ভিন্ন চোখে

করোনাকালীন এক বছরের শিক্ষা

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনধারা। করোনাকালীন এক বছরে জীবনের এই অদলবদল থেকে কী শিক্ষা নিলাম আমরা, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন সময়ের আলোচিত চিন্তক ইউভাল নোয়াহ হারারি। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত সেই নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম

ইউভাল নোয়াহ হারারি
ইউভাল নোয়াহ হারারি

ইতিহাসের নিরিখে আমরা কি এই করোনাকালীন এক বছরের সারসংক্ষেপ করতে পারি? যদিও বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে করোনা হচ্ছে প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব। এমনকি ২০২০ আমাদের দেখিয়েছে যে অসহায়ত্ব থেকে মানবতার দূরত্ব আসলে কতখানি। মহামারি এখন আর প্রকৃতির অনিয়ন্ত্রিত শক্তি নয়। বিজ্ঞান এগুলোকে মোকাবিলাযোগ্য করে ফেলেছে। তারপরও বিশ্বজুড়ে কেন এত মৃত্যু? এত দুর্ভোগ? কারণ আর কিছুই নয়, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি।

বিগত শতকগুলোতে মানুষ যখন প্লেগ কিংবা কালমৃত্যুর শিকার হয়েছিল, তখন তারা জানত না কেন এসব ঘটছে বা এই মহামারি কীভাবে ঠেকানো সম্ভব। ১৯১৮ সালে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা আঘাত হানল, পৃথিবীর দুঁদে বিজ্ঞানীরা কেউই ভাইরাসটিকে খুঁজে বের করতে পারছিলেন না। তাঁরা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন।

ওই সময়টা ছিল কোভিড-১৯ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সময়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়। এর মাত্র কয়েক দিন পর ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে বিজ্ঞানীরা শুধু ভাইরাসটিকে শনাক্ত করতেই সক্ষম হননি, বরং এর জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে অনলাইনে তথ্য প্রকাশ করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ভাইরাসের শিকল কীভাবে ছিন্ন করা সম্ভব এবং এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সম্ভাব্য কার্যকর টিকা পর্যন্ত তৈরি হয়ে যায়। মানুষ ও জীবাণুর মধ্যে যুদ্ধে মানুষ ইতিপূর্বে কখনোই এতটা শক্তিশালী ছিল না।

জীবন ঘুরছে অনলাইনে

করোনার এই বছর একদিকে যেমন জীবপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব অর্জনকে সামনে এনেছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির শক্তিকেও দেখিয়ে দিয়েছে। ১৯১৮ সালে আপনি মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারতেন কিন্তু সংক্রমণের পূর্বধারণা করতে পারতেন না, কে ভাইরাস বহন করছে আর কে করছে না, তা বুঝতে পারতেন না। ফলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে আপনি যখন মানুষকে ঘরে বন্দী করে রাখতেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই
অর্থনীতি ভেঙে পড়ত, সামাজিক শৃঙ্খলা
নষ্ট হতো এবং অনেক মানুষ স্রেফ অনাহারে মারা যেত।

২০২০ সালে এসে আপনি কী দেখছেন? কোন কোন এলাকা কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে, কোন এলাকা নিতে হবে না, ভাইরাসটা কোথায় বেশি ছড়াচ্ছে, কোথায় কম ছড়াচ্ছে—এসব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা সহজ করে দিয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে অটোমেশন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে লকডাউন খুব একটা ভয়াবহভাবে মানুষের ক্ষতি করতে পারেনি। উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিপ্লব সবকিছু বদলে দিয়েছে।

কৃষির কথা ভাবুন। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং ফসল উৎপাদন করত। এখন উন্নত দেশগুলোতে খুব বেশি মানুষ আর কৃষিকাজ করে না। যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দেড় শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে। এই অল্প কিছু মানুষ যা উৎপাদন করে, তা দিয়ে শুধু দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদাই মেটায় না, বরং যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের অন্যতম এক ফসল রপ্তানিকারক দেশ। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে। লকডাউন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিতে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে।

করোনাকাল বদলে দিয়েছে মানুষের অনেক আচরণ। এখন লকডাউনের সময় অনেক ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট যেমন ফাঁকা হয়ে যায়, তেমনি জীবনে এসেছে আরও অনেক পরিবর্তন, ১৪ এপ্রিল ২০২১

পৃথিবীতে যখন কালমৃত্যু থাবা বিস্তার করেছিল, তখনকার একটা গমখেতের কথা কল্পনা করুন। তখন ফসল কাটার সময় কৃষকদের যদি ঘরে থাকতে বলা হতো, তাহলে কী হতো? দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। যদি কৃষকদের ফসল কাটতে বলা হতো, তাহলে তারা ভাইরাসে আক্রান্ত হতো। উভয়সংকট! কী করবে তারা?

