২২ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তাঁকে অনেকে চিনতেন হস্তরেখাবিদ হিসেবে। বেশকিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকবি তিনি। ছিলেন লেখকও। অসুস্থ হওয়ার মাত্র দিন কয়েক আগে ছোট্ট কিন্তু সাবলীল এই গল্প তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো সেই গল্প।
কাঁকন খুলনায় গিয়েছিল ওর এক খালার বাসায় বেড়াতে। আরেক খালাতো ভাই ফিরোজের সঙ্গে ঢাকায় ফিরবে সে। সামনেই রয়েছে মেধাবিকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের ভর্তি পরীক্ষা। ফিরতে ফিরতে ট্রেনে দুই কাজিন জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে। কমলাপুর স্টেশনে নেমে দুজনই চুপ। গন্তব্য ফিরোজদের বাসা। ওখানেই বিশ্রাম।
ওরা পৌঁছাল ভোরবেলায়। বাসায় এসে দেখল টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজানো৷ খালা বললেন, ‘তোরাও ফ্রেশ হয়ে এসে বসে যা।’ ওরা বসতেই অফিসগামী স্যুট পরা খালু এসে ওদের সঙ্গে বসলেন। হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওরে কাঁকন, তুই নাকি আর্কিটেক্ট হবি!’
কাঁকন চুপ করে রইল। খালু বললেন, খুলনায় তো ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়। আমাদের মিষ্টি কই? এবার মুচকি মুচকি হাসতে লাগল কাঁকন। ফিরোজ ওর সবগুলো দাঁত বের করে দিল। খালু ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে ডিমপোচটা পরনের টাইতে ফেলে একটা সিনক্রিয়েট করে ফেললেন। খালা বললেন, ‘আহ, কী যে করো তুমি!’ খালু দাঁত বের করে বললেন, ‘কী এমন করেছি আমি! শুধু টাইটা পাল্টে নিলেই চলবে।’
ব্রেকফাস্ট–টেবিলে সবাই হাসি আর চেপে রাখতে পারল না। খালু রাগের মাথায় ভটাশ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং ভেতরে চলে গেলেন।
সবাই তখনো হাসছে। কাঁকন উঠে দাঁড়িয়ে মোবাইলে সময় দেখে বলল, ‘অ্যাডমিশন টেস্ট বলে কথা। দেরি করলে চলবে না ভাইয়া। শিগগির ওঠ।’
পরবর্তী দৃশ্যে আমরা দুজনকে একটা সিএনজিতে দেখতে পাচ্ছি। ফিরোজ দুবার এইচএসসি ফেল করা ছাত্র। স্বভাবতই ওর মন ছোট হয়ে আছে। মেধাবিকাশটা ঢাকা শহর থেকে অনেকটাই দূরে। ওখানে পৌঁছানোর পর ওরা মুখোমুখি হলো এক তরুণের। রাজপুত্রের মতো চেহারা। পরিচয় করাতে গিয়ে ফিরোজ বলল, ‘আমার কাজিন কাঁকন।’ কাঁকন সামনে হাত বাড়িয়ে দিল। তরুণটি হাত গ্রহণ করে বলল, ‘আমি কল্লোল দাস। ইতিহাস বিভাগে পড়ি। চলুন একটু চা খাওয়া যাক।’ কাঁকন বলল, চা চা চা...তা খাওয়া যায়। ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কী বলিস ভাইয়া?’ ফিরোজ একটু শ্রাগ করল অর্থাৎ কাঁধ ঝাঁকাল।
ওরা একটা টঙে বসল। টঙটার পেছনে গাছ। ছাতার মতো ঢেকে আছে। চা পানের পর কল্লোল বলল, ‘আর কিছু খাবেন না, ঠান্ডা কিছু?’...মুচকি হেসে ফেলল কাঁকন, ‘গরমের পরে ঠান্ডা খেতে হয় না শুনেছি। ভাইয়া, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এবার তাহলে চল উঠি।’
তিনজনই উঠে দাঁড়ায়। কাঁকন বলে, ‘আজ আসি তাহলে। আরেকটা কথা, আপনি কি কেবলই পড়াশোনা করেন?’
ফিরোজ বলে, ‘কী বলছিস তুই কাঁকন! হি ইজ আ রাইটার। বই লেখেন। তবে বইগুলো এখনো ছাপা হয়নি। পাবলিশাররা ওনার বই ছাপাতে চান না। ওসব জটিল বইয়ের নাকি পাঠক নেই।’ কাঁকন বলে, ‘ও মা, আপনি নিজের মুখে তো কিছুই বললেন না!’ কল্লোল স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরোজ ও কাঁকন হাত ধরাধরি করে দূরে চলে যেতে থাকে। কল্লোল বসে পড়ে।
তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়। কাঁকন যেতে যেতে পিছু ফিরে তাকায়। দেখে বুদ্ধের মতো বসে আছে কল্লোল। তার মাথায় আলো–আঁধারির খেলা। চোখ দুটি কাঁকনের দিকে তাকিয়ে আছে।
দূরে একটা সাদা গাড়ি শোঁ শোঁ শব্দ করে চলে যায়।