>১৯১৩ সালের এই মাসেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘোষণা এসেছিল। খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ নভেম্বর। নোবেল জয়ের পর কবির সম্মানে একটি অভিনন্দন সভার আয়োজন করেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ। ঢাকার নবাববাড়ি আহসান মঞ্জিলের সঙ্গে জীবদ্দশায় রবিঠাকুরের ছিল সুসম্পর্ক। কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অনালোচিত সেই ইতিহাস।
১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস। নবাব সলিমুল্লাহ তত দিনে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। অসুস্থ শরীরে ডায়াবেটিস জেঁকে বসেছে। কয়েক মাস আগে এক ছেলে মারা গেছে। পুত্রশোক তখনো কাটেনি। এরই মধ্যে শুনলেন, প্রথম ভারতীয় হিসেবে নোবেল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম এশীয় হিসেবেও।
খবরটা শুনে খুব আনন্দিত হলেন সলিমুল্লাহ। সারা জীবন শিল্পসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণা করেছেন। তাই এক বাঙালি কবির বিশ্বজয়ের খবরে এই আনন্দ স্বাভাবিক। কয়েক দিনের মধ্যে ওই অসুস্থ শরীরে আয়োজন করলেন একটি অভিনন্দন সভার!
ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুই সম্ভ্রান্ত পরিবারের উত্থান ব্রিটিশ আমলেই। উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় দুটি পরিবার প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে তাদের সদ্ভাব ছিল। দুই পরিবারই বাংলার শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছিল। অথচ তাদের মধ্যে কতটা কী যোগাযোগ ছিল বা আদৌ ছিল কি না, তার কোনো ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায় না।পূর্ববঙ্গেরবীন্দ্রনাথ বইয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলছেন, শ্রেণিগত ও সামাজিক অবস্থানের কারণে ঢাকার নবাব ও কলকাতার জমিদার ঠাকুরদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকার কথা। কলকাতায় নবাবদের কয়েকটি বাড়ি ছিল। হয়তো দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। এ সবই সৈয়দ মকসুদের অনুমান।
তবে অনুমানের ওপর ভরসা না করেও চিঠিপত্র, টুকরো স্মৃতিকথা ও ঐতিহাসিক ঘটনায় কয়েকটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগের ঘটনা পাওয়া যায়। এর সবই আহসান মঞ্জিলের বাসিন্দাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের।
নবাব সলিমুল্লাহর অভিনন্দন সভা
সমকালীন দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সলিমুল্লাহ ও রবীন্দ্রনাথের দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছিল, এমন উল্লেখ কোথাও মেলে না। বরং রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার বছর কয়েক আগে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তাঁরা দুজন বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরে ছিলেন।
মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের পক্ষের প্রধান নেতা। পশ্চিমি শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহী, পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের উন্নতি তাঁর লক্ষ্য। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধী। তিনি একে দেখছিলেন ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি হিসেবে। কিছু কাল পরেই বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। তখন রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয়। ব্যথিত সলিমুল্লাহ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। ক্রমেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মধ্যে সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার খবর আসে। খবরটি প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর। ১৩ দিনের মাথায় ২৬ নভেম্বর ঢাকা সাহিত্য পরিষদ একটি অভিনন্দন সভার আয়োজন করে, সলিমুল্লাহ যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
কেবল পূর্ববঙ্গেরবীন্দ্রনাথবইয়ে ঘটনাটির উল্লেখ বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়। সৈয়দ মকসুদ জানাচ্ছেন, ঢাকার জজকোর্ট প্রাঙ্গণে বার লাইব্রেরির সামনে সভাটি হয়। সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বিধুভূষণ গোস্বামী মানপত্র পড়েন। মূল প্রবন্ধ ছিল সাহিত্য সমালোচক কামিনীকুমার সেনের। সভাপতিত্ব করেন নবাব সলিমুল্লাহ। সেদিন তিনি এতটাই অসুস্থ যে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বসেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার প্রতি সম্মান জানান।
তুরাগ বোট ও নবাব হাবিবুল্লাহর সংবর্ধনা
রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায় ঢাকায় আসেন মোটে দুবার। প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন ১৮৯৮ সালে, মাত্র তিন দিনের জন্য। ৩০, ৩১ মে ও ১ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির সম্মেলনে যোগ দিতে। দ্বিতীয়বার আসেন ১৯২৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের (জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ, পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) আমন্ত্রণে। রমেশচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাসায় উঠবেন। কিন্তু এ নিয়ে ঢাকার বিশিষ্টজনদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। তাঁদের কথা, রবীন্দ্রনাথ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, পুরো ঢাকার অতিথি।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের ৩০ জানুয়ারি (১৬ মাঘ ১৩৩২) রমেশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠি লেখেন: ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্য দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুতি হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে ওই কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব... বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করি নে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম।’
