দ্বিজেন শর্মার অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

এখনো আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনকে আমার কাছে প্রসাধনমূলক মনে হয়

দ্বিজেন শর্মা ( ২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
দ্বিজেন শর্মা ( ২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

লেখক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, নিসর্গী, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী—কত-না পরিচয় দ্বিজেন শর্মার। আগামীকাল তাঁর প্রথম মৃত্যুদিন। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি মূলত কথা বলেছিলেন পরিবেশ ও ঢাকা নিয়ে। তাঁর কথায় উঠে এসেছে নানা সময়ের ঢাকার আলো-হাওয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোকারম হোসেন

মোকারম হোসেন: বাংলা সাহিত্যে নানাভাবে এসেছে নিসর্গ। নিসর্গকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। আপনাকে কার লেখা সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে?

দ্বিজেন শর্মা: অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বনবাণী ও আরণ্যক আমাদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া প্রয়োজন। জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদ্‌দীনকেও নানাভাবে পাঠ করেছি। আমার লেখায় এঁদের প্রসঙ্গ নানাভাবে ঘুরেফিরে এসেছে।

মোকারম: শুধু লেখালেখির মাধ্যমেই নয়, পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়-আশয় নিয়ে নানাভাবে সক্রিয় আপনি। আর আমরা এখন প্রায়ই বলি যে বর্তমানে পরিবেশ-সংকটের মুখোমুখি সমগ্র মানবজাতি। সংকটটা আসলে কী?

দ্বিজেন: প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে জীবজগৎ পরিচালনা করে। ডারউইন এটা আবিষ্কার করেছিলেন। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে জীবজগতের মধ্যে একটা নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। তাদের নিজেদের সঙ্গে, অন্য প্রজাতির সঙ্গে—এমনকি জড়জগতের সঙ্গেও লড়াই চলছে। কিন্তু প্রকৃতি সব সময় নানাভাবে তার জীবসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। সৃষ্টির মধ্যে যারা অধিক যোগ্য, জেনেটিক্যালি সুবিধাপ্রাপ্ত, তারা টিকে থাকে। আর যারা সে সুবিধা বংশগতিতে পায়নি, তাদের বিলুপ্তি ঘটে। আমাদের কৃষিসভ্যতা প্রায় ১০ হাজার বছরের পুরোনো। শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা আরও বড় হাতিয়ার পেলাম—বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; যা দিয়ে প্রকৃতির মধ্যে আমরা নিজেদের স্থান আরও পাকাপোক্ত করতে পারি। এভাবে আমরা প্রকৃতির একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছি। রাসেল কারসনের সাইলেন্ট স্প্রিং বইয়ের মাধ্যমে প্রথম এ চেতনা মানুষের মধ্যে দেখা দেয় যে, এই সভ্যতা, নিরাপত্তা, আরও উন্নত জীবনযাত্রা, বিলাস-ভূষণের প্রয়োজনে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে প্রকৃতির শৃঙ্খলকে আমরা দুর্বল করে দিচ্ছি। এমনও হতে পারে এই শৃঙ্খল ভাঙলে আমরা বিপন্ন হব। বাস্তবেও দেখা গেল তা-ই। ১০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপ ধারণ করে। বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ। কার্বন ডাই-অক্সাইড এর চেয়ে কমে গেলে পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে যাবে, যা আমাদের বাঁচার পক্ষে সহায়ক হবে না। আবার যদি বাড়ে তাতেও নানা সমস্যা দেখা দেবে।

শিল্পোৎপাদনের জন্য আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। শিল্প এমন সব বর্জ্য উৎপাদন করে যা প্রকৃতি কখনো করেনি। এগুলো নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়াও তার মধ্যে নেই। এতে আখেরে মানুষেরই ক্ষতি হয়। তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বাড়ার ফলে ওজোন স্তর ক্ষয় হচ্ছে। এতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে আসছে, যা জীবজগতের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ার ফলে সাগরজলের স্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। সাগরের উপরিভাগ উঁচু হচ্ছে, এতে আমাদের নিম্নাঞ্চল ডুবে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, খরা-বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক নিয়ম বদলে যাচ্ছে। আমরা যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড কমাতে চাই, সেটাও আমাদের আয়ত্তে নেই। কতগুলো বৈশ্বিক সম্মেলন হয়ে গেলেও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছা যাচ্ছে না। কারণ, ঐকমত্যে পৌঁছাতে হলে দূষণমুক্ত নতুন শিল্প দরকার। আবার, কার্বন ডাই-অক্সাইড কমালে আমাদের শিল্পোৎপাদন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ, প্রতিবেশের যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা নিরসনের উপায় আমরা জানি না।

মোকারম: আমাদের দেশে এর প্রভাব কতটা ব্যাপক ও বিস্তৃত?

দ্বিজেন: বাংলাদেশের জন্য বিশেষ যে সংকট তা হলো, দেশটা খুব ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। এখানে যেকোনো রকমের উন্নয়নেই পরিবেশ কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দূষণ বাড়বে। কারণ, উন্নয়ন পরিবেশ-সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। সম্প্রতি সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক শক্তিকেন্দ্র হতে যাচ্ছে, যা এই ম্যানগ্রোভ বনটি ধ্বংসের কারণ হতে পারে।

সরকারের ভুল পরিকল্পনায় এখন বলতে গেলে তেমন কোনো বনই অটুট নেই। সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা হচ্ছে। বন বিভাগ ও সংঘবদ্ধ কাঠ পাচারচক্র আমাদের বন উজাড় করে চলেছে। আমাদের নদী, হাওরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও যাচ্ছে বেড়ে। এতে নদীর স্রোত কমে লবণাক্ত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে। এভাবে সারা দেশ জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সব মিলিয়ে আমাদের সামনে বিরাট বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

মোকারম: এমন একটি পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় আমরা কতটা সচেতন হতে পেরেছি বলে মনে করেন?

দ্বিজেন: দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো জীবন মান উন্নয়নের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। সিংহভাগ মানুষ এখনো দুবেলা খাবারের জন্য ছুটছে। যাদের এসব ভাবার সুযোগ আছে, তারা আরও বিত্তবৈভব নিয়ে ব্যস্ত। এই প্রবণতা আরও দীর্ঘ সময় অব্যাহত থাকবে। একসময় মানুষ আবার মূলধারায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এখনো আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনকে আমার কাছে প্রসাধনমূলক মনে হয়। কারণ, এটা কয়েকটা শহরে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ। এতে কার্যকর কিছু হবে না।

মোকারম: প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা শহরের নানান পরিবর্তন দেখেছেন। এর মধ্যে পরিবেশগত পরিবর্তন কতটা হয়েছে বলে মনে করেন?

দ্বিজেন: আমি ১৯৫৬ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি। তখন তেজগাঁওয়ে থাকতাম। তেজগাঁও তখন শহরতলি। এরপর শহরের আর কোনো চিহ্ন ছিল না। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রমনা গ্রিন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ১৯৬৫ সালের দিকে আমি সিদ্ধেশ্বরী চলে আসি। প্রায় প্রতিদিনই আমি এবং বন্ধু আলী আনোয়ার এই এলাকায় কত যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কী যে সুন্দর! সেই হেয়ার রোডের রাত, মিন্টো রোডের রাত, বেইলি রোডের রাত, রাস্তার নিয়ন আলো এবং এই দুর্মর সবুজ, ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তন, কত ফুল, কত গাছ—এগুলো নিয়েই আমার যে বই তার নাম রেখেছি শ্যামলী নিসর্গ। তাতে ওই অঞ্চলের ছবি অনেকটাই ধরা পড়েছে, যা এখন ইতিহাস। এখন অনেক গগনচুম্বী দালান হয়েছে, গাছপালা কাটা পড়েছে। রমনা-নিসর্গের স্থপতি প্রাউডলক সমগ্র রমনা অঞ্চল নিয়ে যে মহা পরিকল্পনা করেছিলেন তার যৎসামান্য এখনো রমনা গ্রিনে আছে, আমরা সেটাকে অনুসরণ করিনি। রাস্তার দুই পাশ বাদ দিয়ে আমরা এখন সড়ক বিভাজকে গাছ লাগানোর চেষ্টা করি; যা মোটেও শৈল্পিক বা টেকসই কিছু নয়। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা তখন ছিল ১৫ লাখ, এখন ২ কোটির কাছাকাছি। আমরা তখন বেইলি রোডে হেঁটে বেড়িয়েছি, একটা গাড়িও হয়তো দেখিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন সিদ্ধেশ্বরীতে আমার বাড়ির সামনের রাস্তাই আমি পার হতে পারি না। সবকিছুই একেবারে বদলে গেছে।

মোকারম: বর্তমানে ঢাকা প্রায় বৃক্ষহীন। নিকট ভষ্যিতে এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে?

দ্বিজেন: প্রায় ৬০ বছরের ব্যবধানে আমার দেখা ঢাকা অনেকটাই বদলে গেছে। ঢাকা এখন আর আগের মতো সবুজ নয়। আমরা এখন উল্লম্ব কংক্রিটের স্লামে বসবাস করছি। নেই যথেষ্ট পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান এবং প্রশস্ত ও ছায়াঘন রাস্তা। শিশুরা বন্দী বহুতল ভবনের খাঁচায়। তরুণেরা ব্যস্ত মুঠোফোন ও ইন্টারনেটে। অন্যরা টিভিতে। শহরের ‘গভীরতর অসুখ এখন’। এ বিষয়ে সরকারও অনেকটাই উদাসীন। আমরা হতবাক। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আমাদের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

মোকারম: ঢাকাকে আবার উদ্যান নগর হিসেবে গড়ে তোলার কোনো সুযোগ আছে কি?

দ্বিজেন: কাজটি শ্রম ও সময়সাধ্য, কঠিন তো বটেই। একসময় যা সহজসাধ্য ছিল, আজ তা দুঃসাধ্য। বাড়িঘর ভেঙে ফেলে স্পেস তৈরি সম্ভব নয়। যা এখনো সম্ভব তা হলো, দ্রুত রেলযোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। যাতে দূর-দূরান্তের লোকজন ঢাকায় বাস না করেও এখানে এসে কাজ করে বাড়ি ফিরতে পারে। প্রয়োজন সরকারি দপ্তরগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ এবং জেলা ও উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ন, যাতে মফস্বল থেকেই লোকজন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সর্বোত্তম সুযোগ পেতে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আবাসনের নীতি পরিবর্তন, ব্যক্তিমালিকানার বদলে সামষ্টিক মালিকানার ভিত্তিতে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণও পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া উচিত। তা ছাড়া ঢাকার ফুটপাতে গাছ লাগানো এবং সব খালি জায়গা দখলমুক্ত করে সেখানে নানা ধরনের পার্ক নির্মাণ নগরজীবনে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।