকা চোখের ড্রয়িং, আর পাশে বাংলায় তাঁর সিগনেচার ক্যালিগ্রাফি এমন এক সৃষ্টি। এ রকম আরও অনেক কাজ রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন কিংবা বিশ্বমানবের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে লক্ষ্য করে।
বক্তব্যের প্রয়োজনে কাইয়ুম ড্রয়িং আর স্পেসকে ব্যবহার করছেন পরিমিত পরিসরে। প্রায়শই রঙের ব্যবহারে থেকেছেন সীমিত। বাংলাদেশে আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের জন্য করা ‘শৃঙ্খলিত নামিবিয়ার স্বাধীনতা এখনি’তে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর রক্ত রঙের নামিবিয়াকে চাপিয়েছেন। আর দুটি শৃঙ্খলভাঙা হাত থেকে উড়ে যাচ্ছে শান্তির প্রতীক—একটি শ্বেতকায় পাখি। বাংলাদেশের ১৯৮৮ সালের বন্যায় এমনই দুই রঙে করা সাপ্তাহিক একতার পোস্টারে কাইয়ুম জলে ভাসমান দুঃখী জনতার ড্রইংয়ের ওপর ক্যালিগ্রাফিতে উৎকীর্ণ করেছেন শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্ক্তি।
সীমিত রঙের এমন সব অসাধারণ কাজের উল্টো দিকে আছে পরিবেশ নিয়ে করা ‘চাই আনন্দ উচ্ছল নির্মল পরিবেশ’। কাইয়ুম চৌধুরী এই পোস্টারে রঙের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, ব্যবহার করেছেন রাজশাহীর শখের হাঁড়ির মোটিফ। আবার শিশু, পাখি, মাছ, ফুল, রোদ ও বৃষ্টি—কোনোটাই বাদ যায়নি। আর তার ওপরে সোজাসাপটা টাইপোগ্রাফিক ফন্টে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখে দিয়েছেন পোস্টারের বক্তব্য—আনন্দে উজ্জ্বল–উচ্ছল পরিবেশ গড়ার জন্য গড়তে হবে দেশ। আর এই দেশ যে লাখো শহীদের রক্তে গড়া সেটি বুঝিয়ে দিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জন্য করা ‘এসো দেশ গড়ি’ এমনই এক অতীতকে মনে রেখে ভবিষ৵ৎকে গড়ার পোস্টার। রক্ত রঙের লাল জমিন, কালো ও লাল কালিতে আঁকা গ্রাম, নৌকা, মাছভরা পুকুর, ধোঁয়া ওঠা কলকারখানা আর মুক্ত পাখির বন্ধনহীন উড়ে চলার ওপর ইয়েলো ওকারে নেচে ওঠা যৌবনের রূপ—অল্প রঙে কী করে বিশ্বের সব রংকে ধরা যায় কাইয়ুম সেটি দেখালেন।
কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর পোস্টারে একটি সমস্যারই সমাধান করতে চেয়েছেন। নান্দনিক রূপায়ণে বিষয় এবং দর্শককে কী করে যুক্ত করা যায়? তিনি জানতেন, এ দেশের মানুষের জন্যই ডিজাইন করছেন। তাই দেশি রং, দেশি মোটিফ আর দেশ ও দশের গল্পকে বলতে হবে পোস্টারে। চারুশিল্পী নয় বরং ডিজাইনারের মতো করে গল্প বলার কাজটি এই দেশে শুরু করেছিলেন তিনি। গ্রাফিক ডিজাইনের আধুনিক ধারাগুলোকে দেশীয় প্রতীকে তুলে ধরার দুরূহ কাজটি ছিল তাঁর সাধনা। এভাবেই তৈরি হয়েছে তাঁর নিজের ভাষ্য।
গ্রাফিককলার এই ভাষ্য, ভাবে ও ভাষায় পুরোটাই কাইয়ুমের চারুকলার থেকে একদম ভিন্ন, মিল যা আছে তা তাঁর অক্ষরে আর প্রতীকে।