কবির জার্নাল

এই কক্সবাজার, মান্টো আর সেই মেয়েটি

মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীর দল। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীর দল। ছবি: রয়টার্স

হঠাৎ যাত্রা কক্সবাজারের উদ্দেশে। আমাদের ভাগনে গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুনিমের কক্সবাজারে পোস্টিং, অনেক দিন থেকে বলছিল ওর ওখানে যেতে। চমৎকার আবহাওয়া, গেলে খুব ভালো লাগবে। লোভ সংবরণ করা গেল না। আমি ও আমার স্ত্রী রাকা, আমরা দুজন রওনা হয়ে গেলাম।

এয়ারফোর্স বেজের অতিথি ভবনের বিশাল এক কক্ষে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো।

কক্সবাজারে শেষবার কবে গিয়েছিলাম মনে ছিল না, তাই তর সইছিল না, বিকেলেই চলে গেলাম সমুদ্রসৈকতে, অনেক দিন পর শুনতে পেলাম সমুদ্রের গর্জন আর দেখলাম অসংখ্য লোকের ভিড়। না, সবাই–ই সমুদ্রদর্শনে আসেননি; চেহারা দেখে, পরিধেয় দেখে, আর আগে থেকে খবরের কাগজ পড়া থাকায় বোঝা যাচ্ছিল এঁদের অনেকে ছিন্নমূল, মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষ। নারী ও পুরুষ, বালক-বালিকাদের অধিকাংশ সাহায্যের জন্য সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়াচ্ছিল, আবার কিছু লোক এদের দূর দূর করে তাড়িয়েও দিচ্ছিল। মন খারাপ হয় তো। সন্ধ্যাবেলা লাবণি পয়েন্টের সৈকতে বিশাল ছাতার নিচে বেশ অনেকক্ষণ বসে সমুদ্র ও মানুষজন দেখলাম। মুনিম জানাল, সমুদ্রসৈকত রাত হয়ে গেলে নির্জন হলেও খুব নিরাপদ। খারাপ লাগল, প্রচুর নারী ও শিশু ভিক্ষা চেয়ে ফিরে ফিরে আসছিল। আমরা হোটেল সায়মনের কলাতলী বিচের দিকে গিয়ে দেখলাম ওই জায়গাটি তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন। সুগন্ধা সমুদ্রতীর অপরিচ্ছন্ন, লাবণিও নোংরা, চারদিকে প্রচুর ডাবের খোসা, নানা রকম আবর্জনা।

বোঝা যাচ্ছিল, আমাদের এবারের ভ্রমণ সুখের হবে না; বা ভ্রমণটি আরামপ্রদ হলেও মানুষের চরম দুর্দশার মুখোমুখি না হয়ে আমাদের উপায় থাকবে না। তবে এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না যে তা-ও নয়।

দ্বিতীয় দিন গন্তব্য ছিল রামু, যেখানে প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে অনেক। গিয়ে প্রথমেই দেখতে গেলাম টিলার ওপরে বৌদ্ধবিহার, যেখানে রয়েছে বুদ্ধের ১০০ ফুট দীর্ঘ শায়িত মূর্তি। এখানেই সম্ভবত ১৯১৪ কিংবা ১৫-তে বুদ্ধমূর্তি এবং মন্দিরও ভেঙে ফেলেছিল দুর্বৃত্তরা, পরে সরকার সব ঠিকঠাক তৈরি করে দিয়েছে। আমরা গিয়ে দেখি সেখানে কঠিন চীবর দান উৎসব চলছে। প্রচুর লোকজনের জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। অনেক ছবি তোলা হলো এখানে। বেশ কিছুক্ষণ থেকে এরপর গেলাম ঐতিহাসিক রাংকুট বনাশ্রম মহাতীর্থ মহাবিহার দেখতে। ২৬৮ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে সম্রাট অশোক এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চলে আরও কিছু প্রাচীন নিদর্শন দেখা হলো।

