দশ দিগন্ত

করোনাকালে যেমন আছেন লেখক-পাঠকেরা

করোনাকালে অন্য সবকিছুর মতো বদলে গেছেন বিশ্বের লেখক আর পাঠকেরাও। পরিবর্তন এসেছে তাঁদের লেখা, লেখার বিষয়সহ নানা ধরন–ধারণে। সেই বদলগুলো কী? বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানাচ্ছেন জিনাত শারমিন

২৩ এপ্রিল ফেসবুকে লগইন করে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা। ফেসবুকে ‘ফেস’ কম, ‘বুক’ বেশি। মানে, বই আর বই। সেদিন ছিল বিশ্ব বই দিবস৷ মনে হলো, প্রতিবছরই তো বই দিবস আসে, যায়ও। এভাবে তো কখনো উদ্‌যাপন করতে দেখিনি। তবে কি করোনা পাঠক বাড়িয়ে দিল? গুগলমামাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে পাশের দেশ ভারতের একটা গবেষণা ধরিয়ে দিল। ওই গবেষণা লেখার অক্ষর চিৎকার করে বলছে, ঘটনা সত্য। করোনায় আসলেই পাঠক বেড়ে গেছে!

গবেষণার শিরোনাম ‘ইনপ্যাক্ট অব কোভিড নাইনটিন অন দ্য ইন্ডিয়ান বুক কনজিউমার’। সেখানে এক জরিপের ফল বলছে, লেখক ও প্রকাশকদের জন্য সেই ‘ফল’ খেতে বেশ মিষ্টি। কেননা, লকডাউনের আগে যে পাঠক সপ্তাহে নয় ঘণ্টা বই পড়তেন, তিনি এখন ১৬ ঘণ্টা বই পড়েন। আবার যাকে লাঠিপেটা করেও বই নিয়ে বসানো যেত না, তার হাতেও দিব্যি দেখা যাচ্ছে বই। অবাক বিষয়, মহামারিকালে পাঠকেরা গল্প, উপন্যাস, অ্যাডভেঞ্চার কম পড়ছেন। তার চেয়ে ঢের বেশি পড়ছেন ননফিকশন। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, ভ্রমণকাহিনি, আত্মজীবনী, সাফল্যের গল্প, স্মৃতিকথা, নানা কিছু শেখার বই, সাক্ষাৎকার—এসব বই-ই নাকি বিকোচ্ছে দেদার। এর কারণ জানিয়ে হপারকলিন্স ইন্ডিয়ার সম্পাদক বলেছেন আরেকটি গম্ভীর কথা, ননফিকশন নাকি বাস্তব হওয়ায় তা এখনকার পাঠকদের হৃদয়ের কাছাকাছি ঘর বেঁধেছে। এদিকে এক ক্লিকে কেনাকাটা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেক নেটিজেন। সেই তালিকায় আছে ই-বুকও। ভারতের সবচেয়ে বড় ই-বুক মার্কেটে বিক্রিবাটা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। পাতা উল্টে পড়ায় জায়গা দখল করছে পিডিএফ। তা দেখে জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের পরিচালক উইলিয়াম ডালরিম্পল মন্তব্য করেছেন, ‘মানুষ আর কত নেটফ্লিক্স, আমাজন দেখবে! বিরক্ত হয়ে বই নিয়ে বসেছে।’

ওদিকে মেক্সিকোর বিভিন্ন জায়গায় নাকি এখনো লাইন ধরে বিক্রি হচ্ছে মজার খাবার টাকোস আর বারিতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে জেনিফার ফেল্টহামের রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছে চলতি লকডাউনে। সেই বন্ধ রেস্টুরেন্টে বসেই জেনিফার লিখে ফেলেছেন সোনোরাটাউন নামে ৯৪ পৃষ্ঠার একটি বই। জেনিফারের রেস্টুরেন্টের বেশ কিছু খাবারের আইটেমের গোপন রেসিপি আর থাকেনি গোপন। উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায়। তা ছাড়া আছে প্রেমিক থিয়োডর ডায়াজ রদ্রিগেজ জুনিয়রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ঘোরা আর সেখানকার খাবার চেখে দেখার অভিজ্ঞতা। জেনিফার জানিয়েছেন, মহামারি পেরোলে আবার যখন তিনি রেস্টুরেন্ট খুলবেন, তখন নানা পদের খাবারের সঙ্গে বিক্রি হবে বইটাও। আর তাঁর রেস্টুরেন্টের খাবারের ক্রেতাদের জন্য সারা বছর থাকবে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়। তো রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে মারিকালে যেমন অনেকে লেখক হয়েছেন, তেমনি নিয়মিত লেখক অর্থনৈতিক সংকটে বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্ট খুলেছেন—এমন উদাহরণও দিয়েছে রাইটার্স ডাইজেস্ট ডট কম! বলে রাখা ভালো, করোনাকালে যাঁরা নয়া লেখক হয়েছেন, তাঁদের প্রায় কেউই অর্থনৈতিক কারণে লেখক হননি। কিন্তু লেখকেরা অর্থনৈতিক কারণেই পেশা বদল করেছেন।