এখন ২০২০ সালে একই দৃশ্য কল্পনা করুন। একটামাত্র জিপিএস মেশিন দিয়ে আপনি ফসল কাটতে পারেন, যেখানে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা শূন্য। ১৩৪৯ সালে কৃষকেরা যেখানে দিনে পাঁচটি গমখেতের গম কাটতে পারত, সেখানে ২০১৪ সালে তারা যন্ত্রের সাহায্যে দিনে ৩০ হাজার খেতের গম কেটেছে। খেয়াল করে দেখুন, কোভিড-১৯ ধান, গম, ভুট্টা উৎপাদনে কোনো ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি।

তো ফসল উৎপাদনই তো যথেষ্ট নয়। আপনাকে সেই ফসল বা শস্য পরিবহন করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যেতে হবে। মাঝেমধ্যে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে নিতে হবে। ইতিহাস বলছে, মহামারির সময় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমণ হচ্ছে সবচেয়ে বড় খলনায়ক। আগের যুগে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি মহামারি ছড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কালমৃত্যু পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়েছিল সিল্ক রোডের মাধ্যমে।

২০২০ সালের বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থাটা কেমন? লাখ লাখ মানুষ কি এর সঙ্গে জড়িত? না। খুব সামান্য মানুষ জড়িত। বেশির ভাগ পণ্যবাহী জাহাজ এখন অটোমেটেড। ফলে খুব বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ১৫৮২ সালে একজন ব্রিটিশ বণিকের ৬৮ হাজার টন পণ্য জাহাজে তুলতে ১৬ হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। আর ২০১৭ সালে হংকংয়ের এক জাহাজে দুই লাখ টন পণ্য তুলতে শ্রমিক লেগেছে মাত্র ২২ জন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী জুমেই মিটিং সারছেন। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা মোটেও ব্যাহত হয়নি।

প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে চাকরিক্ষেত্রে। ১৯১৮ সালে লকডাউনের মধ্যে অফিস-আদালত, কোর্ট-কাছারি, স্কুল-কলেজের কাজকর্ম চালু রাখা ছিল অসম্ভব কল্পনা। এখন আমরা কী দেখছি? সবকিছুই প্রায় অনলাইনে চলছে। তবে যারা ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করছে, তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতির চোখে তাকাতেই হবে। কারণ, তাদের কাজটা শারীরিক। এখনো তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ইন্টারনেট ধরে রেখেছে সবকিছু

একটা সেতুর কথা কল্পনা করুন। হঠাৎ সেতুটাতে যদি যানবাহনের চলাচল বেড়ে যায় এবং ২৪ ঘণ্টাই চলতে থাকে, তাহলে কী হবে? সেতুটা একসময় ভেঙে পড়বে। ইন্টারনেটও একধরনের সেতু। ২০২০ সালে এই সেতুর ব্যবহার হঠাৎ বেড়ে গেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত—সবখানেই ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারনেট নামের সেতুটা এখনো ভেঙে পড়েনি। সে সবকিছুকে ধরে রেখেছে।

তবে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, ভাইরাস যেমন আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি ইন্টারনেটের ভাইরাসও কম ক্ষতিকর নয়। ‘সাইবার অপরাধ’ শব্দটি এখন আমরা প্রায়ই শুনি। মানুষ আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করে, পরবর্তী কোভিড কোনটি? আমি বলি, ম্যালওয়্যার বা ইন্টারনেট ভাইরাস। আমরা যেভাবে ডিজিটাল জীবনে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি, তাতে একমুহূর্তে এই ভাইরাস আমাদের জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে।

তাহলে গুরুত্ব দেব কিসে?

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির এত সব অভূতপূর্ব সাফল্যের পরও বিজ্ঞান কিন্তু রাজনীতির বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিকভাবে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার মূল্যবোধ, আদর্শ কিংবা গুরুত্ব পরিমাপ করার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক মাপনযন্ত্র তৈরি হয়নি। সুতরাং রাজনৈতিকভাবে আমাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়, তা বিজ্ঞান দ্বারা নির্ধারিত হয় না।

উদাহরণ দিয়ে বলি। আমরা যখন লকডাউন দিই, তখন কি শুধু এটাই ভাবি যে লকডাউন না দিলে কত মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হবে? না। আমাদের আরও চিন্তা করা উচিত যে লকডাউন দিলে কত মানুষ মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হবে। কত মানুষ অপুষ্টিতে ভুগবে। কত ছেলেমেয়ে স্কুলের পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হবে। কত মানুষ চাকরি হারাবে। কত মানুষ গৃহে নির্যাতনের শিকার হবে ইত্যাদি।

এসব বিষয়ে আমাদের কাছে যদি পর্যাপ্ত তথ্যও থাকে, তারপরও প্রশ্ন করা উচিত যে আমরা কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। কে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে বিজ্ঞানের চেয়ে রাজনীতির অবদান বেশি। রাজনীতিবিদেরাই স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন।