কত অজানা রে

আমাদের রসগোল্লা

রসগোল্লা আবিষ্কারের লিখিত ইতিহাস এখনো ২০০ বছর পার হয়নি
ছবি: রেবেকা সুলতানা ইভা

রসগোল্লা শুধু একটি মিষ্টি নয়, বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে জুড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু রসগোল্লা কি বাংলা অঞ্চলের মিষ্টি? বাঙালির রসগোল্লার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের রসগোল্লার পার্থক্য কোথায়?

‘রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়! ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।’
—সৈয়দ মুজতবা আলী

রসগোল্লা নিয়ে ঝান্ডুদার মতো এত বড় ‘কীর্তি’ আর কোনো বাঙালি গড়তে পেরেছিলেন কি না, আমরা জানি না। ভ্যাকুয়াম টিন খোলার শোকে বিদেশ–বিভূঁইয়ে, বিদেশি চুঙ্গিঘরের কর্মকর্তার মুখে রসগোল্লা ‘থেবড়ে’ দেওয়া ঝান্ডুদার মতো বঙ্গসন্তানের পক্ষেই সম্ভব। রসগোল্লা নিয়ে ঝান্ডুদার উত্তেজিত হয়ে বিদেশি নিয়মকানুনকে থোড়াই কেয়ার করার মানসিকতা আর দশজন বাঙালির মতো ‘বাইডিফল্ট’ রসগোল্লা বলে কথা!

এই যে রসগোল্লা, যার জন্য বাঙালি নাকি ‘জান কয়লা’ করে ফেলতে পারে, তার আবিষ্কারের লিখিত ইতিহাস এখনো ডাবল সেঞ্চুরি করতে পারেনি। সবচেয়ে পুরোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় ১৭০ বছরের কিছু আগের। তার চেয়ে কম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি ১৫০ বছর আগের। দাবি দুটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক হলেও ভারতের অন্য রাজ্য উড়িষ্যা রসগোল্লার মালিকানা নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নেমেছিল পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। তাতে অবশ্য তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি পশ্চিমবঙ্গকে। কিন্তু বাঙালির রসগোল্লার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের রসগোল্লার পার্থক্য কোথায়?

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের রসগোল্লা চেখে যা দেখেছি, তাতে বলাই যায়, বাঙালি রসগোল্লার বেশ কিছু মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো হলো বাংলার রসগোল্লা ছানা দিয়ে তৈরি, নরম ও স্পঞ্জি—মুখে দিলেই গলে যায়। এতে চিনির রসের ব্যবহার রয়েছে, (নকল ছাড়া) ময়দা ও সুজি একেবারেই ব্যবহার করা হয় না। অন্যদিকে বিভিন্ন দলিল–দস্তাবেজ জানাচ্ছে, উড়িষ্যার রসগোল্লার বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষীর ও সুজির ব্যবহার, লাল রং, রস হয় মোটা বা গাঢ়; মিষ্টি স্বাদ আনতে গুড়ের ব্যবহার করা হয়। এসব বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন যুক্তি–তর্কের রশি টানাটানি শেষে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ রসগোল্লার জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) লাভ করে।

মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে প্রচুর পরিমাণে খাবারদাবারের উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার উল্লেখ নেই। ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ কিংবা ‘চণ্ডীমঙ্গল’–এর মতো বইয়ে যখন সন্দেশের কথা উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার কথা উল্লেখ থাকে না, তখন বুঝতে হয়, রসগোল্লা আসলেই বাংলা অঞ্চলে নতুন খাবার। অথচ বৈদিক যুগ থেকে দুধ, দুধ থেকে তৈরি ক্ষীর, দই, ঘি, মাখন শুধু বাংলা অঞ্চলে নয়; বরং পুরো ভারত উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ খাবার হিসেবে পরিগণিত ছিল। এ জন্য হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবতার ভোগেও এই খাবারগুলো নিবেদন করা হতো।

