জাপানের মতো কাগজের এতটা বিচিত্র ব্যবহার পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। শুধু লেখালেখি আর ছাপার কাজে ব্যবহারের মধ্যে কাগজের চাহিদা জাপানে সীমিত নেই। কাগজ এখানে প্রাচীনকাল থেকেই নানাভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। জাপানের বাড়িঘরের দরজা–জানালায় যেমন কাগজের ব্যবহার এখনো সহজেই চোখে পড়ে, পাশাপাশি জাপানের বিশেষ কাগজ ওয়াশি বাড়ির ভেতরে দেয়াল বা পার্টিশনের কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে কাগজ দিয়ে নানা রকম বস্তু বা কার তৈরি করে নেওয়ার যে শিল্পচর্চা, ওরিগামি নামে পরিচিত জাপানের সেই শিল্পকলার জন্যও আছে বিশেষ একধরনের কাগজ। কাগজের তৈরি পোশাকও দূর অতীতকাল থেকে জাপানে সমাদৃত। ফলে কাগজের এই ব্যবহারিক বৈচিত্র্যের ভাবনা সামনে রেখেই এর সঙ্গে মানুষকে আরও বেশি পরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে জাপানের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে কাগজের জাদুঘর। এসব জাদুঘরের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো টোকিওর ওজি এলাকায় অবস্থিত কাগজ জাদুঘর।
জাপানে কাগজ তৈরি দীর্ঘকাল ধরে কুটিরশিল্পের পর্যায়ে ছিল। কাগজের কারিগরেরা যখন নিজ হাতে কাগজ বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করতেন, সাধারণত লতাগুল্ম ও গাছের বাকল পানিতে গলিয়ে চালুনিতে সেই পানি ঢেলে নিলে পানি ঝরে যাওয়ার পর গলে যাওয়া লতাগুল্মের যে আস্তরণ ওপরে থেকে যায়, সেটাকে শুকিয়ে নিলে তা কাগজে রূপান্তরিত হয়। এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে কুটিরশিল্প হিসেবে কাগজশিল্প জাপানে ক্রমশ সমৃদ্ধি অর্জন করে।
তৈরির প্রক্রিয়া শুনে যতটা সহজ মনে হয়, আসলে কিন্তু তা একেবারেই নয়। কোন ধরনের লতাগুল্ম কাগজের জন্য ব্যবহার করা হবে, পানি এবং অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণ কতটা হবে, লতাগুল্ম কতটা সময় ধরে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে—এ সবকিছুর ওপর কাগজের মান অনেকাংশে নির্ভরশীল এবং দক্ষ কারিগরেরা সেই জ্ঞান ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছিলেন বলেই উন্নত মানের কাগজ জাপানে প্রাচীনকাল থেকে তৈরি হয়ে আসছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জাপান আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু করলে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের কারখানায় তৈরি কাগজ জাপানে আসতে শুরু করে এবং আরও কিছুটা পরে জাপান নিজে থেকে কাগজ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিলে সেই সময়ের তুলনায় খুবই আধুনিক একটি কারখানা ১৮৭৩ সালে টোকিওর ওজি এলাকায় গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে জাপানের কাগজ উৎপাদকেরা কাগজের একটি জাদুঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণে রেখে স্থান হিসেবে টোকিওর ওজি এলাকাকেই তাঁরা বেছে নেন এবং ১৯৫০ সালে টোকিও কাগজ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
কী আছে কাগজ জাদুঘরে
টোকিওর কাগজের জাদুঘর কাগজের ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করা ছাড়াও যোগাযোগ এবং মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে কাগজের অবদান নানা রকম উপাদানের প্রদর্শনী ও বর্ণনার মধ্যে তুলে ধরছে। চারতলা ভবনে আছে ৪০ হাজারের বেশি প্রদর্শন সামগ্রী এবং হাজার দশেক বই। স্থায়ী প্রদর্শনীতে আছে কাগজের দুই হাজার বছরের ইতিহাসের নানা দিক। ইতিহাসের বর্ণনার পাশাপাশি কাগজের নমুনা হিসেবে বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন জায়গার জাপানি ওয়াশি পেপার ছাড়াও আছে পশ্চিমের বিভিন্ন নানা দেশে উৎপাদিত কাগজ এবং একালের রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারের কাগজ। বিষয়গত বিভাজনের দিক থেকে আছে কাগজের জন্ম, বিশ্বজুড়ে কাগজের ছড়িয়ে পড়া এবং জাপানের ওয়াশি কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া।