১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেবার তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীমোহন ঘোষ, হিরজিভাই মারিচি প্রমুখ।
৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় এসে ওঠেন বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজ ঘাটে বাঁধা নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর (নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে) রাজকীয় জলযান তুরাগ হাউস বোটে। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। আত্মজীবনী আমারছেলেবেলায়তিনি লিখছেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার উপর নোঙর ফেলা একটি স্টিম লঞ্চে... উপরের ডেকে ইজিচেয়ারে বসে আছেন তিনি, ঠিক তাঁর ফটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা-পাজামা পরনে—আর কেউ কেউ উপস্থিত ও সঞ্চারণমান, রেলিঙে হেলান দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি।’
আবার গোপালচন্দ্র রায়ের ঢাকায়রবীন্দ্রনাথগ্রন্থে আছে, তুরাগ হাউস বোটে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন সকালে নবাবদের একটি মোটর নৌকায় করে বেড়াতে বের হতেন।
৭ ফেব্রুয়ারি দুটি নাগরিক সংবর্ধনা গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। একটি হয়েছিল পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের নর্থব্রুক হলে, আরেকটি বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ঢাকা করোনেশন পার্কে (বিলুপ্ত)। দ্বিতীয়টিতে নবাব হাবিবুল্লাহর হিন্দু মোসলেম সেবাশ্রম অংশ নেয়। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে কবির হাতে হাবিবুল্লাহ মানপত্র তুলে দেন। ঢাকার ইসলামিয়া প্রেসে ছাপা মানচিত্রটি এখন কলকাতার রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত।
ভূঁইয়া ইকবালের রবীন্দ্রনাথওমুসলমানসমাজ-এ ‘অভিবাদন’ নামের মানপত্রটি ছাপা হয়েছে: ‘দেব... এই ঢাকা নগরীতে বহুপূর্ব্বে আপনার পিতৃদেব পরমপূজ্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় আসিয়া তাঁহার পরম পবিত্র চরণ রেণু দানে ঢাকা নগরীকে কৃতার্থ করিয়াছিলেন। আপনি বহুপূর্ব্বে একবার ঢাকাতে আসিয়া ঢাকাবাসীর আনন্দ উৎপাদন করিয়াছিলেন। বর্ত্তমানে আপনার ঢাকায় শুভাগমনে—আপনার পদস্পর্শে ঢাকা নগরী ধন্য ও কৃতার্থ হইয়াছে।’
করোনেশন পার্কের সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজ আমার সৌভাগ্য এই যে, কেবলমাত্র বাক্যরচনার যোগে আপনাদের হৃদয়ের মধ্যে আমার অদৃশ্য আসন পাতা হয়নি, আজ প্রত্যক্ষভাবে আপনাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে পারব... জীবন-পথ যাত্রার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। মাতৃভূমির সকল তীর্থ হতেই বঙ্গজননীর শেষ চরণধূলি নিয়ে যাব সেই প্রত্যাশায় এখানে আমার আসা...আজ এই সন্ধ্যাসূর্যের শেষ বাণীর দ্বারাই আমার বিদায় অভিবাদনকে পূর্ণ করে আপনাদের কাছে রেখে দিয়ে গেলাম।’ (পূর্ববঙ্গেবক্তৃতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি নবাববাড়ি আহসান মঞ্জিলে রবীন্দ্রনাথের সম্মানে চা-চক্রের আয়োজন করা হয়।
খাজা নাজিমুদ্দিনকে দুটি চিঠি
নবাব সলিমুল্লাহর বোন নবাবজাদি বিলকিস বানু বেগমের বড় ছেলে খাজা নাজিমুদ্দিন। পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ঢাকার নবাব পরিবারের এ সদস্যকে দুটি ঘটনায় চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথম চিঠিটি রাজবন্দী কল্পনা দত্তকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করে। দ্বিতীয়টি বিশ্বভারতীর শিক্ষক অ্যালেক্স আরনসনের মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে সুপারিশের আরজি জানিয়ে।
কল্পনা দত্ত ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবের অন্যতম সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতেন ‘অগ্নিকন্যা’। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার অন্যতম আসামি কল্পনা দত্ত ১৯৩৩ সালের ১৯ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার গৈরালা গ্রামে ইংরেজদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা ধরা পড়েন। তাঁদের মুক্তির দাবিতে কলকাতায় ছাত্ররা আন্দোলন করছিল।
১৯৩৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে চিঠি লেখেন: ‘আমি বহুদিন ধরে নারী রাজবন্দীদের নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত, যারা এখনো জেলে রয়েছেন। তাদের একজন শ্রীমতী কল্পনা দত্ত...যারা এখনো জেলে বন্দী, তাদের যদি মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়, আমার বিশ্বাস তাতে দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। এতে বর্তমান বাংলা সরকারের মানবিক উদ্দেশ্য জনসাধারণের কাছে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। ফলে দুর্ভিক্ষ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া রোধের কাজটি আপনাআপনি সম্ভবপর হবে...যে পরিবেশের কারণে তাদের আবেগের বিস্ফোরণ সন্ত্রাসের মাধ্যমে হয়েছিল, তার পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করি যদি তারা ও তাদের বাবা-মা একবার মহাত্মাজিকে (গান্ধী) কথা দিয়ে থাকেন, তাদের প্রতিজ্ঞা মনন ও শব্দে রক্ষিত হবে।’ (রবীন্দ্রনাথওমুসলমানসমাজ, ভূঁইয়া ইকবাল)
ছাত্র আন্দোলনের চাপে ১৯৩৯ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দেয়।
অন্যদিকে অ্যালেক্স আরনসন ছিলেন একজন জার্মান ইহুদি। তাঁর বিখ্যাত বইরবীন্দ্রনাথথ্রুওয়েস্টার্নআইজ।আরনসনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দ্যস্টেটসম্যানপত্রিকার কলকাতা সংস্করণে (৪ নভেম্বর ২০১২) প্রকাশিত জার্মান পণ্ডিত মার্টিন কাম্পচেনের ‘আলেক্স আরনসন লিভস অন’ লেখায় আছে, ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কাছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে চিঠি লিখে আরনসন শান্তিনিকেতনে আশ্রয় চান। হিটলারের জার্মানি থেকে বিতাড়িত আরনসন ইউরোপের যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে নিষ্কৃতি চান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার আরনসনকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। নাৎসি জার্মানি থেকে বিতাড়িত এই ইহুদি নাগরিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন, এমন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তবু আরনসনকে প্রথমে পাঠানো হলো ফোর্ট উইলিয়ামের ক্যাম্পে, পরে আহমেদনগরে।
আরনসনের ওপর শান্তিনিকেতনের বিএ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার তত্ত্বাবধানের ভার ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুক্তির জন্য খুব চেষ্টা করছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনকে তিনি দুটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রথম চিঠিটি পাওয়া যায় না। ১৯৪০ সালে ৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমি সম্প্রতি যে চিঠিটি লিখেছিলাম এবং সে ব্যাপারে তাঁর উত্তর দুটোর কপিই এখানে সংযুক্ত করছি। যুদ্ধ শুরুর পর পরই ড. আরনসনকে একটি বন্দী-শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল, আরনসন যে বিভাগে আছেন, আমাদের পক্ষ থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমিও আপনার কাছে বিশেষ বিবেচনার জন্য লিখেছিলাম। তাঁর পক্ষে আপনার মধ্যস্থতা তাঁকে দ্রুত মুক্ত করবে, আমার এমন বিশ্বাসের যথেষ্ট কারণ আছে।’
রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষরিত ইংরেজি চিঠিটির অনুলিপি ঢাকার নবাব পরিবারের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে আছে। নবাব পরিবারের সদস্য সৈয়দ খাজা বেলাল হাসানের তত্ত্বাবধানে ও খাজা আনাসের সম্পাদনায় www.nawabbari.com ওয়েবসাইটটি পরিচালিত হয়। সেখানে বলা আছে, রবীন্দ্রনাথের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিন ব্রিটিশদের কাছে আরনসনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন।
নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ও খাজা শাহাবুদ্দিন
এবারের ঘটনাটি আগের ঘটনাগুলোর বিপরীতধর্মী। দেশভাগের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ধারণা ক্রমশ গড়ে উঠছিল যে, রবীন্দ্র রচনা ভারতের পক্ষে মানুষের মনে সহানুভূতি তৈরি করতে পারে, যা ১৩০০ মাইল দূরত্বের দুই পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক।
১৯৬১ সালে অনেক বিধিনিষেধ ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৬৫ সালে হয় পাক-ভারত যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে রবীন্দ্রবিরোধিতাও। গোলাম মুরশিদ রবীন্দ্রবিশ্বেপূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গেরবীন্দ্রচর্চাগ্রন্থে বলছেন, ধীরে ধীরে রেডিও, টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার কমতে থাকল।
আইয়ুব খানের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ছিলেন নবাব পরিবারের সদস্য খাজা শাহাবুদ্দিন (খাজা নাজিমুদ্দিনের ছোট ভাই)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বললেন, রবীন্দ্রসংগীত হিন্দু সংগীত, ইসলামের পবিত্র ভূমি পাকিস্তানে তা চলবে না। পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মর্যাদার পরিপন্থী এমন সব রবীন্দ্রসংগীত ভবিষ্যতে পাকিস্তান বেতারে প্রচারিত হবে না। এবং অন্যান্য সংগীতেরও প্রচার কমানো হবে।
পরদিন ২৩ জুন সরকারিভাবে এই আদেশ জারি করা হয়। পাকিস্তানের সব সরকারি সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। খাজা শাহাবুদ্দিনের মন্তব্য ও পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
ঘটনাটি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। বলতে গেলে এই নিষেধাজ্ঞার পর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি চেতনার নবনির্মাণ ঘটে।
তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এই একটি ঘটনা বাদ দিলে ঢাকার নবাব পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্কের কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।