ধারণা করা হয়, রসগোল্লা তৈরির মূল উপাদান ছানা ভারতবর্ষের মানুষ তৈরি করতে পারতেন না, সম্ভবত এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, জানা যায়, আনুমানিক ৯ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারত ভূখণ্ডে কৃষিব্যবস্থার সূচনা ঘটে। বৃক্ষরোপণ, শস্য উৎপাদন ও পশুপালন ছিল প্রাচীন কৃষিব্যবস্থার মূল উৎস। পশুপালন প্রথার ইতিহাস এত দীর্ঘ হলে, ভেবে নেওয়া অসংগত নয় যে ভারতবর্ষে দুধ ও দুধজাত বিভিন্ন খাবারের প্রচলন বহু আগেই শুরু হয়েছে। কাজেই পর্তুগিজদের কাছে ভারত, তথা বাংলা অঞ্চলের মানুষ ছানার ব্যবহার শিখেছে, এটা মেনে নেওয়া কিছুটা কঠিনই বটে। প্রাচীন ভারতে ছানা কিংবা ছানা দিয়ে তৈরি করা খাবারের প্রচলন হয়তো সীমিত ছিল।

লিখিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও বাংলাদেশের গবেষকেরা ধারণা পোষণ করেন, অবিভক্ত বাংলার বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রথম রসগোল্লা আবিষ্কৃত হয়।

এর একটা কারণ হতে পারে এই যে সংস্কৃত ভাষায় ‘আমিক্ষা’ কিংবা ‘আমীক্ষা’ বলে একটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেটির বাংলা অর্থ ছানা (নগেন্দ্রনাথ বসু, ‘বিশ্বকোষ’, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১১২)। ছানা হলো দুধের বিকৃতি। আর বিকৃত দ্রব্য দেবভোগ্য হতে পারে না। তাই এটা সাধারণ্যে ‘অজ্ঞাত’ এবং দেবতার ভোগে নিষিদ্ধ (ঠিক একই রকম তথ্য পাওয়া যায় গোল আলুর ক্ষেত্রেও)। উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ জে. পাঢ়ী জানাচ্ছেন, ‘The rasgulla is more than 600 years old. It is as old as the Rath Yatra in Puri.’ তার মানে হলো পুরিতে ছানার অস্তিত্ব বেশ পুরোনো। শুধু উড়িষ্যার পুরি অঞ্চলেই নয়, জে. পাঢ়ীর বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুধের মতো ছানারও অস্তিত্ব ছিল, বাংলাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। যেহেতু সংস্কৃত কেতাবে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না এবং এটি দেবভোগ্য নয়, তাই সম্ভবত সাধারণ মানুষ এটি নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবেনি। আর এই সূত্রে এটাও ভাবা অসংগত নয় যে অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের ময়রারাও ছানার ব্যবহার জানতেন। কাজেই এই অঞ্চলে রসগোল্লার আবিষ্কার হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়, যদিও তার লিখিত ইতিহাস নেই।

রসগোল্লা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামের হারাধন ময়রার নাম শোনা যায়। ধারণা করা হয়, হারাধন ময়রা ১৮৪৬-৪৭ সালের দিকে প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেন। প্রণব রায় তাঁর বইয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ১৩১৩ বঙ্গাব্দের কার্যবিবরণীর সূত্র ধরে হারাধন ময়রার রসগোল্লা তৈরির গল্প জানিয়েছেন। তিনি পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার সূত্র ধরে জানান, ‘কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়া গ্রামে রসগোল্লার জন্মভূমি। ঐ গ্রামের হারাধন ময়রা রানাঘাটের পালচৌধুরী মহাশয়দের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিত। তাহার শিশুকন্যা কাঁদিতেছিল। তাহাকে সান্ত্বনার জন্য উনানের ওপর তৈরি রসে ছেনা ফেলিয়া দেখিল উৎকৃষ্টসামগ্রী তৈয়ার হইয়াছে। পালচৌধুরী জমিদারেরা উহার “রসগোল্লা” নামকরণ করেন।’ উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন মিষ্টি প্রস্তুতকারকেরা। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে দুই বাংলায়। অন্য আর একটি জনপ্রিয় মত হলো, কলকাতার বেনেটোলার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের দীনু ময়রার পূর্বপুরুষ ব্রজ ময়রা কলকাতা হাইকোর্টের কাছাকাছি তাঁর দোকানে ১৮৬৬ সাল নাগাদ রসগোল্লা আবিষ্কার করেন। কলকাতার বাগবাজারের নবীন দাস আবিষ্কার করেন বিখ্যাত স্পঞ্জ রসগোল্লা।

রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব-পার্বণ ঠিক জমে ওঠে না

অন্যদিকে লিখিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও বাংলাদেশের গবেষকেরা ধারণা পোষণ করেন, অবিভক্ত বাংলার বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রথম রসগোল্লার আবিষ্কার হয়। খাদ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক শওকত ওসমান বিবিসিকে বলেছেন, ‘লিখিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও তাঁদের ধারণা, ষষ্ঠ শতকে দক্ষিণাঞ্চলীয় পটুয়াখালীতে পর্তুগিজরা দুধ থেকে পনির ও সন্দেশ তৈরি করত। সেগুলো দিয়েই বাঙালি স্ত্রীরা রসগোল্লা বা এ ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করেন।’ইতিহাসে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, রসগোল্লার রসের কাছে সবকিছুই ম্লান! যে কারণে ভ্যাকুয়াম টিন খোলার পর রসগোল্লা নষ্ট হয়ে যাওয়ার চিন্তায় ঝান্ডুদার মাথা কিছুটা গরম হয়ে পড়েছিল। তাতেই রসগোল্লা থেবড়ে দেওয়ার মতো অভাবনীয় ঘটনা তিনি ঘটিয়েছিলেন। আর হবে নাই–বা কেন? রসগোল্লা আবিষ্কারের পর দুই বাংলার মিষ্টির কারিগরেরা কি কম ঘটনা ঘটিয়েছিলেন? এই এক রসগোল্লা আবিষ্কারের পর বিভিন্ন নামে ও প্রণালিতে ‘রসগোল্লাজাতীয়’ অনেক মিষ্টি বানিয়েছেন তাঁরা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্পঞ্জ রসগোল্লা, কমলা রসগোল্লা, রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, দিলবাহার, চমচম, রসকদম্ব, মৌচাক, দানাদার, রসমুণ্ডী, ছানার গজা, ছানার মুড়কি ও পান্তোয়া। আবার পান্তোয়াজাতীয় মিষ্টির মধ্যে আছে ঢাকাই লালমোহন, ছানার জিলাপি, ল্যাংচা, কালোজাম, কলকাতার বিখ্যাত লেডিকেনি, নিখুঁতি ইত্যাদি। এই রসগোল্লাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি রসমালাই বা রসমঞ্জুরি। নেত্রকোনা অঞ্চলের বিশালাকার বালিশ মিষ্টিও রসগোল্লারই একটি ধরন। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন অঞ্চলের চমচম। বাংলাদেশে এই চমচমগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হলো টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট চমচম ইত্যাদি।

যে অঞ্চলগুলোতে দুধের প্রাচুর্য আছে, সে অঞ্চলগুলো রসগোল্লা এবং এ–জাতীয় মিষ্টি তৈরিতে বিখ্যাত হয়েছে। রসগোল্লা ও রসগোল্লাজাতীয় মিষ্টি তৈরিতে বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হলো দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা, বিক্রমপুর, নরসিংদী ও কুমিল্লা। এ ছাড়া পুরো বাংলাদেশে কমবেশি রসগোল্লা তৈরি হয়।

রসগোল্লা শুধু একটি মিষ্টি নয়, বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে জুড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বারোয়ারি বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে রসগোল্লার বর্ণাঢ্য উপস্থিতি প্রমাণ করে, বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে এটি তৈরি করেছে ভিন্ন দ্যোতনা। বিলাসী বাঙালির স্মৃতি রোমন্থনের ক্ষেত্রে রসগোল্লা উপযুক্ত অনুষঙ্গ। অনুষ্ঠানের জন্য রাখা রসগোল্লা চুরি করে খাওয়া আমাদের শৈশবের স্মৃতিতে অমলিন। চিড়ার সঙ্গে দই, তার ওপর সাদাটে রসগোল্লা আর তার শিরা অমৃত বলেই বিবেচিত বাঙালির কাছে। তবে মধ্যরাতে তৈরি হওয়া গরম গরম রসগোল্লার স্বাদ যাঁরা পাননি, তাঁদের দুর্ভাগাই বলতে হবে।

রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব-পার্বণ ঠিক জমে ওঠে না। ছবি: নায়ীমী নাফসীন

রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব-পার্বণ ঠিক জমে ওঠে না। ছবি: নায়ীমী নাফসীন

মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে প্রচুর পরিমাণে খাবারদাবারের উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার উল্লেখ নেই। ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ কিংবা ‘চণ্ডীমঙ্গল’–এর মতো বইয়ে যখন সন্দেশের কথা উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার কথা উল্লেখ থাকে না, তখন বুঝতে হয়, রসগোল্লা আসলেই বাংলা অঞ্চলের নতুন খাবার। অথচ বৈদিক যুগ থেকে দুধ, দুধ থেকে তৈরি ক্ষীর, দই, ঘি, মাখন শুধু বাংলা অঞ্চলে নয়; বরং পুরো ভারত উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ খাবার হিসেবে পরিগণিত ছিল।

আমাদের খাদ্যবিলাসের বিভিন্ন ধাপে রসগোল্লা যে কত রকমভাবে জড়িয়ে আছে, তার বর্ণনা দেওয়া বেশ কঠিন। নতুন যা কিছু, তার সঙ্গে রসগোল্লার একটা যোগসূত্র রয়েছে। নতুন চাকরি পেয়েছেন তো রসগোল্লা খাওয়াতে হবে; নতুন বিয়ে, নতুন বাবা-মা হওয়া—এমন সব অনুষঙ্গে রসগোল্লা না খাওয়ালে চলে! পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন বাজারের মিষ্টির দোকান থেকে যে মিষ্টি প্রথমে উধাও হয়ে যায়, সেটি আর কিছু নয়, রসগোল্লা। গ্রামীণ হাটে গরম গরম রসগোল্লা আর শিরায় চুবিয়ে নোনতা নিমকি খাওয়ার স্মৃতি বয়স্ক লোকজন কতটা ভুলতে পেরেছেন? প্রথম কোনো নতুন আত্মীয়ের বাড়ি যেতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া বাঙালির চিরায়ত প্রথা। এই প্রথার প্রধান অনুষঙ্গ রসগোল্লা। আত্মীয়ের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার প্রথা ক্রমে বিলুপ্তির পথে হাঁটলেও ভেবে দেখুন তো, হঠাৎ করে কেউ এক বাক্স রসগোল্লা নিয়ে উপস্থিত হলে আপনার আনন্দ হবে কি না?

রসগোল্লা পরিবহনের ক্ষেত্রেও ছিল বৈচিত্র্য। শুকনা মিষ্টির জন্য রংচঙে মোটা কাগজের প্যাকেট ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে রসগোল্লা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো মাটির হাঁড়ি। রাজশাহী অঞ্চলের বিখ্যাত নকশাদার শখের হাঁড়িভর্তি রসগোল্লা নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠানো ছিল বিশাল গর্বের ব্যাপার। ধীরে ধীরে মাটির হাঁড়ির ব্যবহার কমে আসতে থাকলে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। প্লাস্টিকের প্যাকেটে রসগোল্লা ভরে বাঁশের ঝুড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন জায়গায়। এরপর যখন চমচম, কালোজাম ইত্যাদি নামে প্রায় রসহীন মিষ্টি বানানো শুরু হলো, তখন ব্যবহার হতে শুরু করল মোটা কাগজের প্যাকেট। বিভিন্ন রসহীন মিষ্টির দৌরাত্ম্যে এখন বরং চিনির শিরায় চুবানো প্রায় সাদা রঙের গোল গোল রসগোল্লা পাওয়াই কঠিন।

খাদ্যবিলাসী বাঙালির জীবনে ঝালের চেয়ে মিষ্টি প্রিয়। সে কারণে দুই বাংলায় মিষ্টির এত প্রজাতি তৈরি হয়েছে। আর মিষ্টির মধ্যে যে রসগোল্লা প্রথম, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শত বিবর্তনের মধ্যেও ময়রার বাড়িতে বা দোকানে গনগনে মাটির উনুনে চিনির শিরায় ফুটতে থাকা প্রায় সাদা রসগোল্লা বাঙালির রসনাই শুধু নয়, মনও ভরিয়ে তোলে।

সূত্র:

১. বাংলার খাবার, প্রণব রায়, সাহিত্যলোক, ১৯৮৭, কলকাতা।

২. রসগোল্লা যে বাংলারই, তা প্রমাণ হলো কীভাবে জানেন?, নিউজ ১৮ বাংলা, কলকাতা, নভেম্বর ১৭, ২০১৭।

৩. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল, কলকাতা।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com