এ ছাড়া বাইরের বাগানে আছে নানা রকম উদ্ভিদ ও গাছ, কাগজ তৈরির প্রক্রিয়ায় যেগুলো সাধারণত ব্যবহার করা হয়। ২ হাজার ২০০ বর্গমিটার ফ্লোর স্পেস বা ব্যবহারের জায়গা নিয়ে টোকিওর কাগজ জাদুঘরকে কাগজের ওপর আলোকপাত করা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি জাদুঘর হিসেবে গণ্য করা হয়। এক তলার প্রবেশপথ পার হয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেলে সেখান থেকে শুরু হয়েছে জাদুঘরের নানা রকম উপস্থাপনা। কাগজ কীভাবে তৈরি করা হয়, সেই প্রক্রিয়ার দেখা এখানে মেলে। কাগজ তৈরির প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ছাড়াও কাগজের কারখানা এবং ছাপাখানার মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্রাকৃতির মডেলও এখানে রাখা আছে।
তৃতীয় তলায় কাগজের গুরুত্ব সম্পর্কে শিশু–কিশোরদের সচেতন করে তোলার জন্য টাচ স্ক্রিন প্যানেলে সহজ ভাষায় কাগজসম্পর্কিত সচিত্র বর্ণনা তুলে ধরা আছে। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এর মধ্য দিয়ে কাগজের ইতিহাস থেকে শুরু করে এর ব্যবহারের নানা দিক সহজেই জেনে নিতে সক্ষম। কাগজের রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারের গুরুত্বের বিষয়টিও এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
চতুর্থ তলায় কাগজের ইতিহাসের ধারাবর্ণনা ছাড়াও আছে বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য নির্ধারিত হলঘর। মিসরের প্যাপিরাস থেকে শুরু করে গাছের বাকলে বৌদ্ধধর্মের সূত্রের লিখন এবং জাপানের ওয়াশি কাগজের নানা ধরনের নমুনার দেখা এখানে মেলে। এ ছাড়া কাগজের তৈরি কিমোনো, কাগজ দিয়ে তৈরি করে নেওয়া জাপানের পরিচিত দুর্গের রেপ্লিকা বা নকল, কাগজের ছাতা, পুতুল—এ সবকিছুও সেখানে জায়গা করে নিয়েছে।
শিক্ষণীয় কার্যক্রম
স্থায়ী এবং সাময়িক প্রদর্শনীর বাইরে কাগজ তৈরির কর্মশালার আয়োজনও জাদুঘর করে থাকে। সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি কর্মশালা হচ্ছে ওয়াশি কাগজের পোস্টকার্ড তৈরি করে নেওয়ার কর্মশালা। দুধের ফেলে দেওয়া কার্টন এ ক্ষেত্রে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সবাই এতে অংশ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ওরিগামি তৈরির কর্মশালার আয়োজনও জাদুঘর করে।
আগামী বছর টোকিওতে অনুষ্ঠিত হবে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এ উপলক্ষে টোকিওর বিভিন্ন পর্যটনের স্থানগুলোকে ঢেলে সাজানোর যে প্রক্রিয়া জাপানের রাজধানীতে এখন চলছে, তা থেকে বাদ যায়নি কাগজের জাদুঘরও। পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে জাদুঘর বন্ধ রাখা হয়েছে এবং এর দুয়ার আবারও খুলে দেওয়া হবে আগামী বছরের ১৬ মার্চ।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক
জাপানের ওয়াশি কাগজ
খসখসে উপরিভাগের এই কাগজ অনেক আগে থেকেই জাপানে সমাদৃত হয়ে এলেও পশ্চিমের দেশগুলোতেও বিশেষ করে শিল্পীদের কাছে এটা যথেষ্ট জনপ্রিয়। বলা হয় ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ ছিলেন ওয়াশি কাগজের বড় এক ভক্ত। তিনি মনে করতেন, কাগজে রঙের এতটা বাহারি ছাপ কেবল ওয়াশি কাগজই তুলে ধরতে সক্ষম। ভ্যান গঘ ছাড়াও ক্লদ মনে, আঁরি মাতিস এবং পিকাসোর মতো শিল্পীরাও ওয়াশি কাগজে ছবি এঁকে আনন্দ পেয়েছেন। আর জাপানের ছাপচিত্র তো ওয়াশি ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। জাপানে অবশ্য ছবি আঁকার বাইরে ল্যাম্পশেড, জানালার ফ্রেমে সাঁটা পর্দা হিসেবেও ওয়াশির ব্যবহার সমাদৃত।
ওয়াশি হচ্ছে হাতে তৈরি কাগজ। ফলে একই কারিগরের তৈরি ওয়াশির প্রতিটি কাগজে ভিন্ন বয়নবিন্যাস সহজেই লক্ষ করা যায়। সাধারণত তুঁতগাছের বাকল ওয়াশি কাগজ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বাকল নির্দিষ্ট সময় ধরে পানিতে ভিজিয়ে রেখে এরপর চালুনিতে সেই মণ্ড ঢেলে নিয়ে পানি ঝরে যাওয়ার পর শুকিয়ে নিলে কাগজ তৈরি হয়ে যায়। তবে মণ্ড যেন সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সে জন্য পানি ঝরানোর প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিকভাবে চালুনি নড়াচড়া করে নিতে হয়। জাপানে অবশ্য আজকাল কারখানাতেও ওয়াশি কাগজ তৈরি হয়। বিশেষ করে বাড়িতে ব্যবহারের ওয়াশি হচ্ছে কারখানায় তৈরি।