এটা খুব ভালো কুইজ হতে পারত: বলুন তো, ইতিহাসের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়া অধিনায়কের জন্ম কোথায়? ক্রিকেটের বইপোকা না হলে প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া এমনিতেই কঠিন হতো। ব্র্যানসবি কুপারের জন্ম যে এই বাংলাদেশে, ঢাকায়!
হতে পারত, কিন্তু কুইজটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৮৭৭ সালে, টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম হলো যে ম্যাচ দিয়ে, সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া দলের নেতৃত্বভার পেতে পেতেও পাওয়া হয়নি কুপারের। তাতে কী! ১৪২ বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু হয়েছিল যে ম্যাচ দিয়ে, সেই ম্যাচে ঢাকায় জন্ম নেওয়া এক ক্রিকেটার খেলেছেন, এই তথ্যও চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বৈকি।
১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। চমকে দিয়ে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। আর সেই দলের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন কুপার। সাধারণত উইকেটকিপিং করলেও সেই ম্যাচে অবশ্য পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবেই খেলেছিলেন। যদিও প্রথম ইনিংসে করেছেন ১৫, দ্বিতীয় ইনিংসে ৩।
ম্যাচে ১৮ রান ভুলই বোঝাচ্ছে ব্যাটসম্যান কুপার সম্পর্কে। দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের ভিত্তি যখন তৈরি হচ্ছিল, কুপার গেঁথেছেন অসংখ্য অবদানের ইট। এ কারণে প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে তাঁরই নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের মনোনয়নের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক নির্বাচিত হন ডেভ গ্রেগরি।
এই কুপারের জন্ম হয়েছিল তখনকার ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম প্রধান শহর ঢাকায়। ১৮৪৪ সালের ১৫ মার্চ। মনোযোগী পাঠক হলে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ইতিহাসের প্রথম টেস্টটাও শুরু হয়েছিল ১৫ মার্চেই, কুপারের ৩৩তম জন্মদিনে।
বাবা হেনরি কুপার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন বড় সাহেব হিসেবে ঢাকায় চাকরি করতে এসেছিলেন। ভারতে তখন কোম্পানি শাসন। লন্ডনের খুবই নামজাদা পরিবারের সন্তান ছিলেন হেনরি। হেনরির বাবা, মানে ব্র্যানসবি কুপারের দাদা ব্ল্যাক কুপার ছিলেন রয়্যাল সোসাইটির একজন ফেলো।
১৮৪০ সালে হেনরির সঙ্গে বিয়ে হয় ম্যারিঅ্যান সুইনহোর। বিয়ের কিছুদিন পর তিনি চাকরি নিয়ে চলে আসেন ভারতে। ঢাকায় কোম্পানি সার্ভিসে চাকরি করার সময়ই হেনরির দ্বিতীয় সন্তান ও প্রথম পুত্র হিসেবে জন্ম হয় ব্র্যানসবি কুপারের, ক্রিকেটে যিনি বিবি কুপার নামে পরে পরিচিত হন।
বিবি কুপার নিজেও বেশি দিন ব্রিটিশ ভারতে থাকেননি। চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তবে এই ঢাকাতেই নাড়ি পোঁতা আছে তাঁর। ১৮৪৪ সালের ১৬ জুলাই ঢাকারই একটি চার্চে তাঁকে ব্যাপ্টাইজ করা হয়েছিল। এখানেই প্রথম হামাগুড়ি দিয়েছেন, হাঁটতে শিখেছেন।
সঠিক ইতিহাস পাওয়া না গেলেও কল্পনা করতে তো ক্ষতি নেই, এই ঢাকারই কোনো একটা প্রাসাদসম বাড়ির ঘাসঢাকা উঠোনে বাবার সঙ্গে প্রথম খেলেছিলেন ক্রিকেট! ঢাকার কোনো নথিপত্রে সেই উঠোন চিহ্নিত করার আর কোনো উপায় নেই।
টেস্ট ওই একটাই খেলেছিলেন, প্রথম শ্রেণির রেকর্ডও আহামরি নয়। বরং মনে হবে, ব্যাটসম্যান হিসেবে খুব একটা সুবিধার ছিলেন না। ৫০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১ হাজার ৬০০ রান আর ২০.৫১ গড় আদতে শুভংকরের ফাঁকি। শুধু পরিসংখ্যানে খুঁজলে কুপারকে পাওয়া যাবে না, চেনা যাবে না। বোঝা যাবে না ক্রিকেটে তাঁর অবদান।
ক্রিকেট কুপারকে মনে রাখবে ডব্লিউ জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর অসাধারণ কিছু জুটির রেকর্ডের জন্যও। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে ১৮৬৯ সালে জেন্টলম্যান বনাম প্লেয়ার্সদের ম্যাচে (সে সময় অপেশাদার ক্রিকেটার জেন্টলম্যানদের নিয়ে গড়া দল ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে মুখোমুখি হতো পেশাদার ক্রিকেটার প্লেয়ার্স দলের) ডব্লিউ জি গ্রেসের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটির ২৮৩ রান। ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের এই জুটিতে গ্রেস করেছিলেন ১৮০, কুপার ১০১। যেটি রেকর্ড হিসেবে টিকেছিল পরের ২৩ বছর।
গ্রেসের সঙ্গে এর আগে-পরে আরও কিছু দারুণ জুটি গড়েছিলেন। বয়সে তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট, সে সময়ের তরুণ গ্রেসের প্রতিও তাঁর অবদান আছে, বড় ভাই হিসেবে অনেক সময়ই পথ দেখিয়েছেন সামনে থেকে। এই গ্রেসই কিন্তু পরে আধুনিক ক্রিকেটের জনক হিসেবে বিখ্যাত হন। ক্রিকেটের সেই বিখ্যাত সুরসিক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক।
১৮৬৯ সালের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন কাটিয়ে কুপার চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই থিতু হন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট তখন একেবারেই হামাগুড়ি দিচ্ছে। ভিক্টোরিয়া আর নিউ সাউথ ওয়েলসই মূলত দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট। আর ভিক্টোরিয়ার ক্রিকেটকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন কুপার। যে গ্রেস একসময় তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন ক্রিকেট মাঠে, তাঁর দলের বিপক্ষেই ১৮৭৩ সালে একটি ম্যাচ খেলেন কুপার। চার বছর পর অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্বে এমসিজিতে সূচনা হয় টেস্ট ক্রিকেটের। সেখান থেকে ক্রিকেট আজকে কোথায়! চলছে বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা। এই দীর্ঘ বর্ণিল পথের সাদামাটা যাত্রা শুরু করেছিলেন যাঁরা, কুপার তাঁদের একজন। কুপার আমাদেরও একজন!
ইংল্যান্ডে খেলে, খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মার্কিন মুলুকে থেকে শেষে অস্ট্রেলিয়াতেই বাকি জীবন কাটিয়েছেন। কুপার মারাও গেছেন সেখানেই। কিন্তু নাড়ির টান বলে কি সত্যিই কিছু আছে? ‘জন্মভূমি’ শব্দটাই–বা কেন এত আবেগ-তরঙ্গ তৈরি করে! ঢাকায় আবার কখনো সুযোগ পেলে ফিরে আসার কথা কুপার ভেবেছেন কি না, সেই সত্যিটা জানে শুধু ইতিহাস!