সন্ধ্যাবেলা মুনিমকে আমার অল্প বয়সে বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে করাচি বাসকালে কীভাবে কেটেছে সেই গল্প করতে করতে সমুদ্রসৈকতে দ্রুত হেঁটে বেড়ালাম আমি। মুনিমেরও নানা দেশ ভ্রমণের গল্প শোনা হলো।

পরদিন শায়েস্তা খান নামে মুনিমের বন্ধুস্থানীয় এক হাসিখুশি ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে কক্সবাজার থেকে ৩০–৩৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। ঘন অরণ্যের ভেতরের পথ ধরে মাইক্রোবাসে আমরা কয়েকজন যাত্রা শুরু করে ঘণ্টা তিনেক পরে সেখানে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি বিশাল এলাকাজুড়ে অস্থায়ী বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যায় আসা শরণার্থীর জন্য। জনাব খানের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি স্কুলকক্ষ তৈরি করা হয়, যেগুলোতে নানান বয়সের বালক-বালিকারা নানান বিষয়ের বই পড়ছিল উচ্চস্বরে।

আমরা যে দুটি কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম, সেখানে উঁচু স্বরে দুলে দুলে পবিত্র কোরআন পড়া হচ্ছিল, দেখলাম। অন্যটিতে বার্মিজ ভাষায় প্রাথমিক স্তরের বই পড়ানো হচ্ছিল বলে আমাদের জানানো হলো। এখানে ইংরেজি ও অঙ্কও পড়ানো হয়। বই দেখে মনে হলো এসবও একেবারে প্রাথমিক স্তরের। কৌতূহলোদ্দীপক লাগল, বার্মিজ ভাষাও যে এখানে পড়ানো হয়; আবার বাংলা যে পড়ানো হয় না। জানতে চাইলাম, কেন? শায়েস্তা খান জানালেন, যদি কোনো দিন এরা বার্মায় ফিরে যেতে পারে, তখন যাতে কাজে লাগাতে পারে। হায়, ভাবলাম, তা-ও সম্ভব হবে কি না, যেভাবে এদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, গুলি করে, আগুন লাগিয়ে, হত্যা করে। এই ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে চারদিকে যত দূর চোখ যায় দেখছিলাম ক্যাম্প আর ক্যাম্প, কয়েকটি টিলাজুড়ে উদ্বাস্তুদের অসংখ্য ঘরবাড়ি। সত্যি, এখানে না এলে কোনো দিনই জানা হতো না এখানকার অবস্থা কতখানি ভয়াবহ। বোঝা কঠিন সামনের দিনগুলোও যে কতখানি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ফেরার পথে আমরা ইনানি সৈকতেও গেলাম। আসলে আমাদের কক্সবাজারের সৈকতগুলো সত্যিই অসাধারণ, আমার দেখা পৃথিবীর কয়েকটি দেশেরই সৈকতের তুলনায়।

দুই.

সা’দত হাসান মান্টোর ‘কালি সেলওয়ার’ গল্পের ছোট সিনেমাটি দেখে মন খারাপ হলো খুব। কয়েক দিন ধরেই কষ্ট মনে খুব। দুবার দেখা হয়েছে। আবারও দেখা হতে পারে। মান্টো সাব পারেনও বটে মানুষকে কাঁদাতে। যে মেয়েটি দেহ না বেচে বাঁচতে পারে না, তাকে নিয়ে এমন কষ্টের গল্প না লিখলে চলত না? আহা, মেয়েটির মুখে কী যে মায়া! তারও থাকে বন্ধু, বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে কী স্বতঃস্ফূর্ত হাসি তারও মুখে। খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের বাড়িতে গিয়ে সেদিন গল্প করছি, গল্প করছি আর হঠাৎ মনে পড়ে গেল মেয়েটির কথা, ‘কালি সেলওয়ার’–এর। কথা গেল থেমে। গাঢ় হলো স্বর। চোখ ছলছলে। ডেকে যে খরিদ্দারকে আনা হলো, সে দরাদরি করছে। কত নেবে? কী বলবে মেয়েটি? ছেলেটি কী বলল, তিন টাকা? আর মেয়েটি তাতেই খুশি! না হলে কোথায় যাবে? কোথায়? কোথায়?