নিজের বই হাতে জেনিফার।

আবার ইউরোপিয়ান রাইটার্স কাউন্সিল একটি সমীক্ষা করে জানিয়েছে, মহামারিতে মহাদুর্যোগে পড়েছেন লেখকেরা। ইউরোপে আগে যেখানে বছরে পাঁচ থেকে ছয় লাখ বই বের হতো, সেখানে ২০২০ সালে বই প্রকাশিত হয়েছে সাড়ে তিন লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের শেষে এই সংখ্যা আরও ছোট হয়ে যাবে। ইউরোপীয় সাহিত্যে বৈচিত্র্য কমে আসবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অস্থির সময়ে নাকি সংকট বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লেখকেরা শান্তিমতো ভাবতে বা লিখতে পারবেন না। লেখদের নিয়ে সমস্ত আয়োজন (বক্তৃতা, কর্মশালা, কবিতা, চিঠি বা প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা, সাংগঠনিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান) আপাতত স্থগিত। তাই লেখক-অনুবাদকেরা আছেনও বেশ লোকসানের ‘ফাঁপরে’। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ কবি মারিয়া জেমস-থিয়াউয়ের কথা বলা যায়। মারিকালের প্রথম দিকে তাঁর কলম থেকে কোনো শব্দই বেরোচ্ছিল না। একদিন ‘লেখা না–আসা’ বিষণ্ন তিনি তাঁর ১১ বছরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎই মনে হলো, এ সময় তো তিনি ওর মতো অন্যান্য শিশু আর তার পরিবারের গল্পগুলো টুকে নিতে পারেন। যে ভাবা সেই কাজ। লকডাউনের পুরোটা সময় তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। একেকটা ‘বিশেষ শিশু’কে ঘিরে কত ঘটনা! এরপর সেই গল্পগুলোকে বানিয়ে তুলেছেন কবিতা। তাঁর ওই কবিতাগুলো নিয়ে হয়েছে একটা কাব্যগ্রন্থ।

মহামারিতে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন পাবলিশার্স একটা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বের ৩০টি দেশের ৩০ জন লেখকের মহামারিকালের ভাবনা নিয়ে একটা বই প্রকাশ করেছে তারা। মরিশাসের এক সাংবাদিকের কলমে সেখানকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলো কীভাবে ভয়ের ছায়ায় হারিয়ে গেল, উঠে এসেছে সে কথা। প্যারিসের এক লেখকের গল্পে ছিল মহামারির ভীতিকর দিনে তাঁর ছোট ছেলেকে স্বাভাবিক রাখার সংগ্রাম। চিলির গল্পে আছে আন্দোলনকারীদের কথা। তারা পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ইটপাটকেলের সঙ্গে লড়াই করছিল। আর এখন সেই জায়গা নিয়েছে করোনাভাইরাস। যুক্তরাষ্ট্রের এক লেখক আবার লিখেছেন এক চিকিৎসকের বৃত্তান্ত। ১৩ ঘণ্টা ডিউটি শেষে তিনি যখন বাড়ি ফেরেন, তখন তিনি কী ভাবেন?

মার্কিন কবি মারিয়া জেমস-থিয়াউয়

অল্প কথায় যদি উপসংহার টানতে হয়, তবে বলতে হবে, করোনাকালে আগে থেকেই যাঁরা পাঠক ছিলেন, এই দমবন্ধ সময়ে তাঁরা আরও বেশি পাঠক হয়েছেন। এ সময় কিছু ‘অপাঠক’ যেভাবে ‘পাঠক’ হয়েছেন, একইভাবে অলেখকও ‘লেখক’ হয়েছেন। আর নিয়মিত লেখকদের অনেকেই পড়েছেন খানিক বেকায়দায়। কেউ কেউ যদিও আগের মতোই লিখছেন, তবে বেশির ভাগেরই লেখার বিষয়বস্তু বদলে গেছে। আবার এমন পরিস্থিতিতে কারও কারও লিখতে ‘ভাল্লাগছে না’ অবস্থাও হচ্ছে। কেউবা ভুগছেন রাইটার্স ব্লকে, কলম থেকে বের হচ্ছে না একটি অক্ষরও। এত সব বদলে লেখক-পাঠকের দিনগুলোও যে আর আগের মতো নেই, তা মুখে আর না বললেও চলে।

সূত্র: রেসলেসবুকস ডট ওআরজি, পেনলাইভ ডট কম, আ রিয়েল মি ডট কম, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এলে টাইমস, ইউরোপিয়ান রাইটার্স কাউন্সিল, রাইটার্স ডাইজেস্ট, দ্য বুক সেলার।